মফস্বল: অনেক কমলা রঙের রোদ

মফস্বল—গত দুই–তিন দশকে বদলে গেছে তার অনেক কিছুই। মফস্বলগুলো যেন এখন মেট্টো শহর হওয়া দৌঁড়ে শামিল হয়েছে। কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সেই মানবিক মফস্বল? এ লেখায় উঠে এসেছে এই মফস্বল আর সেই মফস্বলের আলোছায়াময় গল্প।

মফস্বলে রচিত কবিতাগুলো আমি আর লিখতে পারব না। সেই কবিতারা হিমঘরে পড়ে থাকা লাশের মতন হাতে লেখা খাতার ভেতরে ঘুমিয়ে আছে। খাতাগুলো আছে বাড়িতে, পুরোনো আলমারির ভেতরে। বহু বহু দিন পর মেট্রো শহরের সীমানা ডিঙিয়ে, পদ্মা পার হয়ে ফিরে আসি আমাদের সেই শহরে, যে শহর ছোট্ট, যে শহর মফস্বল। এ রকম মফস্বল শহরঘেরা বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ গ্রাম থেকে এসে বাসা বুনেছে। এ দেশের মফস্বল শহরগুলোর বয়স কত? দেড় শ-দুই শ, কোথাও তিন শ বছর বড়জোর। তাই একটা প্রশ্ন আজ নিজেকে, তোমাকে বা আপনাকে করাই যায়, আমরা কে না মফস্বলের মানুষ? বাংলাদেশে, এককথায় জেলা শহরকেই মফস্বল বলে ডাকা হয়।

কারা ডাকে? যারা গ্রামীণ বাসিন্দা, তারা? না। যারা মেট্রো শহর ঢাকায় থাকে, তারাই জেলা শহরকে মফস্বল বলে ডাকে। আমি মফস্বলের তরুণ কবি, কবিতা লিখে ঢাকার পত্রিকায় বা ছাপাখানায় পাঠাই, ছাপা হয়। তখন আমার একটুখানি মৃদুমন্দ পরিচিতি আসে, মফস্বলের তরুণ কবি। অবশ্য নিজের দিকে তাকিয়ে কি আমি কখনো বলেছি, মফস্বলের তরুণ কবি? তারপর, আস্তে আস্তে একদিন আমিও ঢাকায় চলে যাই।

মফস্বল ছেড়ে যাই। অনেক অনেক দিন পর যখন ফিরে আসি বাড়িতে, তাকাই সেই পুরোনো আলমারির দিকে। দেশি-বিদেশি বইয়ের চাপে আলমারি ঠাসা, ভরাট। এই বইগুলো একদিন সংগ্রহ করেছিলাম কত কষ্টে! বই পড়ার কী নেশা ছিল! বইয়ের পোকা ছিলাম। ওই আলমারির ভেতরেই কোথাও ঘুমিয়ে আছে আমার সেই নবীন কবিতার খাতাগুলো, যারা আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেও নিজেরা যেতে পারেনি। কাঁচা আম পছন্দ করে সবাই, কাঁচা কবিতা কেউ নেবে না। অথচ সত্য, তরুণ কবিকে পাকিয়ে দিতে কাঁচা কবিতাগুলোই কী ভূমিকা রেখেছে! আর ভূমিকা রেখেছে কে? মফস্বল। মফস্বলই গড়ে দিয়েছে। তাই মফস্বল বলতে দূরের জেলা শহর বুঝবে যে কেউ। আমি বুঝতে পারি, মফস্বল আমার শিক্ষক। শিক্ষক আমাকে আরও শিখতে দূরের মেট্রো শহরে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঢাকায় পৌঁছে গেছি আমি। অনেক বছর ঢাকায় থেকে ফের মফস্বলে এসেছি। কী দেখে গেছিলাম, কী রেখে গেছিলাম? ফিরে এসে আজ কী দেখতে পাচ্ছি?

