বাঙালি, বাংলাদেশ, আনিসুজ্জামান

১৪ মে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে শ্রদ্ধা।

আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭—১৪ মে ২০২০)। প্রতিকৃতি: আরাফাত করিম

কে বাঙালি

আনিসুজ্জামানের কাছে বাঙালির ধারণাটি কী ছিল?

এ রকম সরাসরি কোনো প্রশ্নের জবাব আনিসুজ্জামানকে দিতে হয়েছে, তেমনটা চোখে পড়েনি। তবে নানা লেখায় বাঙালি সম্পর্কে তাঁর ভাবনা ও বিবেচনা ছড়িয়ে আছে। বাঙালির যাবতীয় সংস্কৃতি-সাধনার কোনো উত্তরাধিকারের ওপরই আনিসুজ্জামান নিজের দাবি কখনো ছেড়ে দেননি। ২০১৩ সালে নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে যা আছে, সবই আমার।’ আরেকটু এগিয়ে গিয়ে এ-ও বলেছিলেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্র যদি সাম্প্রদায়িক হয়ে থাকেন, তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও জরুরি, কেন তিনি সাম্প্রদায়িক হলেন? আবার বঙ্কিমচন্দ্রের প্রেরণায় যে এত মানুষ উপনিবেশবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলেন, সেটাও তো লিখতে হবে।’ ফলে এ কথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে উনিশ শতকের উপনিবেশিত কলকাতায় একটি ছোট্ট ঘেরাটোপে বাঙালি ধারণার যে উন্মেষ ঘটেছিল, সেটিকে তিনি বর্জন করেননি। সেখান থেকে নেওয়ার মতো কিছু উপাদান আছে বলে তিনি ভেবেছিলেন; পাশাপাশি এ–ও ভেবেছিলেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলার এবং পর্যালোচনা করার মতো অনেক কিছু রয়েও গেছে। তাই আনিসুজ্জামানের উক্তিটিকে অসতর্কভাবে তাঁর লেখালেখির প্রেক্ষাপট হিসেবে গ্রহণ করলে চটজলদি একটি সরল উপসংহারে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। সে উপসংহার শুধু সরলই হবে না, অনেকটা পরিমাণে বিভ্রান্তিকরও হয়ে উঠবে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে ওই কথাগুলোর পর একই সাক্ষাৎকারে আনিসুজ্জামান আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে প্রবন্ধ লেখার পরই আমার মনে হলো, মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা স্বাতন্ত্র্যবাদী, তাঁদের চেতনার বিকাশের ধরন নিয়ে লিখতে হবে।’ এটি লক্ষ করার মতো বিষয় বটে যে অল্প বয়সে করা তাঁর বহুল উদ্ধৃত পিএইচডি থিসিসটির বিষয় ছিল—ইতিহাসের পথরেখা ধরে বাঙালি মুসলমানের বিবর্তনধর্মী মন। এরপর সারা জীবনব্যাপী আনিসুজ্জামানের লেখালেখির বড় অংশ দখল করে রইল বাঙালি মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গের সমাজ ও সংস্কৃতি। তাঁর ভাবনা ও কর্মে ‘বাঙালি’ ধারণাটির নানা স্রোত বিনুনির মতো পরস্পরিত হয়ে বয়ে যেতে দেখা যায়। কখনো তারা মিশেছে, কখনো বিপরীত ভাব সমান্তরালে প্রবাহিতও হয়েছে।

অতীত ভারত সম্পর্কে লিখতে গিয়ে—বাংলাও বিশেষভাবে যার বাইরে নয়—কার্ল মার্ক্সসহ পশ্চিমা তাত্ত্বিকেরা এর সামন্ত বৈশিষ্ট্য, ভূমিমালিকানার ধরন এবং গ্রামীণ ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করে একে নিস্পন্দ ও নিস্তরঙ্গ এক জনপদ হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। যেন সময় বয়ে চলেছে, কিন্তু বাংলাসহ এই বিপুল জনপদ থেকে যাচ্ছে ইতিহাসের অভিঘাতের বাইরে। এই ধারণার বোধ করি সবচেয়ে করুণ শিকার হয়েছে ‘বাঙালি মুসলমান’ নামের বর্গটি। বাঙালির বৃহত্তর তত্ত্বজগতে এমন একটি ধারণা আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে বসেছিল এবং এখনো আছে যে বাঙালি মুসলমানের মানসে দীর্ঘদিন ইতিহাসের কোনো আঁচড় পড়েনি। এটিই তার ভগ্নদশার মূল পশ্চাৎপট। আহমদ ছফার প্রভাবশালী প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’–এর অসতর্ক পাঠ সে ধারণাটিকে দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। আনিসুজ্জামানের তরুণ বয়সে করা পিএইচডি থিসিসটির তর্ক সেই মূল ধারণার একেবারেই বিপরীত।

