মনজুরে মওলা: তাঁর কাছে নত হতেই যেতাম

আজ প্রয়াত হয়েছেন মনজুরে মওলা। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

মনজুরে মওলার ছবি অবলম্বনে মনিরুল ইসলাম

একদিন কথায় কথায় মওলা ভাইকে বললাম, আপনার সম্পাদনার ‘শ্রাবণ’ এক কপি পড়েছি যখন কলেজে পড়তাম। কবি-অনুবাদক মনজুরে মওলা আনন্দিত ও বিস্মিত হলেন। বললেন, কোথায় পেলে আমার ‘শ্রাবণ’?
ঝিনেদা (ঝিনাইদহ) পাবলিক লাইব্রেরিতে, আমি কলেজে পড়তাম তখন।

আমার কথা শুনে মনজুরে মওলা বললেন, তখন আমি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। তখনকার রাষ্ট্রপতি একদিন আমাকে ডাকলেন, বললেন, সচিবালয়ে তো আছেনই, বাংলা একাডেমিতে কাজ করেন কিছুদিন। আমলার আর কাজ কী, কামলা খাটা।

এবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের গল্প বলি।

২০০৩ সালের দিকে বা তার আগে-পরে মনে নেই এ মুহূর্তে, আমার একটি কবিতা ছাপা হলো। কবিতার নাম ‘মা’। একদিন কবি সরকার আমিন আমাকে ফোন করে বললেন, মনজুরে মওলা স্যার আপনাকে খুঁজছেন। কয়েক দিনের মধ্যেই বিটিভিতে যেতে হলো। বিটিভিতে ‘মা’-বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করছেন মনজুরে মওলা। সে সময় মওলা ভাইয়ের মা মারা যান। সেই শোকেই এই অনুষ্ঠান বলা যায়। অনুষ্ঠানে গান-কবিতার আয়োজন ছিল। একজন আবৃত্তিকার আমার ‘মা’ কবিতাটি তাঁর মতো করে পড়লেন। আর মওলা ভাই আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। প্রথম প্রশ্ন ছিল এ রকম, আচ্ছা টোকন, তুমি যে এই ‘মা’ কবিতাটি লিখেছ, এ কি তোমার মাকে নিয়েই লিখেছ, নাকি আপামর মা, দেশ মা, নদী মা?
বললাম, আমার মাকে নিয়েই লেখা। একদম আমার মা।

তিনি বললেন, এখন তোমার মা কোথায়?
বললাম, ঝিনাইদহে, আমাদের বাড়িতে।

কবি বললেন, তোমার মা কি এই অনুষ্ঠান দেখতে পাবেন?
বললাম, হ্যাঁ, পাবেন, আমি ফোন করে বলে রেখেছি।

মওলা ভাই বললেন, কিন্তু আমার মা আর দেখতে পাবেন না, আমার মা চলে গেছেন।
মাঝেমধ্যেই মওলা ভাই ফোন দিতেন। একদিন ফোন করেই বললেন, শোনো, তুমি কি ফ্রি আছ, তোমাকে একটি কবিতা শোনাব।
বললাম, নতুন কবিতা?
আরে হ্যাঁ, আজকেই লেখা। শোনো।

মওলা ভাই কবিতা শোনান ফোনে, আমি শুনতে থাকি। কবিতাপাঠ শেষে বলেন, কেমন হয়েছে আমার কবিতাটি?
আমি পড়ে যাই বিপদে। ভালো বলতে সাহস হয় না, খারাপ বলতেও চাই না। বললাম, চেষ্টা আর কি?
ফোনের অপর প্রান্তে মওলা ভাই হা হা করে হাসতে থাকেন। কারণ, সেই কবিতাটি আমার লেখা, সেদিনের ‘প্রথম আলো’ থেকে তিনি পড়ে শোনাচ্ছিলেন ফোনে। যে মনজুরে মওলার সামনে আমি পাঠসূত্রে একান্ত শিশু, সেই মানুষটা আমাকে যে কী পরিমাণ প্রশ্রয় দেন, সেই প্রশ্রয় আমার মনোজগতে সম্পদ হয়ে থাকল। তাঁর রবীন্দ্রনাথ একটা ভুবন। তাঁর এলিয়ট একটা অধ্যায়।

তাঁর শেকসপিয়ার একটা বিস্তৃতি। আর বাংলা কবিতা তাঁকে জড়িয়ে ধরে ছিল আদ্যোপান্ত। মাঝেমধ্যেই মওলা ভাইয়ের ফোন। একদিন ফোন করেই বললেন, শোনো, আমি তখন সচিব হিসেবে কাজ করছি এক মিনিস্ট্রিতে। একদিন এক ছেলে এসে বলল, স্যার, আমি আপনার মিনিস্ট্রিতে কাজ করতে চাই আপনার সঙ্গে। আমি বললাম, বেশ তো, তোমার নাম কী? কেন আমার সঙ্গে কাজ করতে চাও?
ছেলেটি অন্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করছিল। বলল, স্যার, আমার নাম শহীদুল হক। আরও কিছুক্ষণ কথা হলো। ওকে ভালো লাগল, আমার এখানে নিয়ে এলাম। এই হচ্ছে তোমাদের শহীদুল জহির...তাই তো?
শেষের দিকে কিছুদিন কবি-অনুবাদক মনজুরে মওলা বাসায় হুইলে চলতেন। এই অবস্থায় ফোন দিয়ে তিনি মাঝেমধ্যেই ডাকতেন, যেতাম। একদিন এ রকম হুইলে বসা অবস্থায় বললেন, ‘কাঁটা’ ছবিতে আমাকে একটি চরিত্র দেবে? টারজান নেই তোমার ছবিতে, আমি টারজান ক্যারেক্টার করব।
তারপর দুজনেই হাসতে থাকি। তখন হয়তো তাকে হুইল থেকে তাঁর কাজের লোকের সাহায্যে চেয়ারে বসানো হচ্ছে...।
মনজুরে মওলা—তাঁর রবীন্দ্রনাথ, তাঁর পড়া-জানার কাছে আমি শিশুও নই। নত হয়ে যেতাম, নত হতেই যেতাম। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]