
অক্টোবর বিপ্লব তাৎক্ষণিকভাবে কী প্রভাব রেখেছিল বাংলার মানুষের মধ্যে? সেকালের পত্রপত্রিকা ও বিভিন্নজনের স্মৃতিকথা-আত্মজীবনী খুঁজে সেটি দেখার চেষ্টা করেছেন মুহিত হাসান
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার আগে থেকেই বাঙালি সমাজে সাম্যবাদ ও রাশিয়া ভূখণ্ডের প্রতি আগ্রহের একটি ক্ষীণ ধারা লক্ষ করা গিয়েছিল। ১৮৬৪ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংঘ গঠিত হওয়ার পর ১৮৭১ সালে তাদের কাছে এক অজ্ঞাত কলকাতাবাসী সেখানে একটি শাখা খোলার আবেদন জানিয়ে পত্র লিখেছিলেন বলে জানিয়েছেন চিন্মোহন সেহানবীশ। (সূত্র: শিপ্রা সরকার ও অনমিত্র দাশ সংকলিত বাঙালির সাম্যবাদচর্চা, পৃ. ১৪) এর পাঁচ বছর পর ১৮৭৬ সালে মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর একটি বঙ্গানুবাদও (অনুবাদকের নামবিহীন) প্রকাশিত হয়। কিন্তু রাশিয়ায় শ্রমিক-জনতার সফল ও ‘দুনিয়াকাঁপানো’ অক্টোবর বিপ্লবের কারণে অবিভক্ত বাংলায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন বিষয়ে সচেতন বাঙালি জনগণের মনোযোগ ও আকর্ষণ যে দৃশ্যনীয় হারে বৃদ্ধি পায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য সেই মনোযোগের প্রতিচ্ছবি তখনকার স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের অন্তরালে অনেকটাই ঢাকা, তবু সেকালের পত্রপত্রিকা ও স্মৃতিকথা-আত্মজীবনী ঘেঁটে সেই মানসিক আলোড়নের চালচিত্র কিছুটা উদ্ধার করা সম্ভব।
প্রবাসী পত্রিকায় ১৯১৭ সালেই অক্টোবর বিপ্লব ও ভারতবর্ষে এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে একটি মন্তব্যধর্মী নিবন্ধ লিখেছিলেন স্বয়ং সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ‘রাশিয়ায় সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমাদের আনন্দ’ শিরোনামের ওই রচনার গোড়ায় তিনি রুশ বিপ্লবের প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বলতা প্রকাশ করলেও পরক্ষণেই আবার টিপ্পনী কেটেছিলেন এই বলে, ‘ভারতবর্ষে চীন বা রাশিয়ার মতো বিপ্লব হইতে পারে না, এবং কেহ তাহা ঘটাইবার চেষ্টা করিলে তাহা ব্যর্থ হইবে।’ অক্টোবর বিপ্লব পরাধীন বাঙালি মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে কি না, এই নিয়ে সম্ভবত তখনো প্রাতিষ্ঠানিকতাবদ্ধ রামানন্দের সংশয় ছিল। কিন্তু এই প্রবাসীর পাতাতেই ঠিক পরের বছর, ১৯১৮-তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সমবায়’ নামে তিন পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, তাতে পরোক্ষে হলেও সাম্যবাদী ভাবনার আঁচ টের পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের মনে সম্ভবত তখনই রাশিয়া ও অক্টোবর বিপ্লবের কারণে ঘটে যাওয়া সামাজিক-রাজনৈতিক পরির্বতন নিয়ে আগ্রহ-মমত্বের সূত্রপাত ঘটে। রাশিয়া ভ্রমণের ১০ বছর আগেই ১৯২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে বসে সি এফ এন্ড্রুজকে লেখা এক চিঠিতে তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন অপপ্রচার নিয়ে নিজের শঙ্কা ও ঘৃণার কথা ব্যক্ত করেছিলেন: ‘[এখানে] রাশিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চলছে। জনমনের চোরাবালির উপর এরা মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে রাজনৈতিক সভ্যতার বিরাট সৌধ গড়ে তুলতে চায়।...’ ১৯২৩ সালে সংহতি সাময়িকীর জন্য রচিত একটি প্রবন্ধেও অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত প্রতিষ্ঠা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ইতিবাচক আশাবাদ নজরে পড়ে। অন্যদিকে সেই সময়ের তরুণ কবি ‘হাবিলদার’ কাজী নজরুল ইসলাম তখন করাচির সেনা ব্যারাকে। তাঁর ‘ব্যথার দান’ গল্পে দেখা মেলে রাশিয়ার লাল ফৌজে যোগ দেওয়া দুই বাঙালির। অক্টোবর বিপ্লব সম্পর্কে পল্টনে থাকাকালীন সময়েই নজরুল উচ্ছ্বাস-আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন—এমন বয়ান পাওয়া যায় তাঁর সৈনিক-সহকর্মী শম্ভুনাথ রায়ের লেখাতেও।
অক্টোবর বিপ্লব ঠিক কতটা সফল হবে জনগণের মধ্যে, তা নিয়ে আবার সংশয় ছিল বাঙালি বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের: ‘মনের এক কোণে এ সন্দেহও রহিয়া যায় যে, আইন-কানুন বিধিব্যবস্থা গড়িয়া সেই বন্ধনের নাগপাশে মানুষকে খুব জোরে বাঁধিয়া রাখিতে পারিলেই কি মানুষ শিষ্ট, শান্ত, ভদ্র হইয়া উঠিবে?...মানুষের ভিতর যদি প্রেম স্ফূর্ত না হয়, তাহা হইলে বাহিরের দ্রব্যসম্ভারের প্রাচুর্যই কি তাহাকে স্বার্থান্বেষণ বা পরস্বাপহরণ হইতে বিরত করিয়া রাখিবে?’ (নারায়ণ, আষাঢ় ১৩২৭)
ছাত্রাবস্থায় অক্টোবর বিপ্লবের বিষয়ে মনোযোগী হয়েছিলেন ঢাকার ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব আবুল হুসেন। ১৯২১ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধ ‘বাংলার বলশি’। বলশেভিক বিপ্লব ও সোভিয়েত কৃষিব্যবস্থার প্রতি তাঁর যুক্তিপূর্ণ পক্ষপাত এখানে লক্ষণীয়। পাশাপাশি তাঁর মন্তব্য, একদিন এ ভূখণ্ডেও কৃষকের বিপ্লব আসতে বাধ্য, বাংলার জমিদারদের তা মনে রাখতে হবে: ‘এখন যতই তুমি তোমার পুরনো গতিতে চলবে ততই সেদিন নিকট করে তুলবে যেদিন বাংলার বুকে বলশির বিপ্লব নিদারুণ হয়ে প্রতি পল্লির অশান্তির কলরোলে মুখরিত করে তুলবে।’ ‘কৃষকের দুর্দশা’, ‘কৃষকের আর্তনাদ’ ও ‘কৃষি বিপ্লবের সূচনা’ শিরোনামে আবুল হুসেন সমধর্মী আরও তিনটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। সাম্যবাদী উদ্দীপনাসংবলিত এই প্রবন্ধগুচ্ছ পরে বাংলার বলশি নামে একটি বইয়ে আলাদাভাবে সংকলিত হয়। এটি তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থও বটে।
পূর্ববঙ্গের আরেকজন মেধাবী অথচ প্রায় অপরিচিত ব্যক্তিত্বকে অক্টোবর বিপ্লব (পুরোনো পঞ্জিকায় ২৫ অক্টোবর, নতুন পঞ্জিকা অনুযায়ী ৭ নভেম্বর) আলোড়িত করেছিল প্রচণ্ডভাবে। তিনি গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী। বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে জন্ম নেওয়া এই বাঙালি বিপ্লবী ১৯১৭ সালে ছিলেন লন্ডনে। তখন তিনি বয়সে তরুণ, বিপ্লবের সমর্থনে লন্ডনের পথে-ঘাটে বক্তব্য দিতেন। এ সময় নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানা রকম আক্রমণের বিরুদ্ধে তিনি প্রচারও চালিয়েছেন সমানে। সাম্যবাদ ও ভারতের স্বাধীনতার সপক্ষে লুহানী এই সময়ের পর থেকেই নিয়মিত লিখতে থাকেন ইউরোপের বিভিন্ন পত্রিকায়। ১৯২১ সালের মে মাসে আরও কয়েকজন ইউরোপীয় বিপ্লবীর সঙ্গে মস্কোতে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যোগ দিতে যান লুহানী। পরে প্যারিসে বসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র দ্য মাসেস অব ইন্ডিয়া সম্পাদনাও করেছেন। ১৯২৫ সালে তিনি ‘ব্রিটিশবিরোধী তৎপরতায় ব্যস্ত’ এমন অভিযোগ তুলে তাঁর ফ্রান্সে থাকার অনুমতিপত্র বাতিল করা হয়। পরে ওই বছরের নভেম্বরে তিনি চলে যান