তখন মফস্বলের সরকারি কলেজের দালানগুলো ছিল এমন। ঝিনাইদহের সরকারি কেসি কলেজের প্রাচীন দালান
ছবি: অমিত সেন

গত শতকের আশির দশকের শেষ প্রান্তে এসে আমার সঙ্গে মফস্বল শহরের পরিচয় হয়। তার আগে আমি গ্রামজীবন পার করেছি। জন্ম নেওয়ার পর গ্রামীণ বাতাবরণে বসবাস শেষে যখন মফস্বল শহরের ঘোর বারান্দায় উঠে পড়ি, দেখতে পাই, একটি সরকারি কলেজ। আমি কলেজে পড়ি তখন। ভাবতাম, কলেজের দিন পার করে একদিন ঢাকায় যাব। ঢাকা নাকি অনেক বড় শহর! তো, তখনকার মফস্বল শহরের প্রতিচ্ছবি এখনো ঢের মনে আছে। ঢাকার দৈনিক পত্রিকা এসে মফস্বলে পৌঁছাত বিকেলে বা সন্ধ্যায়। সেই বিকেলেই আগের দিন রাতে ছাপা হওয়া পত্রিকা পড়ত পাঠক। আমার লক্ষ ছিল দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীর দিকে। দৈনিক ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’, ‘দৈনিক বাংলা’, ‘ইনকিলাব’ তখন প্রধান প্রধান কাগজ। রেডিওর খবর শুনত মানুষ। শুনত সিনেমার গানের অনুষ্ঠান ‘গানের ডালি’। সন্ধ্যায় বিভিন্ন দোকানের সামনে মানুষ দাঁড়িয়ে যেত, জটলা হতো। বিবিসি বা ভয়েস অব আমেরিকা শুনত।

গত শতকের আশি বা নব্বইয়ের দশকে মফস্বলের ছেলেমেয়েরা বই পড়তে পছন্দ করত। চিন্তাশীল মেধাবী ছেলেটি নির্ঘাত বামপন্থী ছাত্ররাজনীতিতেই জড়িয়ে পড়ত, সমাজবদলের আদর্শ বলে কিছু ছিল তখনো। খুব নিজের মতো করে ভাবতে পারা মেয়েটি হয়তো মেধাবী ছেলেকে পছন্দ করত। কিন্তু পছন্দ থেকে বলে ফেলা পর্যন্ত তাদের কত সময় লেগেছে? এক বছর? দুই বছর? তিন বছরও কখনো কখনো। কারও কারও তো ভালোবাসার কথাটি বলার আগেই মেয়েটির হয়তো বিয়ে হয়ে গেল সরকারি চাকুরে ছেলেটির সঙ্গে।

টেলিভিশন বলতে ছিল বিটিভি। বিটিভিতে দর্শক নাটক দেখত, সিনেমাও দেখত।

বিটিভি খুলত বেলা তিনটায়। শুক্রবার বিটিভি সকালের দিকে খুলত। ‘টারজান’ দেখতাম আমরা। মফস্বলে তখন সিনেমা হলের জমজমাট ব্যবসা ছিল। প্রতি জেলা শহরেই অন্তত কয়েকটা করে সিনেমা হল তো ছিলই। অন্তত কয়েকটা নাটকের দল ছিল তখনকার মফস্বল শহরে, জেলা শহরের মিলনায়তনে খুব নাটক মঞ্চস্থ হতো। রবীন্দ্র-নজরুলের গান শেখার মধ্যবিত্তীয় চল ছিল। মফস্বলের পাবলিক লাইব্রেরি খুব সরগরম থাকত। কিছু পাঠক প্রতিদিন পাবলিক লাইব্রেরিতে রুটিন করেই যেতেন।