তাঁর বহুল উদ্ধৃত পিএইচডি থিসিসটির বিষয় ছিল—ইতিহাসের পথরেখা ধরে বাঙালি মুসলমানের বিবর্তনধর্মী মন। এরপর সারা জীবনব্যাপী আনিসুজ্জামানের লেখালেখির বড় অংশ দখল করে রইল বাঙালি মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গের সমাজ ও সংস্কৃতি। তাঁর ভাবনা ও কর্মে ‘বাঙালি’ ধারণাটির নানা স্রোত বিনুনির মতো পরস্পরিত হয়ে বয়ে যেতে দেখা যায়।

সেখানেই শেষ নয়।

আনিসুজ্জামান গ্রন্থাগারের নিভৃত কোণে তাঁর জীবন পার করেননি। তাঁর এক বিপুল কর্মজীবন ছিল। সেই ১৯৫২ সালে, যখন তিনি এক সদ্য কলেজছাত্র, জড়িয়ে পড়েছিলেন ভাষা আন্দোলনে। পূর্ববঙ্গের বাঙালির উত্থান-পতন ও বন্ধুর ইতিহাসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেই যে রাজপথের কলরবে এসে তিনি যোগ দিতে শুরু করেছিলেন, আমৃত্যু আর তার অবসান ঘটেনি।

আনিসুজ্জামানের অধ্যাপনা, গবেষণা আর সামাজিক কর্মের জগৎ একাকার হয়ে গেল। এই তিন জগতের বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। মনের যে ভারসাম্য তিনি অর্জন করেছিলেন, তাতে মতের পার্থক্য তাঁর জন্য কখনোই কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অন্তরায় হয়ে ওঠেনি। তিনি শুধু তাঁদের সঙ্গে মেশেনইনি, অবিরলভাবে সেই মানুষদের অনেকের সম্পর্কে লিখে গেছেন। কারণ, তাঁদের মধ্যে দেখতে পেয়েছেন পূর্ববঙ্গের সমাজের কোনো উজ্জ্বল উত্থানরেখা।

মানুষকে দেখার ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পাল্টে গিয়েছিল শিকাগোতে, অধ্যাপক লয়েড রুডল্‌ফের সংস্পর্শে। উনিশ শতকের কলকাতার হিন্দু সংরক্ষরণবাদী রাধাকান্ত দেব সম্পর্কে আনিসুজ্জামান একবার মন্তব্য করে বলেছিলেন, তিনি রক্ষণশীল। তাঁর সে মন্তব্য শুনে লয়েড রুডল্‌ফ্ বলেছিলেন, ‘রাধাকান্ত দেবকে তুমি রক্ষণশীল লেবেল এঁটে দিচ্ছ কেন? মেয়েদের শিক্ষার জন্য তো তিনি বহু কিছু করতেন। তাঁর দুটো দিকই কি দেখা উচিত নয়?’ আনিসুজ্জামানের চোখ খুলে যায়। তিনি উপলব্ধি করেন, কেবলই একটি নিরিখে কোনো মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিচার করা চলে না।

এই মুক্ত দৃষ্টির কারণে আনিসুজ্জামান সমান মমতায় লিখতে পেরেছেন জসীমউদ্‌দীন, মওলানা আকরম খাঁ, কমরেড মণি সিংহ, মনিরউদ্দীন ইউসুফ কিংবা আবু হেনা মোস্তফা কামালের মতো বিচিত্র মত ও পথের মানুষ সম্পর্কে। তিনি তাঁদের ব্যক্তি হিসেবে যেমন দেখেছেন; একই সঙ্গে একটি সময়পটে তাঁদের সামাজিক মাত্রাও বুঝে নিতে চেয়েছেন।

নানা বর্ণ ও মাত্রার ব্যক্তিদের নিয়ে এত লেখা আনিসুজ্জামানের মতো আর কেউ লিখেছেন কি না সন্দেহ। ব্যক্তির স্মৃতি ও মূল্যায়ননির্ভর এ ধরনের লেখা সংকলিত করে তাঁর বইও বেরিয়েছে একাধিক—পূর্বগামী (শিখা প্রকাশনী, ২০০৯), চেনা মানুষের মুখ (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩), স্মরণ ও বরণ (চন্দ্রাবতী একাডেমি, ২০১৮), স্মৃতির মানুষ (প্রথমা প্রকাশন, ২০২১)। তাঁর অন্য কিছু বইয়ের মধ্যেও আরও নানাজনকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিধর্মী রচনা ছড়িয়ে আছে।

এসব লেখায় এই ব্যক্তিদের মধ্য দিয়ে আমরা একটি সময়ে বাংলাদেশের সামাজিক পরিসর গড়ে ওঠার সজীব ছবি দেখতে পাই। কিন্তু সেখানেই বিষয়টির শেষ নয়। এসব লেখার বড় অংশে বাংলাদেশের উদীয়মান সমাজে বাঙালি মুসলমানকে প্রবলভাবে ব্যক্ত করার চিহ্নও দেখতে পাই। উনিশ শতকে রচিত বাঙালি ধারণার এ এক অঙ্গাঙ্গি ও সম্পূরক অংশ। আনিসুজ্জামান যেন বলতে চাইছেন, এই দুইয়ে মিলে তবেই বাঙালির ধারণাটি সম্পূর্ণ হয়।

