ফিলিস্তিনি কবির ভাইরাল সাক্ষাৎকার এবং তারপর...

ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় বিধ্বস্ত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড
ছবি: এএফপি

শেখ জাররাহ। পূর্ব জেরুজালেমের ছোট্ট এই পাড়ার আকাশে গত ১০–১২ দিনে কোনো নক্ষত্রের আলো চোখে পড়েনি। চোখে পড়েনি অবাক জ্যোৎস্নার রোশনাই। সারা আকাশ ভরে আছে আগুন-বোমার লেলিহান শিখায়। অনন্ত নক্ষত্রবীথি ঘুমিয়ে গেছে। ঘরের জানালা খুললেই শিশুরা দেখছে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে রকেট লঞ্চার। আকাশে চোখ তুললেই দেখতে পাচ্ছে বোমারু বিমানের ওড়াউড়ি। আচমকা মাথার ওপর ধ্বসে পড়ছে ঘরের ছাদ। চারপাশে শুধু ধ্বংস, শুধু রক্ত, শুধু মৃত্যু!

এই ধ্বংসলীলার সূত্রপাত প্রায় ১২ দিন আগে। শেখ জাররাহর আটটি পরিবারকে ভিটেমাটি ছেড়ে দেওয়ার আদেশ পাঠান জেরুজালেমের জেলা আদালত। কিন্তু বংশপরম্পরায় যুগ যুগ ধরে যাঁরা এই অঞ্চলে বাস করছেন, তাঁরা কেন ভিটেমাটি ছাড়তে রাজি হবেন? স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা অস্বীকৃতি জানান। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দেখল, সোজা আঙুলে ঘি উঠছে না। তাই হামলা করে বসে তারা। এ পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিরাও চালায় পাল্টা হামলা। শুরু হয় অনিবার্য সংঘাত-সংঘর্ষ।

মাত্র এই কয়েক দিনে ইসরায়েলের হামলায় দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, এর মধ্যে শিশু রয়েছে অর্ধশতাধিক। আহত হয়েছে হাজার হাজার। সংঘর্ষে মারা গেছেন ইসরায়েলেরও কয়েকজন। তবে সংখ্যার দিক থেকে ইসরায়েলের চেয়ে ফিলিস্তিনিরা নিহত হয়েছে কয়েক গুণ।

এই ধ্বংসযজ্ঞের শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা গণমাধ্যমে প্রতিবাদ জারি রাখেন ফিলিস্তিনি কবি মোহাম্মদ এল কুর্দ। সম্প্রতি এই তরুণ কবির দুটি সাক্ষাৎকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে (ভাইরাল)। তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল ও এমএসএনবিসি চ্যানেলে। ভাইরাল হওয়া সেই সাক্ষাৎকারের পর কী ঘটেছিল এই কবির জীবনে, তা জানার আগে চলুন জানা যাক, কে এই এল কুর্দ।

ফিলিস্তিনি কবি মোহাম্মদ এল কুর্দ
ছবি: সংগৃহীত

একজন মোহাম্মদ এল কুর্দ

মোহাম্মদ এল কুর্দ ফিলিস্তিন থেকে উৎখাত হওয়া একজন লেখক ও কবি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাভানাহ কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। স্নাতকোত্তর করেন ব্রুকলিন কলেজ থেকে। ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ লেখক সম্প্রতি নিউইয়র্কের নিরাপদ জীবন ছেড়ে চলে গেছেন নিজ জন্মভিটা জেরুজালেমের শেখ জাররাহতে। ‘কেন ফিরলেন’, এমন প্রশ্নের জবাবে ভাইস মিডিয়া গ্রুপকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এল কুর্দ বলেন, ‘আমার জন্মভিটা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলের হানাদাররা আর আমি চুপ করে বসে থাকব? ৭৩ বছর ধরে যেখানে বসবাস করছেন আমার প্রতিবেশীরা, সেখান থেকে উৎখাত করা হচ্ছে তাঁদের, আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখব এই অন্যায়? আমার না ফিরে তো উপায় নেই। এটাই আমার বাড়ি, এটাই আমার শিকড়, এটাই আমার আসল ঠিকানা।’

এল কুর্দ শুধু ফিরলেনই না। ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ–প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে জানাতে থাকলেন ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান বর্বরতার বার্তা। লিখতে থাকলেন গার্ডিয়ান, আল–জাজিরা, দ্য নেশন থেকে শুরু করে বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যমে। অনবরত সাক্ষাৎকার দিতে থাকলেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয়। এর মধ্যে সিএনএন ও এমএসএনবিসি চ্যানেলে দেওয়া তাঁর দুটি সাক্ষাৎকার ভাইরাল হয়ে যায় অন্তর্জালের দুনিয়ায়।

কী আছে দুই সাক্ষাৎকারে

দুটি সাক্ষাৎকারেই বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন এল কুর্দ। তিনি ইসরায়েলের এই হামলাকে সরাসরি ‘জাতিগত নিধন’ বলে অভিযোগ করেছেন। সিএনএনের উপস্থাপক যখন তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘এই যে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের পরিবারগুলোর ওপর রকেট হামলা চালাচ্ছে, তাদের এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে কি আপনি সমর্থন করেন?’ তখন অগ্নিমূর্তি হয়ে এল কুর্দ পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘এই যে আমার জন্মস্থান থেকে আমাকে উৎখাত করা হচ্ছে, আমার পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে, বোমা মেরে শিশুদের মেরে ফেলা হচ্ছে, তা কি আপনি সমর্থন করেন?’

অন্যদিকে এমএসএনবিসির উপস্থাপক আয়মান মোহেলাইদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনে এখন যা চলছে, তা এককথায় জাতিগত নিধন। একটি জাতিকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য তারা ঔপনিবেশিক আমলের আইনকে তো ব্যবহার করছেই, উপরন্তু ব্যবহার করছে পেশিশক্তি। ইসরায়েলের এই অন্যায় আচরণ ঐতিহাসিকভাবেই অনৈতিক। এটা ‘এথনিক ক্লিনজিং’ (জাতিগত নিধন) ছাড়া আর কিছু নয়। এটা স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধ।

ঠিক এই সময় আয়মান মোহেলাইদিন এই লাইভ সাক্ষাৎকারে আমন্ত্রণ জানান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উপদেষ্টা এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্ক রিজেভকে। তিনি মার্ককে প্রশ্ন করেন, ‘ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধ করছে ইসরায়েল’—এল কুর্দের এই অভিযোগের ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? উত্তরে মার্ক রিজেভ বলেন, দুই দিক থেকেই শক্ত যুক্তি আছে। তারাও তো বলে, ইসরায়েল রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই।

এল কুর্দের সাক্ষাৎকারের এই দুই অংশই মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

কী ঘটেছে সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর

দুটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর ২৪ ঘণ্টাও অতিক্রম করেনি, তার আগেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হাজির হয়েছে এল কুর্দের শেখ জাররাহর বাড়িতে। টেনেহিঁচড়ে বের করেছে তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। বলেছে, ‘চলে যাও শেখ জাররাহর সীমানার বাইরে।’ দ্য ডেইলি বিস্ট পত্রিকা মারফত জানা গেছে, এ সময় ‘আমাকে মেরে ফেলো, আমাকে মেরে ফেলো’ বলে চিৎকার করতে থাকেন এল কুর্দ। আর সৈন্যরা তাঁকে ধাক্কা দিতে দিতে সীমান্তরেখার বাইরে পাঠিয়ে দেন। তখন এল কুর্দের বোন সৈন্যদের হাত থেকে ভাইকে কেড়ে নিতে এলে ইসরায়েলি সৈন্যরা তাঁকেও ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেন সীমান্তরেখার বাইরে। এভাবে যতবার এল কুর্দ, তাঁর বোন ও পরিবারের লোকজন শেখ জাররাহর সীমানায় ঢুকতে চেয়েছেন, ততবারই ইসরায়েলি সৈন্যরা তাঁদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন।

এল কুর্দ এখন কোথায় আছেন? টুইটারে লিখেছেন, তিনি যেখানে আছেন, সেখানে ভালো আছেন। তবে ভয় এখনো কাটেনি।

সূত্র: সিএনএন, এমএসএনবিসি, দ্য ইনডিপেনডেন্ট, ভাইস, মিডিয়া আইটিই, ডেইলি বিস্ট ও দ্য নেশন।