প্রতিটি মফস্বলেই ডাকঘরগুলো ছিল দারুণ সক্রিয়। শহরে মোড়ে ছিল লাল ডাকবাক্স

পাবলিক লাইব্রেরিতে যত বই, তার থেকে দুনিয়াকে জানাবোঝার সুযোগ নিয়েছে যারা, আমিও তাদের দলে ছিলাম এবং তখনো, গত শতকের নব্বইয়ের দশকেও ডাকঘর ছিল সাধারণ যোগাযোগের প্রায় একমাত্র মাধ্যম। মানুষ চিঠি লিখত প্রিয়জনকে। প্রেম চলত চিঠিতেই তখন। বিরহও চিঠিতে ভেসেছে। সে সময়ের সব প্রেমিক-প্রেমিকারই ডাকঘরের কাছে ঋণ রয়ে গেছে। ডাক হরকরার কাছে ঋণ রয়ে গেছে। ডাকপিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকা ছিল। মানুষ চিঠি লিখত পোস্টকার্ডে, নানা রকম প্যাডে। কী সুন্দর সুন্দর ডাকটিকিট ছিল! অনেকেরই ছিল ডাকটিকিট জমানোর নেশা। হলুদ খামের মধ্যে সেই লাল-নীল প্যাডে লেখা চিঠিরা চলে যেত গন্তব্যে। সব চিঠিই যে গন্তব্যে পৌঁছেছে, তা বোধ হয় বলা যাবে না। লোকে বলত, ‘আমার চিঠি মাইর গেছে।’ টেলিগ্রাম ব্যবস্থা চালু ছিল। শহরে সন্তানের কাছে টেলিগ্রাম যেত, ‘মাদার সিক, কাম শার্প।’ টেলিফোনে ট্রাংককল চালু ছিল। অফিসে কোথাও টাইপিস্ট মেশিন চালু থাকলেও মানুষের হাতে লেখার দিন ছিল তখন।

মফস্বল শহরের আবাসিক পাড়ার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়, খুব সকালে বা সন্ধ্যায় ভেসে আসত কিশোরীর গলা সাধা, ‘মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম...’ বা ‘কাবেরীর নদীজলে কে গো বালিকা...’। ঝিনাইদহের ঘন মফস্বলে হয়তো কিশোরী সোহাগ মণি দাস গাইছে সেই গান। সোহাগের কথা এলই যদিবা, অশোক ধরের কথাও আসতে বাধ্য। সম্রাট অশোক-সোহাগের মিলন হয়নি, কিন্তু তারা মিলুক—আমরা চেয়েছি। চাইলেই তো সব প্রেম সংসারে গিয়ে ঠেকবে না। তবে সে সময় প্রতিবাদী যুবকের কণ্ঠে অবশ্যই বিচ্ছুরিত হতো, ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু?’ কিংবা ‘আমি এক যাযাবর...’।

ভূপেন হাজারিকা—তিনি কোন আসাম দেশের শিল্পী, কিন্তু তাঁর গানই মফস্বলের মঞ্চে মঞ্চে বেজেছে। হয়তো গাইছে তপু ভাই বা ছোটন। শত শতবার মাইকে শুনতে শুনতে ভূপেন আমাদের মুখস্থ হয়ে যায়। ঝিনাইদহে সেই মফস্বলে দেখেছি এমন, শহরের ব্যস্ততম ডাক্তারবাড়িতেও গানের আসর বসে। শাস্ত্রীয় সংগীত চলছে। ডাক্তার হামিদুন নেসা পাখী সেই আসরকে উৎসাহিত করতে অকাতরে সাহায্য করছেন। কবিতার ঘোর-বেঘোর নিয়ে তর্ক উঠছে। কবি কাজী গিয়াস আহমেদ হয়তো জীবনানন্দে মাতাল হয়ে উঠছেন। মফস্বলে থেকেও ফোনে ফোনে যোগাযোগ করছেন কলকাতায়।

লেখকের ঘরের সেই আলমারি
ছবি: লেখক

উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে তাঁর কথা চলছে। এই আসরে বি এম রেজাউল করিম বসে আছেন, আছেন খোন্দকার হাফিজ ফারুক। এ রকম সাহিত্য সভা মফস্বলে হয়। সাংবাদিক শেখ মিজানুর রহমানই হয়তো একা চালিয়ে আসছেন চলন্তিকা সাহিত্য আসর। মনে রাখতে হবে, তখনো লেটার প্রেসের যুগ শেষ হয়ে যায়নি। কয়েকটা প্রেস তো একটা মফস্বল শহরে থাকতই। প্রতিটি অক্ষর ধরে ধরে, যেনবা গেঁথে গেঁথে ছাপানোর আয়োজন।

