বাংলাদেশ ও বাঙালির একটা ‘মা’ আছে

আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাসের শততম মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে। গেল ২৫ ডিসেম্বর বাতিঘরে এ উপলক্ষে আয়োজিত হলো এক অনুষ্ঠান। এখানে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন লেখক আনিসুল হক ও প্রকাশক ফরিদ আহমেদ। এ ছাড়া ভার্চ্যুয়ালি আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান, বরেণ্য লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রমুখ। সেই অনুষ্ঠান এবং ‘মা’ উপন্যাসকে ঘিরে এই লেখা।

‘মা’ উপন্যাস ও শততম মুদ্রণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের ছবি অবলম্বনকোলাজ: মনিরুল ইসলাম

প্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের একটি অসাধারণ উপন্যাসের নাম ‘মা’। এই ‘মা’ উপন্যাসের ১০০তম সংস্করণ বের হয়েছে। আর এটি বের হয়েছে এমন এক অপূর্ব সময়ে, যখন একদিকে বিজয়ের মাস, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ আর কিছুদিন পরই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এমন একটি সময়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি অভূতপূর্ব উপন্যাস ‘মা’-এর ১০০তম সংস্করণ আমাদের ভীষণভাবে অভিভূত করেছে।

বাংলার এক সংশপ্তক সন্তান ও তাঁর মাকে ঘিরে রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কালজয়ী উপন্যাস ‘মা’। উপন্যাসটিতে আছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদ ও তার মায়ের জীবনের সত্য ঘটনা। ‘মা’ একটি ছোট্ট শব্দ। এর গভীরতা বিশাল। পৃথিবীতে মায়ের বিকল্প শুধু মা-ই। এমন একটি উপন্যাসের শততম প্রকাশনা উৎসব আমাদের জন্য আনন্দের, অহংকার ও গর্বের।

২০১৮ সালে ‘মা’ উপন্যাসের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে ছিলাম আমি। সেখানেই প্রথম জানতে পারি এটি শততম মুদ্রণের দিকে এগোচ্ছে। তখন থেকেই ১০০তম মুদ্রণের জন্য ছিল একধরনের অপেক্ষা। অবশেষে বিজয়ের মাসে অবসান হলো সে অপেক্ষার।  

২০০৩ সালে সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটির প্রথম মুদ্রণ। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০৩ থেকে ২০২০ সাল। মাঝখানে চলে গেছে ১৮ বছর। সৃষ্টির ১৮তম বছরে হয়েছে ১০০তম মুদ্রণ।

বইটি বাংলাদেশ ও কলকাতা থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। এ ছাড়া ‘ফ্রিডম মাদার’ নামে ইংরেজি, ‘লা মাদার’ নামে স্প্যানিশ ও উড়ে ভাষায় প্রকাশ হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো এটি আরও অনেক ভাষায় প্রকাশিত হবে।

এমন একটি উপন্যাসের শুধু শততম মুদ্রণ কেন, এক শ-দুই শ করে একদিন হয়তো হাজারতম মুদ্রণ ছাড়িয়ে যাবে। সেদিন আমরা থাকব না। কিন্তু যেমন করে তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ আছে, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ আছে, তেমনি করে আনিসুল হকের ‘মা’ থাকবে।

গেল ২৫ ডিসেম্বর ছিল ‘মা’ উপন্যাসের শততম সংস্করণের প্রকাশনা উৎসব। এটি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাতিঘরে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়। এখন করোনাকাল। আমরা এখন এক ভয়ানক দুঃসময় পার করছি। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়া হয় না। তবে যখন এমন এক ‘মা’-এর শততম সংস্করণের প্রকাশনা উৎসব হয়, তখন কি আর ঘরে থাকা যায়? ফলে ‘মা’–এর টানে বেরিয়ে পড়লাম। দারুণ এক উপভোগ্য অনুষ্ঠানও হলো। বাতিঘরে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে সেদিন উপস্থিত ছিলেন লেখক আনিসুল হক ও উপন্যাসটির প্রকাশক, সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ ফরিদ আহমেদ। আর এখানে ভার্চ্যুয়ালি অংশ নেন বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান, বরেণ্য লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, বাতিঘরের প্রধান নির্বাহী জাফর আহমদ রাশেদ।

‘মা’ উপন্যাসের শততম মুদ্রণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে লেখককে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন পাঠকেরা
ছবি: সংগৃহীত

১০০তম সংস্করণের প্রকাশনা উৎসবে শামসুজ্জামান খান বলছিলেন, কোনো একটি বইয়ের ১০০তম মুদ্রণ অন্য রকম গৌরবের। তাঁর ভাবনায় আজাদের মা ছিলেন একজন আদর্শিক চিন্তাচেতনার গভীরতম বাঙালি। তিনি ধার্মিক ছিলেন। নামাজ পড়তেন, কোরআন শরিফ পড়তেন। সন্তানের প্রতি তাঁর ছিল অসাধারণ ভালোবাসা। একমাত্র পুত্র বলে ভালোবাসাটা অনেক বেশি। সেই মাকে রূপান্তর করতে লেখক যে জায়গায় গেছেন, তা অসাধারণ।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলছিলেন, জাহানারা ইমাম যেমন আমাদের সবার মা, সামাজিকভাবে আন্দোলন-সংগ্রামের মা, তেমনি আনিসুল হকের “মা” উপন্যাসের আজাদের মা সবার মা হয়ে উঠেছেন। সামগ্রিকভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে উপন্যাসটি।

