মারি ও উৎসব

করোনাভাইরাসের কারণে স্বাধীনতার পর এই প্রথম রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের আবহন হলো না। অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
করোনাভাইরাসের কারণে স্বাধীনতার পর এই প্রথম রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের আবহন হলো না। অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
>করোনাভাইরাসের কারণে এবার ঘরেই উদ্​যাপিত হলো পয়লা বৈশাখ। এ লেখায় মিলেমিশে আছে বাঙালির বৈশাখ আর মহামারির প্রসঙ্গ

আমাদের প্রচারমাধ্যমের তরুণ রিপোর্টারদের কল্যাণে উপলক্ষ বিশেষে উচ্চারিত কিছু টুকরা কথা ইদানীং বেশ চালু হয়ে গেছে। যেমন, উৎসবমুখর পরিবেশ, নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা, বাঙালির প্রাণের উৎসব ইত্যাদি। হালে যুক্ত হয়েছে দৃশ্যমান হওয়া। বাঙালির প্রাণের উৎসব একটাই। আর সেটা হলো পয়লা বৈশাখ। তো সেই উৎসব করোনার কারণে এবার প্রকাশ্যে না করার নির্দেশ ছিল সরকারের। উপায় নেই। করোনার আক্রমণে প্রায় গোটা দুনিয়াতেই এখন অনেক মানুষের মরণ-বাঁচন অবস্থা। বাংলাদেশে ততটা না হলেও খানিকটা তো শুরু হয়েই গেছে। তাই সরকারের কথা, সাবধানের মার নেই। উৎসব বাইরে নয়, এবার ঘরে।

এটা নিয়েই এক চ্যানেলে দেখলাম, রিপোর্টার বলছেন, আবহমান বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ এবার প্রকাশ্যে উদ্​যাপন করা যাবে না। কথাটা শুনে আমি তো থ।

আমার থ হওয়ার কারণ অবশ্য ভিন্ন। বিভিন্ন চ্যানেলে দেখি রিপোর্টাররা ভারী ভারী শব্দ ব্যবহার করছেন তাঁদের কথায়। সরকারি কর্মকর্তারাও তা–ই। করোনার এই দুঃসহ সময়ে নতুন একটি কথা পেলাম, সামাজিক দূরত্ব। কথাটা ভারী। কিন্তু অর্থটা অতি সহজ। বাইরে বেরোলে একজন অন্যজন থেকে অন্তত তিন ফুট তফাতে থাকবেন। কোথাও গা ঘেঁষাঘেঁষি চলবে না। মাঝখানে তিন ফুট ফাঁক অবশ্যই থাকতে হবে।

তো, আমি ফিরে আসি আগের কথায়। আমার খটকা লেগেছিল আবহমান শব্দটার অবস্থান নিয়ে। এই বিশেষণ কি বাঙালির আগে বসতে পারে? পারে না। আবহমান শব্দটা ব্যবহার করলে বলতে হবে ‘বাংলার’। তারপরও কথা থেকে যায়। পয়লা বৈশাখ কি বাঙালির প্রাচীন উৎসব? মোটেও না।

বাঙালির পয়লা বৈশাখ উৎসবের সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাঘোৎসবের আয়োজনও তাঁর দ্বারাই শুরু। রবীন্দ্রনাথ এগুলোর সঙ্গে যুক্ত করেন পৌষমেলা, বসন্তোৎসব ও শারদোৎসব।

রবীন্দ্রনাথের পিতা ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁরা পিরালি ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত ছিলেন। হিন্দু ব্রাহ্মণরা তাঁদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বিষয়বুদ্ধি ও বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মসভার কোনো উপাসনা পদ্ধতি ছিল না। এই পদ্ধতি চালু করেন দেবেন্দ্রনাথ। একদা হিন্দু ছিলেন বলে হিন্দুদের বারো মাসে তেরো পার্বণের ব্যাপারটা তাঁর মাথায় ছিল। তাই ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যদের একত্রে রাখার জন্য তিনি শুরু করেন পয়লা বৈশাখের উৎসব ও মাঘোৎসব। পরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে চালু করেন অন্যান্য উৎসব এবং সৃষ্টি করেন প্রকৃতি নিয়ে প্রচুর গান।

বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গেও পয়লা বৈশাখকে উৎসবের দিন হিসেবে গণ্য করা হতো, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে দিনটি ছিল হালখাতার দিন। জমিদার এবং পরবর্তীকালে ব্যবসায়ীরা দিনটি উপলক্ষে মানুষকে মিষ্টি খাওয়াতেন।

পয়লা বৈশাখ বাঙালির উৎসব হিসেবে যাত্রা শুরু করে ১৯৬৭-তে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। ১৯৭১ সালে সেই বটমূলে রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ’ গানের সুর ভয়ে বেজে ওঠেনি আসুরিক শক্তির পীড়নে। ৪৯ বছর পর আবার এল এক নতুন অসুর—করোনাভাইরাস। অদৃশ্য তার করাল ছায়া। উৎসব আবারও বন্ধ।