মাইক বা গ্রামোফোন বাজারে থাকতেই চলে এল ক্যাসেট প্লেয়ারের যুগ। সুমন চট্টোপাধ্যায় (পরে কবীর সুমন) কণ্ঠ ছাড়লেন ঘরে ঘরে। বেজে উঠল নচিকেতা। এল ভিসিআরে সিনেমা দেখার দিন। ভিসিআর ও টিভি ভাড়া করে এনে সিনেমা দেখার চল ছিল মধ্য আশির পর। ভারতীয় বাংলা সিনেমা, বোম্বের (মুম্বাই) হিন্দি সিনেমা, হলিউডি সিনেমা, আরও কত কিছু দেখার মওকা চলে এল।

লেটার প্রেস হারিয়ে গেল নব্বইয়ের দশকেই। কম্পিউটার এসে গেল। গ্রামোফোন জাদুঘরে চলে গেল। মাইকের বদলে একধরনের সাউন্ড বক্স এসে গেল। মফস্বলে বসে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ভিউকার্ড দেখতাম আমরা, সেই সময়, যখন পরিবারগুলো মনে করত সিনেমা দেখলে ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যায়।

গত শতকের আশি বা নব্বইয়ের দশকে মফস্বলের ছেলেমেয়েরা বই পড়তে পছন্দ করত। চিন্তাশীল মেধাবী ছেলেটি নির্ঘাত বামপন্থী ছাত্ররাজনীতিতেই জড়িয়ে পড়ত, সমাজবদলের আদর্শ বলে কিছু ছিল তখনো। খুব নিজের মতো করে ভাবতে পারা মেয়েটি হয়তো মেধাবী ছেলেকে পছন্দ করত। কিন্তু পছন্দ থেকে বলে ফেলা পর্যন্ত তাদের কত সময় লেগেছে? এক বছর? দুই বছর? তিন বছরও কখনো কখনো। কারও কারও তো ভালোবাসার কথাটি বলার আগেই মেয়েটির হয়তো বিয়ে হয়ে গেল সরকারি চাকুরে ছেলেটির সঙ্গে। তখন আর কী! উদাসীন নদীতীরের ঘাসে বসে কত যে বিকেল সন্ধ্যার দিকে ঝুলতে ঝুলতে কত রাত হয়ে গেছে, তা আর লিখবে কে? অধ্যাপক শহীদুর রহমানকে বলতে পারা যেত! অধ্যাপক শাহজালাল স্যারকেও বলা যায়। যদি তাঁরা বেঁচে থাকতেন। মনে কি পড়ে না, একটা গল্প বা কবিতার বইয়ের ভাঁজে একটা গোপন প্রণয়ের চিঠি কি রাজু পাঠায়নি পিয়া খন্দকারকে? পিয়া কি সেই চিঠির উত্তর লিখেছে? পিয়া কি কাউকেই, হাতে হাতে হলেও নিজে কোনো চিঠি দেয়নি?
চিঠির উত্তরের জন্য এক অদ্ভুত অপেক্ষাপর্ব ছিল। গোপনীয় উত্তেজনা ছিল।

সেই অর্থে মফস্বলে নাগরিকেরা দাঁড়াতে পারেনি। হয়তো নদী দখল হয়ে যাচ্ছে, কারোর কিছু বলার নেই। হয়তো আস্ত একটা পৌর পার্ক দখলদারের কবলে পড়ে উন্নয়নের বিল্ডিং হচ্ছে, কে ঠেকাবে সেই উন্নয়ন? চোখবন্দী মফস্বল সাংবাদিকতা আজ। সরকারি রাস্তার দুই পাশের জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে। কে বন্ধ করবে? রক্ষক আজ ভক্ষকের দায়িত্ব পালন করছে। সাধারণ মানুষ কাতরাচ্ছে সরকারদলীয় রাজনীতির কর্তৃত্বের কাছে। তা সে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, মফস্বলে পরিস্থিতি একই থাকে।

