বিস্তীর্ণ মাঠের কারিগর মনসুর-উল-করিম

গতকাল মারা গেছেন শিল্পী মনসুর–উল–করিম। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে গত শতাব্দীর ১৯৮৯ সালে যখন ভর্তি হই, মনসুর-উল-করিম স্যারের সঙ্গে তখন দেখা। এর আগে তাঁর নাম শুনেছি, পড়েছি পত্রিকার মাধ্যমে। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর তাঁর সুন্দর বাচন, চিত্রভাবনায় দূরদর্শিতা, আমার কাছে অনুকরণীয় মনে হতো।
দীর্ঘ দেহের অধিকারী এই মানুষকে আমার ছাত্রাবস্থায় আদর্শ শিক্ষক হিসেবে মনে নিয়েছিলাম।

শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে অনুসরণ করিনি নিজের শিল্পনির্মাণে, রেখা প্রয়োগে, বর্ণ–অনুসন্ধানে। নিজের আঁকার ক্ষেত্রে কিছুদিন তাঁর রেখা অনুসরণ করেছি, শেষ পর্যন্ত আর তাতে থাকিনি।

চট্টগ্রামের চারুকলা বিভাগের শিক্ষকদের সম্পর্কে একটা কথা চালু আছে। তাঁরা শেখান—জলের সঙ্গে রং মেশালে হয় জল রং, তেলের সঙ্গে রং মেশালে হয় তেল রং। মনসুর–উল–করিম এ প্রবাদের বাইরে অবস্থান করতেন। শিক্ষক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের সময় নিয়ে শেখাতেন। বলতেন কীভাবে নিজের চিন্তার সঙ্গে ক্যানভাস-জমিনের সখ্য গড়ে ওঠে।
স্যারের বাসায় যেদিন প্রথম আমার যাওয়ার সুযোগ হয়, সেদিন থেকে তাঁর আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে আমার নিজের মধ্যে শিল্পী হওয়ার আগ্রহ বাড়তে থাকে।

মনে হতে থাকে শিল্পের মধ্যে আছে জীবনের স্ফূরণ, জয়গান। নানাভাবে নানা কাজে এরপর স্যারের সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছে। বাণিজ্যিক শিল্পকলাকে কীভাবে জনশিল্পে পরিণত করতে হয়, তার হাতেখড়ি আমার হয়েছে মনসুর–উল-করিমের কাছে, যা পরবর্তী সময়ে আমার আয়–রোজগারে সহায়ক হয়েছিল। সে সময় কাজের ক্ষেত্রে আমার বড় চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। আলাপচারিতায় রসবোধ, একই সঙ্গে সিরিয়াস অভিব্যক্তি—এতে মাঝেমধ্যে বিচলিত হলেও পরক্ষণে মনে হতো, এটা স্যারের মুখের রঙের অভিব্যক্তি। তামাটে বর্ণ দিয়ে গড়া শরীরের মধ্যে বসবাস করত বহু রঙের রেখা। আগেই বলেছি, রেখা–রঙের এই দ্যুতি আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল ছাত্রাবস্থায়ই।

নানাভাবে নানা কাজে এরপর স্যারের সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছে। বাণিজ্যিক শিল্পকলাকে কীভাবে জনশিল্পে পরিণত করতে হয়, তার হাতেখড়ি আমার হয়েছে মনসুর–উল-করিমের কাছে, যা পরবর্তী সময়ে আমার আয়–রোজগারে সহায়ক হয়েছিল। সে সময় কাজের ক্ষেত্রে আমার বড় চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছেন তিনি।

তাঁর মতো শিল্পের সঙ্গে বসবাস করে পুরো জীবন পাড়ি দেওয়া কজন শিল্পী পাওয়া যাবে এখন? শিল্পিত জীবনবোধে পুষ্ট এই মানুষ বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্মাননা। একাডেমির নিয়মতান্ত্রিক শিল্পভাষা নির্মাণের বোধ তৈরির সাথে ক্যানভাস গড়া, ফর্ম বিন্যস্ত করার খেলা—এমন অনেক কিছু শিক্ষার্থীরা শিখেছেন তাঁর কাছে।

মনসুর–উল–করিমের ছবির বিষয়ে রয়েছে মাটি। মাটির মূল থেকে উঠে আসে মানুষের কাঠামো, পরিবেশ ও প্রতিবেশ। তাই তাঁর ক্যানভাস সেজে ওঠে সোনালি ফসল, কৃষক, কৃষাণী আর প্রাণিকুলের অবয়বে। তা ছাড়া বুনোফুল, জলাশয়, জীববৈচিত্র্য প্রকাশ পায় রেখা ও রঙের প্রতীকে।

প্রতীকের মাধ্যমে বিষয় নির্মাণ করতেন এই শিল্পী। গড়ে তুলতেন নিজের ক্যানভাসের জমিন। নিজের ছবি সম্পর্কে তাঁর বয়ান, ‘পরিবেশের এই যে পাহাড়, নদী, গাছপালা—এর সবই ঘুরেফিরে আসে আমার ক্যানভাসে, প্রাকৃতিক ফর্মের আকারে।...লোকশিল্পের আঙ্গিক গঠন অধিকাংশই প্রাকৃতিক ফর্মের সাথে সাদৃশ্যময়।...সাধারণ ও তুচ্ছ আকার এবং রেখা, এ নিয়েই আমার পট।’
তাই মনসুর–উল–করিমের ছবির বোঝাপড়া নিয়ে দর্শক ও শুভানুধ্যায়ীদের মনে কোনো প্রশ্ন তৈরি হয়নি কখনো। তাঁর ছবি মানে সহজ-সরল, রেখা–রঙের দ্যুতি, আলোছায়ায় ঘেরা মায়াবী সুন্দরী প্রকৃতি হাজির হয় আমাদের সামনে।
কিন্তু অতঃপর তিনি চলেই গেলেন। মৃত্যুই যদি জীবনের শেষ অধ্যায় হয়, তাহলে জীবনের উপলব্ধি, আয়োজন শেষ হয়ে যায় কি না, সে প্রশ্ন হয়তো অমীমাংসিতই থেকে যায়। তবু জানি, শিল্পীর মৃত্যু হয় না। শিল্পীর কাজ কখনো শেষ হয় না।
তাই বুঝি শিল্পী মনসুর–উল–করিম নিজের শেষ ঠিকানা লিখে যান এভাবে—
আমার নিবাস
বুনন আর্ট স্পেস
সাং: শিমুলতলা, কাজিবাঁধা,
গ্রাম: রাইনগর, রাজবাড়ী।

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]