এমন একটি অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে চেয়েছিলাম। সে ইচ্ছা পূরণ হলো। যে কারও জন্য এ ধরনের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা দারুণ আনন্দ ও সৌভাগ্যের। যতকাল পৃথিবী থাকবে, ততকাল আনিসুল হকের ‘মা’-এর মতো উপন্যাস টিকে থাকবে বলে আশা করি। অনন্তকাল এ দেশের মানুষ বলে যেতে পারবে, বাংলাদেশ ও বাঙালির একটা ‘মা’ আছে।

এ উপন্যাস নিয়ে জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘যখন ছোট ছিলাম, আমরা ম্যাক্সিম গোর্কির “মা” পড়েছিলাম। এখন আমাদের কত আনন্দ, কত গৌরব! এখন আমরা বলতে পারি, আমাদের বাংলাদেশের, আমাদের বাঙালিদের একটা “মা” আছে, সেটি আনিসুল হকের লেখা।’

২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে উপন্যাসটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, সম্ভবত এর কিছুদিনের মধ্যেই পড়ে ফেলি। প্রথমবার পড়েই দারুণ অভিভূত হই। সত্যি বলতে কি, একেবারে তন্ময় হয়ে যাই। উপন্যাসটি এখন বাংলাদেশে বহুল আলোচিত ও ব্যাপক জনপ্রিয়। তবে সে সময় এতটা ছিল না। কিন্তু আমি প্রথমবার পড়েই উপন্যাসটির মধ্যে হারিয়ে যাই। কারণ, এর কাহিনি এতটাই জীবনঘনিষ্ঠ ও মর্মস্পর্শী যে যেকোনো কঠিন মানুষও পড়তে গেলে কেঁদে ফেলবে বলে মনে করি।

উপন্যাসটি আমার ভালো লাগার আরও দুটো বিশেষ কারণ হলো, আমার বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তখন আমরা খুব ছোট। একদিন মা খবর পেলেন বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। যদিও ওই খবরটি ছিল ভুল। তবে সেদিন ছোট ছেলেমেয়েদের বুকে জড়িয়ে অনেক কেঁদেছিলেন আমার মা। আর যুদ্ধে আমার নানি তাঁর বড় সন্তান হারিয়ে প্রায় পাগল হয়েছিলেন। বিজয়ের মাত্র কয়েক দিন আগে নিহত হয়েছিলেন আমার এক ভাই। তাই উপন্যাসটি পড়তে গেলে স্মৃতিতে ভেসে ওঠে আমার মায়ের কান্না, নানির অসহায় চাহনি। নতুন করে আবার জেগে ওঠে ভাই হারানোর বেদনা।

আরেকটি কারণ হলো, আনিসুল হক উপন্যাসে যেসব কথা বলেছেন, তার কিছু ঘটনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা। আনিসুল হক উপন্যাসে আজাদদের বাড়ির একটা সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। বাড়িতে একটা একতলা প্রাসাদ আছে। ফোয়ারা আছে। ময়ূর আছে। সিনেমার শুটিং হয়।

আশির দশকের শেষ দিকে প্রায় প্রতিদিন বিকেলে এ বাড়িতে সময় কাটাতাম। এখানের মনোরম প্রাসাদটি দেখেছি। ফোয়ারা দেখেছি। ‘প্রতিরোধ’ সিনেমার শুটিং দেখেছি। শুধু ময়ূর দেখিনি। আনিসুল হক আজাদের যে সৎমায়ের কথা বলেছেন, সেই সৎমায়ের সঙ্গেও আমার অনেকবার কথা হয়েছে। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী একজন নারী ছিলেন। বাবু নামে তাঁর একটি সন্তান ছিল। সে-ও আমার বন্ধু ছিল। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এ বাড়িতে ‘কুইন্স গার্ডেন’ নামে একটি কমিউনিটি সেন্টার হয়। আমার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল এই কমিউনিটি সেন্টারেই।

২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে উপন্যাসটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, সম্ভবত এর কিছুদিনের মধ্যেই পড়ে ফেলি। প্রথমবার পড়েই দারুণ অভিভূত হই। সত্যি বলতে কি, একেবারে তন্ময় হয়ে যাই। উপন্যাসটি এখন বাংলাদেশে বহুল আলোচিত ও ব্যাপক জনপ্রিয়। তবে সে সময় এতটা ছিল না। কিন্তু আমি প্রথমবার পড়েই উপন্যাসটির মধ্যে হারিয়ে যাই। কারণ, এর কাহিনি এতটাই জীবনঘনিষ্ঠ ও মর্মস্পর্শী যে যেকোনো কঠিন মানুষও পড়তে গেলে কেঁদে ফেলবে বলে মনে করি।