ভালোবাসায় মান ছিল, অভিমান ছিল। এভাবেই যাচ্ছিল সময়। সময় কোথায় যাচ্ছিল? সেই সময় এবং মফস্বল দেখতে এমনই ছিল। অন্য রকমও ছিল। আমি যা দেখেছি ও দেখার মধ্যে থেকেছি, সেখান থেকেই বলে যাচ্ছি। এর বাইরেও কত কী ছিল! একটা উৎসব উৎসব ভাব ছিল পাড়ায় পাড়ায়। খেলাধুলার আসর চলত। স্টেডিয়াম হয়তো হয়নি তখনো, কিন্তু খেলা হতো। খেলা তো হবেই।

মামুন স্যারের মেয়ে মহুয়ার কথা মনে আছে? লাইজু কী দারুণ নাচ করত। মাঝেমধ্যে ঢাকায় গিয়ে বিটিভিতে পারফর্ম করে আসত। মফস্বল এমন, জনজীবনে মানুষ কোথাও খুব নীতিবোধে চালিত হতো। আশি-নব্বইয়ের কথা বলছি।

অধিকাংশ মফস্বল শহরগুলো ছিল এক রাস্তার

কয়েকজন সাহিত্যানুরাগী একসঙ্গে আড্ডায় বসে লিটল ম্যাগাজিন ছাপানোর সিদ্ধান্তের মধ্যেই তাদের বিপ্লবী অভিপ্রায় লুকিয়ে রাখত। নতুন একটি কবিতা, নতুন একটি গল্প জন্ম নিচ্ছিল, এভাবেই জন্ম নিচ্ছিল স্বপ্ন, মফস্বলের ছিমছাম হাওয়ায়, এপাড়া-ওপাড়ায়। হয়তো তাদের, লিটল ম্যাগাজিনের স্বপ্নে বিভোর বন্ধুদের সময় যাচ্ছিল। সন্ধ্যায় দিলীপ ঘোষ, উজ্জ্বল, নয়ন, মাসুদ, বাপ্পী ও আরেফিন অনুর সঙ্গে দেখা, কলেজের পেছনের খানিকটা চুপচাপ মাঠের ঘাসে আড্ডা। হয়তো পরিকল্পনা হয়ে গেল, শিমুলপুরে যেতে হবে। শিমুলপুর কোথায়? ঠাকুরপুকুর। বিনয় মজুমদারকে দেখে আসতে হবে। কিন্তু তার আগে তো পাসপোর্ট লাগবে, তাদের কারোরই পাসপোর্ট নেই। সুবিমল মিশ্রকে নিয়ে তর্ক তো থামছেই না। আবুল হাসান কেন ২৮ বছরেই মরে গেল? সুরাইয়া কি কবিকে ভালোবেসে দহন দিয়েছিল? সুনীল শর্মাচার্য চলেন গেলেন পশ্চিমবঙ্গে। দাউদ আল হাফিজ ঢাকায়। এখন তো দাউদ প্রয়াত। সামসুজ্জামান লাবলু কোথায়? কে যে আজ কোথায়, কে জানে?

নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পাচ্ছেন। আমাদের কী উৎসাহ তখন! ২৭ বছর কারাবন্দী জীবন কাটিয়ে আফ্রিকান নেতা ম্যান্ডেলা মুক্তি পেলেন। কত রাজনৈতিক পালাবদল হলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই। পুরো এক পৃথিবী টলমলে হয়ে গেল। তারুণ্যেই স্বপ্নভঙ্গ হলো? সমাজতান্ত্রিক সাম্য ব্যবস্থা কি তাহলে ইউটোপিয়াই হয়ে থাকল?