মস্কো। সেখানেও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সপক্ষে নানা কর্মকাণ্ড ও একাধিক সোভিয়েত সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু লুহানীকেও শেষমেশ প্রাণ হারাতে হয় স্তালিনের স্বৈরশাসনের খপ্পরে পড়ে। ‘অজানা’ অভিযোগে ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। ‘মৃত্যুদণ্ড’ হিসেবে গুলি করে হত্যা করা হয় ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। যিনি অক্টোবর বিপ্লবের আলোয় আলোড়িত হয়ে সুদূর মস্কো পাড়ি দিয়েছিলেন জীবনের তাবৎ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে, তাঁকেই কিনা অবশেষে নৃশংসভাবে খুন হতে হলো সেই বিপ্লবের স্বভূমিতে এসে! (সূত্র: ‘স্তালিনের নৃশংসতার শিকার এক বাঙালি বিপ্লবী’, মতিউর রহমান, প্রথম আলো ঈদসংখ্যা ২০০৩)
দুই
বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের লেখাজোখায় অক্টোবর বিপ্লবের তাৎক্ষণিক প্রভাবের খণ্ডচিত্র কিঞ্চিৎ স্পষ্টরূপে তুলে ধরা সম্ভব হলেও সাধারণ বাঙালি সমাজে তা ঠিক কী রকম সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব ফেলেছিল বা এই অঞ্চলের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে কীভাবে তা সহায়ক হয়েছিল, সেটি নিরূপণ করা সহজ নয়। গত শতকের প্রথম ভাগে যাঁদের কৈশোর ও তারুণ্য কেটেছে, তাঁদের স্মৃতিকথা-আত্মজীবনী এ ক্ষেত্রে কিছুটা কাজে আসতে পারে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা মণি সিংহের আত্মজীবনী জীবন সংগ্রাম-এ অক্টোবর বিপ্লব কীরূপে তাঁর সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গি সংগঠনে ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার বাঁকবদলে ভূমিকা রেখেছিল, তার চমৎকার অথচ নিরাবেগ বর্ণনা রয়েছে। উল্লেখ্য, তিনি আগে অনুশীলন বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হলেও তাঁদের নীতি-আদর্শ পূর্ণরূপে কখনোই মেনে নিতে পারেননি। ফলে গণমানুষের মুক্তির জন্য কাজ করার ক্ষেত্র হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিকে তিনি বেছে নেন পরে, কার্যত অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাবেই। তাঁর সহজ স্বীকারোক্তি, জীবনের প্রারম্ভেই অক্টোবর বিপ্লব তাঁকে সর্বদা সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটতে উৎসাহিত করে: ‘আমি তখন কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা দিয়েছি। সেই সময়েই বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনাটি ঘটে। তা হচ্ছে ১৯১৭ সালের ২৫শে অক্টোবরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।...এই বিপ্লব যে শুধু রাশিয়ার শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের মুক্তি আনল তা-ই নয়, এই মহান বিপ্লব দুনিয়ার সমস্ত নিপীড়িত বঞ্চিত ও পরাধীন জাতির মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত করে দিল। অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও এই বিপ্লব রেখাপাত করে।’
মার্ক্সবাদী চিন্তক-প্রাবন্ধিক রণেশ দাশগুপ্তর কাছে অক্টোবর বিপ্লব ঠিক তাৎক্ষণিকের আবেগে ধরা দেয়নি; কারণ, তখন তাঁর নেহাতই শৈশবকাল। স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ কখনো চম্পা কখনো অতসীতে তিনি জানাচ্ছেন: ‘এ বিপ্লব নিয়ে তেমন কেউ আলোচনাও করেনি বোধ হয়।’ অবশ্য বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে এসে বিপ্লবের ধারণা তাঁর কাছে যখন সুস্পষ্ট হলো, তখন ‘চারদিকে বিগত চার বছরের ঘটনা নিয়ে আলোচনার তোলপাড়।’