বাঙালি কবি সত্যেন দত্ত তাঁর এক কবিতায় লিখেছিলেন, ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা/ মারী নিয়ে বাস করি।’ শব্দটা ‘বাস’ নাকি ‘ঘর’ ঠিক মনে পড়ছে না। তবে এতে অর্থের কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। মারি নিয়ে বাঙালির বাস তো অনেক দিনের। কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, আন্ত্রিক জ্বর বা টাইফয়েড—সবই তো মারির মধ্যে পড়ে। আর মহামারি বলতে যা বোঝায় তা–ও ছিল বাংলাদেশে। কলেরা আর গুটিবসন্ত ছিল মহামারি। কেন জানি না, বেশির ভাগই হতো নদীর ধারের গ্রামগুলোতে। একটার পর একটা গ্রাম উজাড়। তখন মাইক ছিল না। তবু দূর থেকে শুধু শোনা যেত মুহুর্মুহু আজানের ধ্বনি। সে সময় অবশ্য গ্রামের লোকেরা মহামারি বলত না, বলত মড়ক। যত দূর মনে পড়ে ১৯৫৩ কি ১৯৫৪-তে আমাদের গ্রামে এল বসন্তের টিকা আর কলেরার ভ্যাকসিন। তবে তা ছিল শুধু স্কুলের ছাত্রদের জন্যই। জনসাধারণের জন্য নয়। আরেকটা কথা, আমাদের শৈশবের দেখা ও শোনা মহামারি ছিল এলাকাভিত্তিক। পুরো দেশ কলেরা ও বসন্তের কবলে—এমন ঘটনা বাংলাদেশে কখনো ঘটেনি।

অনেক দেশে একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়া মহামারির কথা প্রথম শুনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে।

শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত আর গৃহদাহ উপন্যাসে প্রথম শুনি প্লেগ মহামারির কথা। তবে তা বাংলাদেশের নয়। পরে যখন পড়ি ইউরোপের প্লেগের কথা—ভয়ে শিউরে উঠি। সতেরো ও আঠারো শতকের সেই প্লেগে ইউরোপের অর্ধেক মানুষই নাকি মারা যায়। প্রথম মহাযুদ্ধ যখন শেষ হতে চলেছে, সেই ১৯১৮–তে শুরু হয় স্প্যানিশ ফ্লু। সেই ফ্লু ইউরোপ থেকে আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। মারা যায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। সেই সময়ে পাঁচ কোটি মানুষ—ভাবা যায়?

প্লেগ নিয়ে বাংলায় অনূদিত অ্যালবেয়র ক্যামুর দ্য প্লেগ পড়ি ঢাকায় চাকরি করতে এসে ১৯৭৩ সালে। ১৯৮৮–তে জার্মানি যাই তিন বছরের জন্য। কর্মস্থল কোলন শহরে অবস্থিত ডয়চে ভেলেতে। আমাদের বলা হতো বেতার সাংবাদিক। পরের বছর যাই হ্যামিলন শহরে। বেড়াতে নয়, অফিসের পয়সায় সাংবাদিকতার সূত্রে। কোলন থেকেই খবর চলে যায় মেয়র মহোদয়ের কাছে—এক বাঙালি সাংবাদিক যাচ্ছেন হ্যামিলনের বংশীবাদকের কাহিনির উৎস সন্ধানে। সে এক বিচিত্র ঘটনা। হ্যামিলনে পৌঁছুতেই আমি হয়ে গেলাম মেয়র মহোদয়ের অতিথি। সে কী যে খাতিরযত্ন। জার্মান ভাষা আমি জানি না। দুই দিনের মধ্যেই মেয়র অফিস থেকে হ্যামিলনের কাহিনি ও কিংবদন্তি নিয়ে লেখা একটি জার্মান বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ আমাকে দেওয়া হয়। বইটা পড়তে গিয়ে জানলাম, হ্যামিলনের বংশীবাদকের কাহিনি প্লেগকে নিয়েই তৈরি, যদিও এখন প্লেগের কথা বলা হয় না। জার্মানরা অবশ্য শহরটাকে হ্যামিলন বলে না। তাদের উচ্চারণে শহরটার নাম হামেল্​ন্​। বাঙালির পক্ষে দুরুচ্চার্য। বছরে দুই মাসের প্রতি রোববার সেই কাহিনি নিয়ে মুক্তমঞ্চে অভিনীত হয় নাটক। পাশেই ভেবার নদীতে একটি সুড়ঙ্গপথ রয়েছে। বংশীবাদকের পিছু পিছু ইঁদুরবেশী শিশুরা হারিয়ে যায় ওই সুড়ঙ্গপথে।

প্রকৃতির অনেক কিছুই একসময় ঝিমিয়ে পড়ে। মহামারির বেলাতেও তা–ই। তবে জীবনের শেষ বেলায় এসে বিশ্ব মহামারির দেখা পাব, এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি। ভুল বললাম। দেখা তো হয়নি। শুধু শুনে যাচ্ছি। দেখা হলেই তো কম্ম কাবার। ১৯৭১-এ কোথাও যাইনি। নয়টা মাস ভয়ে প্রায় আধমরা অবস্থাতেই দিন কাটত ঘরের মধ্যে। এখনো ঘরের মধ্যেই আছি। একাত্তরে তবু তো ভরসা ছিল। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ ভেসে আসত স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে—সাত কোটি বাঙালিরে দাবায়া রাখতে পারবা না। এখন তো আমরা মনে হয় সতেরো কোটি। করোনা কি আমাদের ‘দাবায়া’ রাখতে পারবে? আল্লাহই জানেন।