মফস্বলের দুর্বলতা হলো, সে সব সময় ঢাকার দিকে চেয়ে থাকে। যেনবা ঢাকাই তার হেড অফিস। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য—প্রায় সব ক্ষেত্রেই। যেনবা সব মফস্বল ঢাকার মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

সেই অর্থে মফস্বলে নাগরিকেরা দাঁড়াতে পারেনি। হয়তো নদী দখল হয়ে যাচ্ছে, কারোর কিছু বলার নেই। হয়তো আস্ত একটা পৌর পার্ক দখলদারের কবলে পড়ে উন্নয়নের বিল্ডিং হচ্ছে, কে ঠেকাবে সেই উন্নয়ন? চোখবন্দী মফস্বল সাংবাদিকতা আজ। সরকারি রাস্তার দুই পাশের জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে। কে বন্ধ করবে? রক্ষক আজ ভক্ষকের দায়িত্ব পালন করছে। সাধারণ মানুষ কাতরাচ্ছে সরকারদলীয় রাজনীতির কর্তৃত্বের কাছে। তা সে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, মফস্বলে পরিস্থিতি একই থাকে।
পেডল রিকশার টুংটাং শব্দ গলি দিয়ে চলে যায়। স্কুল বা কলেজের ইউনিফর্ম পরা মেয়েরা হাঁটে দল বেঁধে। যেনবা তারা গল্পচ্ছলে হেঁটে যাচ্ছে তাদের পরবর্তী জীবনের দিকে। সে জীবন যে কোন গন্তব্যে ধাবিত, কেই-বা জানে! তাদের দু-একজন কি ঢাকায় যেতে পারবে, পরবর্তীকালে? নাকি হারিয়ে যাবে মল্লিকাদের মতোই? হয়তো ছিমছাম বিকেল নীল শাড়ি পরে রিকশায় প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছে। অবশ্য আজকের মেয়েরা কী কারণে যেন প্রায় অনেকটাই বদলে গেছে।

শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে, রেলস্টেশনের দিকে শীতকাল কুয়াশা জমিয়ে রেখেছে। কে হারাবে আজ রাতে, কুয়াশার অভ্যন্তরে? অগ্নিবীণা সড়ক ফাঁকা, কেউ নেই। গীতাঞ্জলি সড়কে কেউ নেই। বাঘা যতীন সড়কে কেউ নেই। স্টেডিয়াম ফাঁকা, খেলাধুলা নেই। গানবাজনা নেই। যাত্রা–সার্কাস নেই। ম্যাডোনা জোয়ার্দার কি এখনো রবীন্দ্রসংগীতে দুলে দুলে উঠছে? জানি না কিছুই। আর যারা কিশোরীরা দল বেঁধে আসত ললিতকলা একাডেমিতে, তারা কোথায়?

মফস্বল বড় মায়াময়। নবগঙ্গা নদীর ধারে দেবদারু অ্যাভিনিউ। শতবর্ষী দেবদারুরা বৃষ্টিতে থাকে। গড়াই নদীর পাড়ে ঘোর মফস্বল ঘুমিয়ে থাকে। কাঞ্চন নদের তীরে গাঢ় মফস্বল জাগে। চিত্রা বা ভৈরবের জলে স্নাত মফস্বল তাকিয়ে থাকে শহরে নতুন অতিথির দিকে। গোমতী-সুরমা-মগড়া-কুমার-পদ্মা-তুলসীগঙ্গা নদীর তীরে নিবু নিবু মফস্বল বলে, আছি। যদিও নদীগুলো ক্ষমতাসীনদের দখলে বিলীনপ্রায়। দেশের প্রায় সব মফস্বল শহরের ভেতর দিয়েই নদ-নদী প্রবাহিত।

নব্বইয়ের দশকের পর এল মিলেনিয়াম, ২০০০ সাল। মুঠোফোন এসে যাচ্ছে তখন। এসে গেল ডিশ অ্যানটেনা। দুনিয়ার টেলিভিশন চ্যানেল চলে এল ঘরে ঘরে। এরপর এসে যাচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবস্থা। ২০০০ সালের পরপরই ইন্টারনেটের বিপ্লব হয়ে গেল। ই-মেইল, গুগল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিভিন্ন ব্লগ, ফেসবুক—একদম বদলে গেল দুনিয়া। বদলে গেল মফস্বলও। বদলে যাচ্ছে গ্রামসভ্যতার চিরাচরিত ভঙ্গি। যদি বলি এই সময়ের কথা, এখন ২০২১।

মফস্বলের সবুজের সমারোহ

কেমন দেখছি তবে এই সময়কে? কেমন লাগছে আজিকার প্রবাহ? ডাকঘরের দিন ফুরিয়েছে প্রায়। রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যপনা এতটাই উৎকট আকারে প্রতিষ্ঠিত যে গানের স্কুল আর নেই। নাটকের চর্চা আর নেই। কবিতা-গল্প-উপন্যাস আজকের মফস্বল শহরে কোনো ভূমিকাই রাখে না। যেন সব শুভসম্পন্নতার অবসান হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির ধাক্কায় সাধারণ মানুষ টিকে থাকতেই গলদঘর্ম, তাদের বেঁচে থাকাই যেন বিরাট কিছু। যার কাছে টাকা আছে, সেই সব। যার টাকা নেই, সে কিছুই নয়। টাকা আছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও তাদের সহযোগীদের কাছে। ক্ষমতাসীনদের পকেটে বা অ্যাকাউন্টে। আয়তনে বেড়েছে সব শহর, সব মফস্বল। লোকসংখ্যা বেড়েছে। অনেক বিল্ডিংধর্মী উন্নয়ন পরিলক্ষিত, যে উন্নয়নের উদ্দেশ্যই থাকে কিছু লোক অনেক টাকার মালিক হয়ে যাবে, বাকি বেশির ভাগ লোকের জীবনমান নেমে যাবে। সরকারদলীয় হয়ে উঠবে সমাজের যুবকেরা, সেটাই তাদের গর্বিত জীবনদর্শন। শিক্ষা বলতে দলীয় নেতাদের ছবির সঙ্গে নিজের ছবি যুক্ত করে ডিজিটাল প্যানা প্রিন্টের ব্যানার গাছে গাছে বা যত্রতত্র বা রাস্তার মোড়ে রুচিহীনভাবে টাঙিয়ে রাখা। ক্ষমতার বীভৎসতার সংস্কৃতিই আজ সমগ্র মফস্বলকে আটকে ফেলেছে। চিন্তাচেতনার স্তরে মফস্বলের অবনমন ঘটে গেছে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। মুখ থুবড়ে পড়েছে ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন। শুভময়তার পরাজয় ঘটে চলেছে প্রতিটি মফস্বল শহরেই। দখলি সংস্কৃতিই একমাত্র সংস্কৃতি হয়ে গেছে।

রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতাকে সাধারণ নাগরিকের স্বাধীনতাই উত্তীর্ণ করা যায়নি বা করা হয়নি। কিছু মানুষের জন্যই যেনবা স্বাধীনতা, এই চিত্র মফস্বলের, গোটা বাংলাদেশেরও।

তাহলে কোথায় হারিয়ে গেল তবে আমাদের সেই মানবিক মফস্বল শহর? যে অবস্থায় এসেছে আজ, তা কি কাম্য ছিল?
তিরতির করে বয়ে চলে ইছামতী, কুশিয়ারা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, বাঁকখালী, রায়মঙ্গলা নদী—আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের সেই ঘোর লাগা বারান্দায় বসে থাকা সোনালি দিনের গল্প, আমাদের সেই মফস্বল, অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল যেখানে। আমরা সেই রোদের গল্প জানি। যেই গল্প মরে গেছে আজ...কোথায় যেন সব হারিয়ে গেছে। কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না, যে শহর, যে মফস্বল রেখে গেছিলাম একদা।

আমার কাঁচা কবিতাগুলো আলমারির ভেতর থেকে আমাকেও কি ভর্ৎসনা করছে না? কী শোচনা করব আমি? জানি, আর কোনো দিন সেই ছিমছাম শহর আমি খুঁজে পাব না। তবু খুঁজতে থাকব, যেভাবে তোমাকে হারিয়ে ফেলে খুঁজে চলেছি আজও...।