ব্রাত্যজনের সংগ্রামের বয়ান

একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-দিনমজুর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ। গত পঞ্চাশ বছরে লাখো তরুণ-যুবকের সে বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কাহিনির অনেকটাই লেখা হয়েছে। কিন্তু এর সমান্তরালে রয়েছে আরেকটি ইতিহাস। সেটি একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস। মার্কিন কথাসাহিত্যক ভার্জিনিয়া উলফ বলেছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো কাহিনি লেখা না হচ্ছে, ততক্ষণ যেন সে ঘটনা ঘটেইনি।’ আমাদের একাত্তরের সামাজিক ইতিহাসের ক্ষেত্রেও ঠিক একই অবস্থা।

একটা পরিবারের কর্তাব্যক্তি, বাবা, স্বামী বা ছেলে যুদ্ধে গেল, কিন্তু তারপর? পরিবারটি শত প্রতিকূলতায় সংগ্রাম করে কীভাবে মাসের পর মাস টিকে ছিল? কিংবা অবরুদ্ধ শহরে, দগ্ধ গ্রামে, শরণার্থীশিবিরের দমবন্ধ কুঠুরিতে, নদীতে নৌকায় বা জলে-জঙ্গলে কীভাবে বেঁচে ছিল তারা? তেমন কাহিনি গত পঞ্চাশ বছরে খুব বেশি লেখা হয়নি। ইতিহাসবিদ জর্জ ম্যাকলে ট্রেভেলিয়ান বলেন, ‘অর্থনৈতিক ইতিহাস আর রাজনৈতিক ইতিহাসের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন তৈরি করে সামাজিক ইতিহাস। এভাবেই সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরে রচিত হয় পূর্ণাঙ্গ স্বচ্ছ ও প্রকৃত ইতিহাস।’ সে বিবেচনায় সামাজিক ইতিহাস ছাড়া আমাদের একাত্তরের যুদ্ধকালের ইতিহাসও অসম্পূর্ণ। একাত্তরকে বুঝতে বা সঠিক মূল্যায়নে সেই ইতিহাসও জানা জরুরি।

সেই প্রাসঙ্গিক কাজটি করেছেন গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস: প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন একাত্তরের উত্তাল দিনের সমাজচিত্র। না, কোনো বীরের বীরত্বগাথা নয়, কোনো বাহিনীর কৌশলী অভিযানের বর্ণনাও নয়, এ ইতিহাস বাংলার ঘরে ঘরে সাধারণ মানুষের দিনযাপনের, প্রতিদিনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বেঁচে থাকার। শামসুর রাহমানের ভাষায়, স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য কপাল ভাঙা সাকিনা বিবির, কিংবা সিঁথির সিঁদুর মুছে যাওয়া হরিদাসীসহ ব্রাত্যজনের সংগ্রামের বয়ান।

যেমন ধরা যাক, সুসং দুর্গাপুরের জয়নাল গায়েনের কথা। উত্তাল যুদ্ধদিনে দুটো পরিবারকে ভারত সীমান্তে পৌঁছানোর দায়িত্ব নেন তিনি। সোমেশ্বরী নদীর তীর ধরে একটানা হেঁটে যাচ্ছিল ২০-২২ জনের দলটি। হঠাৎ রাতের আঁধারে এক গ্রামে তারা ধরা পড়েন রাজাকারদের হাতে। বন্দী করা হয় তাদের। কেড়ে নেওয়া হয় সব গয়না। পরদিন তাদের মিলিটারির হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রাজাকারেরা। এর মধ্যেই রাজাকারদের ঘরের দেয়ালে টাঙানো একটা সরাজ পেলেন জয়নাল গায়েন। বন্দী অবস্থায় বাদ্যযন্ত্রটা বাজিয়ে গান গাইতে লাগলেন তিনি। সরাজের হৃদয়ছোঁয়া সুর আর তাঁর গলার করুণ সুরে কী জানি কী হয়ে গেল রাজাকারদের। তাঁরাও ভাসলেন চোখের জলে। নিষ্ঠুর রাজাকারেরা সেদিন অন্য রকম হয়ে উঠলেন। ছাড়া পেল বন্দী দুটো পরিবার, ছাড়া পেলেন জয়নাল গায়েন।

কিংবা ধরুন, হানাদারদের হামলা থেকে বাঁচতে চাওয়া গাইবান্ধার ছোট্ট সালাম আর তার ছোট বোনের কথা। সেটা করতে গিয়ে পরিবার থেকে ছিটকে পড়ে তারা। অবশ্য গ্রামের মানুষ তাদের ফেলে দেননি, আশ্রয় জুটেছিল শরণার্থীশিবিরে। অনেক চড়াই-উতরাই আর হাতবদল হয়েও সালাম শেষপর্যন্ত খুঁজে পায় তার মা–বাবাকে।

কিন্তু সবার ভাগ্য তো আর সালামদের মতো নয়। তাই মাথায় টোপলা আর কোলে ছোট বোনকে নিয়ে অচেনা এক গ্রামে হারিয়ে যাওয়া নুরুন্নাহারদের কপালে জুটেছিল ভীষণ দুঃখ। অচেনা গ্রামের অচেনা বাড়িতে ঠাঁই হয় তাদের। আজও তারা খুঁজে পায়নি পরিবারকে। এমন অসংখ্য না বলা, না লেখা, প্রায় মাটিচাপা ইতিহাস উঠে এসেছে বইটিতে।

একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস: প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে

গওহার নঈম ওয়ারা

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: মার্চ ২০২১

২৪০ পৃষ্ঠা, দাম: ৪৮০ টাকা।

পাওয়া যাবে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানগুলোয়