ভুল মিছিলের ভয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ভবানীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবুবিলাস’ জানাচ্ছে, ‘ধন্য ধন্য ধার্ম্মিক ধর্ম্মাবতার ধর্ম্মপ্রবর্ত্তক দুষ্টনিবারক সৎপ্রজাপালক সদ্বিবেচক ইংরাজ কোম্পানি বাহাদুর অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা করিয়াছেন এই কলিকাতা নামক মহানগর আধুনিক কাল্পনিক বাবুদিগের পিতা কিম্বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসিয়া কোম্পানির বেতনোভূক হইয়া কিম্বা রাজের সাজের কাঠের ঘাটের মাঠের ইটের সরদারি চৌকিদারি জুয়াচুরি পোদ্দারি করিয়া অথবা কোম্পানির কাগজ কিম্বা জমিদারি ক্রয়াধীন বহুতর দিবাবসানে অধিকতর ধনাঢ্য হইয়াছেন।’
সত্যিই, একটা বড় কোনো পরিবর্তন এলে দেশে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। পলাশির যুদ্ধ জয় করে ইংরেজরা এই দেশের মানুষকে বানিয়ে ফেলল দাস। আবার দেখা যাচ্ছে, ইংরেজদের এই দেশ দখলের কারণে এই দেশেরই কিছু মানুষ ফুলে-ফেঁপে লাল। ইংরেজদের বিজয় কপাল খুলে দিল তাদের। আগে থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে দহরম-মহরমের সূত্রে কোটিপতি হতে শুরু করেছিল কলকাতার কয়েকটা পরিবার। রাজা রাজবল্লভ, মহারাজা নন্দকুমারের পুত্র রাজা গুরুদাস, মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুর, অমিচাঁদ, গভর্নর ভ্যান্সিটার্টের বেনিয়ান দেওয়ান রামচরণ, হুইলার সাহেবের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুর, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিং, ওয়ারেন হেস্টিংসের বেনিয়ান কান্তবাবু, রাজা পীতাম্বর মিত্র, মুনশী সদরউদ্দিন, বাবু বৈষ্ণবচরণ শেঠ, ‘লাগে টাকা দেবে গৌরি সেন’ কথিত গৌরি সেন কোম্পানির বেনিয়ান ও মুৎসুদ্দিগিরি করে অঢেল টাকা কামাতে শুরু করেছিলেন। এখন তাঁদের সারিতে এসে যোগ দিলেন লক্ষ্মীকান্ত ধর ওরফে নকুড় ধর, রামদুলাল দে, মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামহরি বিশ্বাস, সুখময় রায়, রামচরণ রায়। তাঁদের অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য জগৎ শেঠকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এই পর্যন্ত পড়া হতেই লামিয়া ঢোকে নিসারের ঘরে। এমন হুড়মুড় করে সে ঢোকে যে নিসার বিরক্ত হওয়ার সময়টুকুও পায় না। ঘরে ঢুকেই খলবলিয়ে ওঠে, ‘কী ব্যাপার, তোমার কোনো সাড়াশব্দ নাই ক্যান? আমি কতবার তোমাকে মোবাইলে ট্রাই করলাম, বাট তোমার রেসপন্স নাই। শেষে আমি বাধ্য হলাম চলে আসতে। বাট তুমি তো বুঝতে চাও না আমার পক্ষে ফ্রিকুয়েন্ট বাইরে আসা একটু ডিফিকাল্ট।’
অর্থাৎ লামিয়া মনে করিয়ে দিচ্ছে যে সে একজন তারকা ও সেলিব্রিটি। কোনো এক পণ্যের ফটোসুন্দরী তারকা। পত্রিকায় মাঝেমধ্যেই তার ছবি ছাপা হয়। টিভিতেও দু-একটি বিজ্ঞাপনের মডেল সে।
কিন্তু নিসার এখন গল্প করার মুডে নেই। সে সরাসরি আক্রমণ করে লামিয়াকে, ‘ভাগ্যিস তোমাদের ফটোসুন্দরী প্রতিযোগিতায় কোনো কথা বলতে হয় না। তাহলে তোমার ভাগ্যে আর পুরস্কার জুটত না।’
বড় বড় চোখ তুলে তাকায় লামিয়া, ‘ক্যান? আমার ভয়েস কি খারাপ? টিভির ভাইয়ারা তো বলে আমি নাকি গান শিখলে ফাটাফাটি হয়ে যাবে।’
‘তোমার টিভির ভাইয়ারা!’ তাচ্ছিল্যের হাসি ফোটে নিসারের ঠোঁটে, ‘আমি তোমার ভয়েসের কথা বলছি না, বলছি তোমার উচ্চারণের কথা। এত জঘন্য তোমার উচ্চারণ!’
‘ক্যান? কোন উচ্চারণটা খারাপ?’
‘বুঝতে পারলে কি আর লোকের সামনে এত নির্লজ্জভাবে স্টাইল করে ভুল উচ্চারণ করতে!’
‘কোনটা ভুল করেছি বলবে তো!’
‘র-এর উচ্চারণ করার সময় জিবটাকে রসে ভিজিয়ে ঢ় উচ্চারণ করো।’
‘তাই? কিন্তু আমরা অলমোস্ট সব্বাই তো এভাবেই কথা বলি।’
‘সবাই বললেই যে ভুলটা শুদ্ধ হয়ে গেল তা তো নয়। আর কথার মাঝখানে বারবার ইংরেজি শব্দ ঢোকানোর দরকারটা কী? তারপরে আছে বিরক্তিকর ন্যাকা ন্যাকা ভঙ্গি।’
রাগে না লামিয়া। উল্টো খিলখিল করে হেসে বলে, ‘তুমি বুঝতে পারোনি পণ্ডিতমশাই, এটি ন্যাকা ভঙ্গি নয়। এটি হচ্ছে সেক্সি ভঙ্গি।’
‘যার-তার সাথে কথা বলার সময়েও সেক্সি ভঙ্গি আনতে হবে? বাপ-চাচার সঙ্গেও?’
এই কথায় থতমত খেয়ে যায় লামিয়া। বলে, ‘আসলে বোঝোই তো, এখন গ্লোবালাইজেশনের পিরিয়ড। অ্যাপিলিং না হলে কি চলে?’
এমন নির্লজ্জ কথাগুলো এমন স্বাভাবিকভাবে বলতে শুনলে কার আর মাথা ঠিক থাকে। রাগের চোখে গালি বেরিয়ে আসে নিসারের মুখ থেকে, ‘পারভার্ট!’
‘তা বললে তো আমাদের জেনারেশনের সবাইকে বলতে হয়।’
‘না। সবাই নয়।’
‘সবাই না হলেও অলমোস্ট সবাই। অন্তত ঢাকা সিটির...’
রেগে ওঠে নিসার, ‘ঢাকা সিটির কতটুকু জানো তুমি? তোমার টিভি স্টুডিওগুলোই কি ঢাকা সিটি?’
কাছে এসে নিসারের চুলের মধ্যে আঙুল ঢোকানোর চেষ্টা করে লামিয়া। নিসার মাথা সরিয়ে নিলেও উজ্জ্বল চোখে হাসে লামিয়া, ‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা! এখন থেকে আমি তোমার কথামতো ঠিক উচ্চারণ করার চেষ্টা করব। আচ্ছা, একটু ভুল উচ্চারণ হলে কী হয়?’
গম্ভীরভাবে বলে নিসার, ‘এই ভাষাটা শুধু তুমি-আমি তৈরি করিনি লামিয়া। শত শত বছর ধরে ভাষার চর্চাকারী উন্নত মেধার মানুষরা ভাষার গতি-প্রকৃতি-চরিত্র লক্ষ করেছেন, তাঁরা ভাষার প্রমিতায়ন করেছেন, সঠিক উচ্চারণবিধি তৈরি করেছেন, সঠিক লেখনরীতি তৈরি করেছেন। হাজার হাজার মনীষীর এই কাজগুলোকে তুমি এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে যা খুশি সেভাবে ভাষার ব্যবহার করা তো ভাষার ওপর রীতিমতো বলাৎকার।’
‘কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে ইললিটারেট মানুষরা তো সব সময় ভুল উচ্চারণ করে?’
‘তাতে ক্ষতি নেই। তারা কথা বলে নিজস্ব ছোট পরিমণ্ডলে। কিন্তু তোমরা যখন কথা বলো টেলিভিশনে বা সিনেমায় বা অন্য কোনো মিডিয়ায়, তখন ভুল করা অন্যায়। কারণ, দর্শক-শ্রোতাদের অনেকেই তখন মিডিয়ার উচ্চারণটাকেই মডেল হিসেবে নেয়। তারা নিজের অজান্তেই ভুল জিনিস শেখে। এতে ক্ষতি হয় মারাত্মক। পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
এতক্ষণে যেন ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে লামিয়া। বলে, ‘সরি নিসার! আমি এভাবে কখনো ভাবিনি। আই শেল চেঞ্জ মাইসেলফ।’
‘দ্যাটস ফাইন।’ নিসার ধন্যবাদ জানায় এভাবেই।
এবার দুষ্টুমির হাসি লামিয়ার ঠোঁটে, ‘কিন্তু তার বিনিময়ে আমি কী পাব?’
‘কী পাবে মানে? কী চাও?’
‘তোমাকে চাই।’
যেন লামিয়া খুব দারুণ একটা রসিকতা করেছে এমনভাবে হেসে ওঠে নিসার। বলে, ‘আমাকে আবার চাওয়ার কী আছে! আমি তো এমনিতেই তোমাদের সাথে সাথেই আছি।’
‘আমাদের নয়—আমার করে চাই তোমাকে। লামিয়ার কণ্ঠে গাঢ় আবেগ।’
নিসার একটু হাসে। জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার কি এখন টাইমপাস করা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, লামিয়া?’
ঝাঁঝিয়ে ওঠে লামিয়া, ‘এটা টাইমপাস নয়! তুমি কেন বুঝতে চাও না আমি রিয়েল...’
‘না লামিয়া!’ মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় নিসার, ‘উচ্চারণ কোরো না শব্দটা! যা বলতে চাইছ সেই “ভালোবাসা” শব্দটা আমাদের কারও উচ্চারণ করাই উচিত নয়। আমরা, মানে তুমি-আমিসহ এই জেনারেশনের এবং ঢাকা শহরের এই পরিবারগুলোর সদস্যরা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি ভালোবাসার অনুভূতি। আমাদের এই সমাজে সবকিছু হয় লাভ-লোকসানের হিসাব, নয়তো টাইমপাস, নয়তো জাস্ট স্পোর্টস। আমাদের মুখ থেকে সত্যিকারের ভালোবাসার কথা উচ্চারিত হলে সেটাকে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর বাংলা নাটকের ডায়ালগের হাস্যকর মতো মনে হয়।’
এবার রক্ত সরে যায় লামিয়ার মুখ থেকে। কোনোমতে বলতে পারে, ‘তুমি আমার এই ফিলিংসটাকেও অভিনয় বলছ?’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে নিসার। তারপর বিষণ্ন গলায় যখন কথা বলে, তখন মনে হয় তার অবস্থান এখান থেকে অনেক অনেক দূরে, ‘এটি তোমার-আমার ব্যাপার নয়, লামিয়া। এটি আমাদের সমাজের এবং সময়ের অভিশাপ। আমাদের এই পশ সোসাইটির মানুষ, এই আমরা যে জীবন বেছে নিয়েছি, সেখানেও প্রতি মুহূর্তে গ্লোবাইলাইজেশন আর ওপেন মার্কেট ইকোনমির কমপিটিশনে অবৈধভাবে জয়লাভের নিশ্চয়তা। তার বিনিময়ে আমাদের যা যা হারাতে হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ভালোবাসা।’
অসহিষ্ণু হয়ে উঠে লামিয়া বলে, ‘আমি তোমার এত তত্ত্বকথা বুঝি না। আমি স্ট্রেট জানতে চাই, তুমি আমাকে চাও কি না?’
ম্লান হাসে নিসার, ‘চাওয়া বা পাওয়ার সঙ্গে ভালোবাসার তো কোনো সম্পর্ক নেই, লামিয়া। আমাদের সোসাইটির লোকজন, আমরা চাওয়া বুঝি, ছলে-বলে-কৌশলে তা পাওয়া বা আদায় করে নেওয়া বুঝি। কখনো কখনো ভুল করে তাকেই ভালোবাসা মনে করি।’
লামিয়া একগুঁয়ে, ‘আচ্ছা তা-ই হলো! তবু আমি তোমাকে চাই!’
এই কথার কী উত্তর দেবে নিসার! কিন্তু লামিয়া ছাড়ে না তাকে। জেদের সুরে বলে, ‘বলো তোমাকে পাওয়ার জন্য কী করতে হবে আমাকে? তুমি যা করতে বলবে, আমি তাই-ই করব।’
নিসার একটু ফাঁপড়ে পড়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু তুমি আমাকেই বা চাও কেন? কতজনই তো আছে তোমার জন্য পাগল! তাদের যেকোনো একজনকে বেছে না নিয়ে তুমি আমাকে চাইছ কেন?’
‘কারণ...কারণ তুমি ডিফারেন্ট।’
হো হো করে হেসে ওঠে নিসার, ‘একই রকম মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করতে করতে একঘেয়েমি এসে গেছে লামিয়া? তাই এবার স্বাদ বদল করতে চাইছ?’
মুখটা ম্লান হয়ে যায় লামিয়ার। বলে, ‘তুমি আমাকে যতই অপমান করতে চেষ্টা করো না কেন, আমি আমার অনেস্ট অনুভূতির কথা বলতেই থাকব।’
নিসার আবার একটু গম্ভীর, ‘ভালোবাসার তুমি-আমি কিছুই জানি না, লামিয়া। ভালোবাসা জানে হাসারি পাল।’
‘হু ইজ দ্যাট ফেলা?’
‘হাসারি পাল। ডোমিনিক লাপিয়েরের সিটি অব জয় মুভিটা দেখোনি?’
‘দেখতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু খুব মনোটোনাস মুভি। কোনো সাসপেন্স নেই। পুরোটা দেখতে পারিনি।’
‘হাসারি পালদের জীবনে তো সাসপেন্স থাকে না লামিয়া। মুভিতে সাসপেন্স আসবে কোত্থেকে! তবে তাদের জীবনে আছে ভালোবাসা।’
‘কই, সেই ছবিটাতে কোনো প্যাশনেট সিন আছে বলে তো মনে পড়ছে না!’
এবার শব্দ করেই হেসে ফেলে নিসার, ‘ভালোবাসা দেখাতে হলে প্যাশনেট সিন দেখাতে হবে তাই না? নারী-পুরুষের তীব্র দৈহিক মিলন? একজন হামলে পড়ছে আরেকজনের ওপর? প্রায় বেসিক ইন্সটিংক্ট! না লামিয়া, অতখানি গ্ল্যামারাস সেক্স দৃশ্য হাসারি পালদের হয় না। তবে ভালোবাসা হয়। হাসারি পাল নিজের পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে শহরে এসে রিকশা চালাচ্ছে। তারপর তার টিবি। তখন টিবির ওষুধ হয়নি। মৃত্যু নিশ্চিত। সে মরলে পরিবার বাঁচবে কী খেয়ে? হাসারি পাল তখন মৃত্যুর আগেই দালালদের কাছে বিক্রি করে দিল নিজের কঙ্কাল।’
‘ইশ্! আনবিলিভেবল!’
‘আমাদের কাছে তা-ই মনে হবে। আনবিলিভেবলই ভাবব আমরা।’
‘এই রকম মানুষ কি সত্যি সত্যি আছে, নিসার?’
খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলে নিসার, ‘আছে। অনেক আছে। তারাই জাতিটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।’
লামিয়া বলে, ‘তাই নাকি? এমন কোনো লোকের কথা আমি কিন্তু সত্যিই জানি না। তুমি ওই রকম কোনো লোকের খবর পেলে আমাকে তার অ্যাড্রেস দিয়ো তো। আমি বাপীকে বলে মাসে মাসে লোকটার নামে কিছু ডোনেশন পাঠানোর ব্যবস্থা করব।’
ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে নিসার। মনে মনে কষে নিজের গালে নিজেই লাগায় কয়েকটা থাপ্পড়। গাল দেয় নিজেকে—এবার শিক্ষা হয়েছে ব্যাটা! আর কখনো ভুল মানুষের কাছে ভুল বার্তা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবি!
কিন্তু লামিয়া তখনো তাকে ছাড়ে না, ‘তোমার জন্য আমি এটুকু করতেই পারি। যদি বলো, তাহলে আমি আমার মডেলিং থেকে পাওয়া সব টাকা তুলে দেব এদের জন্য চ্যারিটি ফান্ডে।’
‘আমি বললে দেবে!’
‘হ্যাঁ। তুমি বললে দেব।’
‘কেন?’
‘কারণ আই লাভ ইউ।’
‘আমি বললে আর কী করতে পারবে?’
‘যা বলবে তা-ই করব। একবার বলেই দ্যাখো!’
নিসার কিছুক্ষণ ভাবে। ইতস্তত করে। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, ‘চলো আমার সাথে।’
‘কোথায়?’
‘মিছিলে যাব আমরা।’
‘মিছিল!’ আঁতকে ওঠে লামিয়া, ‘মিছিলে যাব কেন? আর ইউ সিরিয়াস?’
মাথা ঝাঁকায় নিসার, ‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু লাভ রিলেশন, আই মিন, ভালোবাসার সাথে মিছিলের কী সম্পর্ক?’
ধৈর্যের সঙ্গে বোঝানোর চেষ্টা করে নিসার, ‘মানুষ মিছিলে কখন যায় জানো লামিয়া? যায় যখন খুব ভালোবাসে।’
‘কিন্তু আমি তো কোনো কাপলকে কখনো মিছিলে যেতে দেখিনি।’
‘কিন্তু আমরা যাব। কাপল হতে হলে আমার সঙ্গে মিছিলে যেতে হবে তোমাকে।’
মনে মনে হাসছে নিসার। জানে, লামিয়ার মতো মেয়ে এমন একটা পরীক্ষার কথা জীবনেও ভাবতে পারবে না।
বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে লামিয়া। মুখ দেখে বোঝা যায় মনের ভেতর ঝড় বইছে মেয়েটার। একটু করুণাও হয় নিসারের তার জন্য।
খুব মৃদুকণ্ঠে লামিয়া জিজ্ঞেস করে, ‘কিসের মিছিলে যাব আমরা? কোন মিছিলে?’
নিসার বলে, ‘মিছিলের কী আর অভাব আছে! কত মিছিল! মানুষের বাঁচার দাবিতে মিছিল, সম্মানের দাবিতে মিছিল, জাতিরক্ষার উদ্দেশ্যে মিছিল।’
কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে লামিয়া। যেন পড়তে চায় নিসারের মনের ভাষা। তারপর নিসারের ধারণাকে আউলাঝাউলা করে দিয়ে বলে, ‘চলো! যে মিছিলে আমাকে যেতে বলবে, সেটাতেই যাব আমি।’
তারা রাস্তায় বেরোতেই অসংখ্য মিছিলের দেখা পায়। প্রথম মিছিলটা তাদের পাশ কাটানোর সময় লামিয়া বলে, ‘এটাতে যাব আমরা?’
নিসার দ্বিধা করে। দাঁড়িয়েই থাকে। মিছিলটাতে যোগ দেওয়া হয় না।
পরের মিছিলটা আরও বেশি উচ্চকিত। সেই উত্তেজনা যেন স্পর্শ করে লামিয়াকেও, ‘চলো নিসার, এই মিছিলটাতে যাই!’
নিসারের দ্বিধা কাটে না। মিছিল তাদের দাঁড় করিয়ে রেখে চলে যায়।
তার পরের মিছিলে নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। লামিয়া উৎসাহিত কণ্ঠে বলে, ‘নিসার, চলো, আমরা এই মিছিলটাতেই যাই!’
নিসার তবু পা বাড়াতে পারে না।
এইভাবে একটার পর একটা মিছিল পাশ কাটিয়ে যেতে থাকে তাদের। কিন্তু কোনোটাতেই যোগ দেওয়া হয় না তাদের।
লামিয়া বিরক্ত হয়ে বলে, ‘সব মিছিলই তো চলে গেল। আমরা কোনোটাতেই গেলাম না কেন? তুমি কি ফান করার জন্য বলেছিলে আমাকে মিছিলের কথা?’
নিসারকে খুব লজ্জিত, বিব্রত, এমনকী বিভ্রান্তও দেখায়।
‘কী হলো তোমার?’
রাস্তার রোদে দাঁড়িয়ে থাকা লামিয়ার মুখের দিকে তাকায় নিসার। আশ্চর্য! মেয়েটার মুখের সৌন্দর্য একটুও কমেনি!
এবার রাগের সঙ্গেই বলে লামিয়া, ‘হোয়াট ইজ দিস? আর ইউ কিডিং নিসার?’
নিসার লামিয়ার চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। চোখ রাস্তায় নামিয়ে বিড়বিড় করে অসহায় কণ্ঠে বলে, ‘আমি যে জানি না কোন মিছিলটা ঠিক মিছিল! তোমাকে নিয়ে ভুল মিছিলে যোগ দিলে খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে লামিয়া! সর্বনাশ হয়ে যাবে! অসংখ্য ভুল মিছিল হয়েছে। অনেকবার সর্বনাশ হয়ে গেছে মানুষের। আর ভুল করা যাবে না। আগে আমরা চিনে নেব ঠিক মিছিল কোনটা। তারপর মিছিলে যাব। অবশ্যই যাব।’