এসব কারণে শুধু একবার নয়, কয়েকবার উপন্যাসটি পড়েছি। এ উপন্যাসের প্রতিটি বাক্য, শব্দ জীবনে যেন অনিবার্য হয়ে আছে। প্রথমেই প্রচ্ছদে লেখা ‘মা’ শব্দটাতেই চোখ আটকে যায়। বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় এক অন্য রকম টান অনুভব করি।
উপন্যাসটি এখন আর আনিসুল হকের একার নয়। এটি এ দেশের কোটি কোটি মানুষের। এমন একটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আছে, সে জন্য আমরা গর্ব ও অহংকার করতে পারি। মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফকে ধন্যবাদ যে তিনি অসাধারণ একটি উপন্যাসের সন্ধান লেখককে দিয়েছিলেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে’।

‘মা’ উপন্যাস নিয়ে লেখক আনিসুল হক খুব সহজেই বলেছেন, ‘“মা” উপন্যাসের ১০০তম মুদ্রণ বা বিশেষ সংস্করণ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বইটি শহীদ আজাদ বুকের রক্ত দিয়ে লিখেছেন। তাঁর মা অশ্রু দিয়ে লিখেছেন। আমি শুধু মাধ্যম হিসেবে প্রকাশ করেছি।’ এটি একটি বাস্তবধর্মী উপন্যাস। এ উপন্যাস হলো একজন মায়ের পরম মমতা ও দেশের প্রতি চূড়ান্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এর সঙ্গে লেখকের কল্পনাশক্তি ও কলমের জাদু যুক্ত হয়ে পাঠকের কাছে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে অনন্য। উপন্যাসের চরিত্র অবিকল জীবন নয়। কিন্তু তারা কখনো কখনো জীবনের মতো হয়ে ওঠে। এই উপন্যাসের মূল চরিত্রেরা যেন সর্বক্ষণ পাঠকের সঙ্গে কথা বলে।

এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র দুজন মা। আজাদের মা সাফিয়া বেগম, যিনি আদর্শে, ব্যক্তিত্বে ও আত্মমর্যাদায় গড়া এক অসাধারণ মা। আরেকজন দেশ মা, যাঁরা তাঁদের শ্রেষ্ঠ সন্তান উৎসর্গ করেছেন। সন্তানটির নাম ‘আজাদ’। এই ত্যাগের মাধ্যমে দুই মা-ই গৌরব অর্জন করেছেন। আর এই দুই মাকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের পরিণতি।

আজাদের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার মা অভিমানে প্রাসাদ ছেড়ে নেমে আসেন অতি সাধারণ জীবনে। আজাদের বাবা অনেক চেষ্টা করেও আজাদের মাকে আর ঘরে ফেরাতে পারেননি। এই মা-ও অভিমান ভেঙে আর কোনো দিন পুরোনো প্রাসাদে ফেরেননি।

দেশ তখন উত্তাল। সবখানে মিটিং-মিছিল। ঘর থেকে রাস্তায় পা দিলেই মিছিলের অংশ হওয়া যায়। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের চরম শোষণ-নিপীড়ন। আজাদ আর ঘরে থাকতে পারেন না। মায়ের অনুমতি নিয়ে যুদ্ধে যান। বন্ধুদের সঙ্গে আরবান গেরিলাদলে যোগ দেন। তারা বেশ কিছু রোমাঞ্চকর সফল অভিযানও করে। কিন্তু একাত্তরের ৩০ আগস্ট আজাদের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। আজাদ ধরা পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে। শিকার হয় ভয়াবহ নির্যাতনের। একদিন আজাদ তার মাকে বলেন, ‘মা, সবার কথা বলে দিলে ছেড়ে দেবে।’ মা বললেন, ‘বাবা, তুমি একটু শক্ত থাকো। কারও কথা বলো না।’ আজাদ তার মাকে বলেছিলেন, ‘মা, অনেক দিন ভাত খাই না।’ আজাদের মা ছেলের জন্য ভাত, মুরগির মাংস, আলুভর্তা, বেগুনভাজি রান্না করে নিয়ে যান। কিন্তু আজাদকে আর কোথাও পাননি।

দেশ স্বাধীন হয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ফিরে আসে। আজাদ আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। ১৯৮৫ সালের ৩০ আগস্ট আজাদের মা চলে যান না ফেরার দেশে। কিন্তু তিনি যে ১৪ বছর বেঁচে ছিলেন, কোনো দিন ভাত খাননি। বিছানায় শোননি। আজাদ নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁর জীবনে আর কোনো স্বপ্ন ছিল না। শুধু একটাই ইচ্ছে ছিল, তাঁর কবরের এপিটাফে যেন লেখা হয়, ‘শহীদ আজাদের মা।’

এই মা এখন আর আজাদের একার মা নন। তিনি এ দেশের কোটি বাঙালির মা। একজন অনন্য মা হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন এ দেশের মানুষের হৃদয়ে।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]