রাজনৈতিকভাবে সচেতন তরুণদের বলয়ের বাইরেও যে অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব ছায়া ফেলছিল, সে সম্পর্কে একটি অভিনব ভাষ্য পাওয়া যায় মুজফ্ফর আহমদের রচনায়। ১৯২০ সালে তিনি ও কাজী নজরুল ইসলাম যৌথ সম্পাদনায় সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ-এর প্রকাশনা আরম্ভ করেন। সে সময় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন—মুজফ্ফরের এক এমন বন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, ‘বাঙলা কাগজগুলি বড্ড বেশি ভাবপ্রবণ হয়। আপনারা সাধারণ মানুষের সম্বন্ধে, বিশেষ করে মজুর ও কৃষকদের সম্বন্ধে কিছু কিছু লিখবেন।’ মুজফ্ফর আহমদের তখন মনে হয়েছিল, ‘এটা তার ওপরে রুশ বিপ্লবের প্রভাব ছাড়া আর কী হতে পারে?’ (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম যুগ, পৃ. ৬)
অর্থনীতিবিদ-প্রাবন্ধিক অশোক মিত্রের ছেলেবেলা কেটেছিল বিভাগ-পূর্ব পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে। আত্মজীবনী আপিলা-চাপিলায় তিনি জানিয়েছেন অক্টোবর বিপ্লব ও বামপন্থার সঙ্গে প্রথম পরিচিত হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা: ‘আমরা স্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই সোভিয়েত বিপ্লবের কথা শুনতে শুরু করেছি। বিমল সেন নামে এক লেখক-কৃত ম্যাক্সিম গোর্কি মা উপন্যাসের সরল অনুবাদ পড়া শেষ।...কমিউনিস্ট পার্টির গোপন শাখা এ-পাড়ায় ও-পাড়ায়। সংগঠন গড়ে উঠছে বিভিন্ন কলেজে, কোনো-কোনো স্কুলে পর্যন্ত, একটু একটু করে। বারো-তেরো-চৌদ্দ বছরের আমাদের দলে ভেড়াবার জন্য...তালিম হিসেবে দাদারা রাজনৈতিক-কারণে বাজেয়াপ্ত বই থেকে অনুলিখনের নির্দেশ দিচ্ছেন।...রেবতী বর্মণের [অনূদিত] কমিউনিস্ট ইস্তেহারের হাতে-লেখা বাংলা অনুবাদও এখান-ওখান থেকে চেয়েচিন্তে এনে পড়ছি, নির্জন দ্বিপ্রহরে বা গভীর রাত্রে, গুরুজনদের দৃষ্টি এড়িয়ে।’
পূর্ব বাংলার প্রধান শহর ঢাকা ছাড়িয়ে অক্টোবর বিপ্লবের দূরবর্তী প্রভাব যে উত্তরাঞ্চলের খুদে মফস্বল শহর কুড়িগ্রামেও পড়েছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যায় প্রয়াত কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতিকথা তিন পয়সার জ্যোছনায়। কিশোর বয়সে তাঁর পরিচয় হয় বাবার চাকরিসূত্রে কুড়িগ্রামে থাকতে আসা এক কবিতা-লিখিয়ে আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। সৈয়দ হকের কিঞ্চিৎ বয়সে বড় সেই তরুণ নিজের সব কবিতা লিখতেন লাল কালিতে; কারণ, ‘রাশিয়ায় লেনিন যে বিপ্লব আনেন সেই বিপ্লবের রংটাই যে লাল!’ সৈয়দ হক আরও জানান, ওই সময় হয়তো এই নিখাদ আকর্ষণ-আবেগের কারণেই এলাকার কমিউনিস্ট পার্টির গুপ্তকর্মীর থেকে পার্টি-পুস্তিকা ও রুশ সাহিত্যের বই কিনতেন তাঁর আপাত-রক্ষণশীল পিতা সিদ্দিক হুসাইনও।
বাংলা থেকে অনেক দূরের দেশ রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের লাল ঝান্ডা ওড়ার পর তার প্রভাব এ অঞ্চলে পড়েছিল যথানিয়মে। হ্যাঁ, ভারতবর্ষ তখন ছিল ব্রিটিশরাজের অধীন। সেই পরাধীন প্রেক্ষাপটে এখানে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলো ১৯২১ সালে—১৯১৭ সালে সংঘটিত বিপ্লবের মাত্র চার বছরের মাথায়—এর পেছনে যে ক্রিয়াশীল ছিল অক্টোবর বিপ্লবের প্রণোদনা, প্রভাব ও অভিঘাত, এটি এখন না বললেও চলে।