ভবিষ্যতের গবেষকদের সম্ভবত এখানে উঁকি দিয়ে দেখার জায়গা আছে।

ইতিহাসের দায়

আনিসুজ্জামানের পিএইচডি গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)’। শিরোনামই বলে দিচ্ছে, সাহিত্য তাঁর গবেষণার উপাদান হলেও রসবস্তু তাঁর অন্বেষণের বিষয় ছিল না। তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন, ইংরেজের আবির্ভাবের পর নতুন সেই পরিস্থিতির আঘাতে বাঙালি মুসলমানের মানস-জগতের প্রতিসরণ কীভাবে ঘটছে। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে পৌঁছুতে চাইছিলেন একটি সুনির্দিষ্ট ইতিহাসখণ্ডের সমাজ-মনস্তত্ত্বে।

আনিসুজ্জামানের এই গবেষণার শুরু ১৯৫৮ সালে। তাঁর বয়স তখন মাত্র একুশ। এর ছয় বছর আগে, ১৯৫২ সালে, ভাষার দাবির প্রবল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের বাঙালি তাদের নতুন ইতিহাস রচনার স্বপ্নের সূচনা করেছে। সেই নতুন ইতিহাসের উন্মেষলগ্নে যে আনিসুজ্জামান উপনিবেশপর্বে এই জনগোষ্ঠীর উত্থান-পতনময় মননরেখা রচনায় মগ্ন হলেন, সেটি নিছক কাকতাল নয়। সাহিত্যের প্রবেশতোরণ দিয়ে ঢুকে তিনি সমাজ-ইতিহাসের প্রসারিত আঙিনায় এসে দাঁড়ালেন।

এ নিয়ে আনিসুজ্জামানের নিজের মধ্যে একটি বোঝাপড়া ছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বাংলা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, সাহিত্যকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পড়া যাবে না। এই পটভূমিতেই ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। পরবর্তীকালে আমার সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-এর বিষয়ে অনেকে বলেন, আমি নির্ধারিত ক্ষেত্রের বাইরে চলে গেছি। আমি তা মনে করি না। যে-সমাজ থেকে সাহিত্য তৈরি হচ্ছে, সেই একই সমাজে তো ধর্মান্দোলন হচ্ছে, অর্থনৈতিক জীবনও চালিত হচ্ছে। এগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে দেখার ঝোঁক আমার মধ্যে সব সময়ে কাজ করেছে।’

আনিসুজ্জামানের লেখার বিষয় ছড়িয়ে পড়ল—সাহিত্য থেকে সমাজ-সংস্কৃতির জগতে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ধাবমান উত্তাল সময়ে তত দিনে এসে পড়েছে ইতিহাসের দায়। সে দায়মোচনে তিনি সক্রিয়ভাবে সাড়া দিয়েছিলেন। মুক্তিকাতর সেই তপ্ত রাজনীতির পটে চলেছে আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান। শুধু গবেষণার বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার জন্য নয়, সময়ের উৎকণ্ঠাকাতর প্রশ্নগুলোর তিনি নিজের মতো করে জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সে জন্য রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ইতিহাসে তৃষ্ণার্ত পর্যটকের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত মুহুর্মুহু আন্দোলন আনিসুজ্জামানের কর্মিসত্তা ও গবেষক সত্তার পরিসর ক্রমশ প্রসারিত করে তুলেছিল। এই চর্চার মধ্য দিয়ে যে আদর্শগুলোকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বলে উপলব্ধি করেছিলেন, সেসবের মর্মবস্তু উপস্থাপন এবং সুরক্ষা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের পরে তাঁর লেখালেখির প্রিয় বিষয়।

কিংবদন্তি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মনোবেদনা ছিল, আনিসুজ্জামান গবেষণায় বেশি মনোযোগ দিলেন না বলে। আনিসুজ্জামানের নিজেরও এ নিয়ে আক্ষেপ কম ছিল না। বিপুল সামাজিক কর্তব্য তাঁর সময় কেড়ে নিয়েছিল। তবে এ-ও সত্য, এসবের মধ্যেও তিনি কম লেখেননি। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বানে, সেমিনারে, পত্রিকার উপরোধে, স্মারক বক্তৃতা দিতে গিয়ে।

তাঁর অনাড়ম্বর সংযত গদ্যের একটি আলাদা স্বাদ ছিল। লেখায় বক্তব্যের স্পষ্টতা ছিল তাঁর কাছে মুখ্য—কেউ তাঁর সঙ্গে একমত হোক বা না হোক। তাঁর এসব লেখায় পাওয়া যাবে দেশ ও মানুষকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসা একজন মানুষকে।