মিজান ভাইকে যেমন দেখেছি
গতকাল মারা গেছেন সাংবাদিক ও ‘প্রথম আলো’র যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। তাঁর সঙ্গে থেকে কাজ শিখেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম। এ লেখায় চকিত ভ্রমণের মতো তিনি লিখেছেন মিজানুর রহমান খানের লেখক সত্তা, কাজ এবং তাঁকে দেখার টুকরো টুকরো প্রসঙ্গ নিয়ে।
আমার জন্য শ্রদ্ধেয় মিজানুর রহমান খান ভাইকে নিয়ে লিখতে বসাটা হওয়া উচিত ছিল আনন্দের। কিন্তু না তা হয়নি, শোকের একটা খনি বুকে চেপেই লিখতে হচ্ছে। সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক—এসব পরিচয়ই কি তাঁর জন্য যথেষ্ট? মোটেও না। আমার দেখামতে তিনি এমন একজন লেখক, যাঁর লেখনীতে ভেসে উঠত অসংগতির করুণ চিত্র এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য সংস্কারের রূপরেখা, বাস্তবতা আর নানা সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ। শুধু তা-ই নয়, তাঁর কলমের শক্তিতে হয়েছেও পরিবর্তন। বিশেষ করে আইন অঙ্গনে ছিল তাঁর বিশাল অবদান। এটা সত্যিই একজন লেখক, কলামিস্ট, সাংবাদিকের জন্য পরম প্রাপ্তির বিষয়। তিনি ছিলেন সফল বিশ্লেষক, সূক্ষ্ম ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাশীল ব্যক্তি এবং আইন, সংবিধান ও মানবাধিকার বিষয়ে লেখালেখির এক দিকপাল ব্যক্তিত্ব। কোনো লেখকের লেখা যে এত ধারালো এবং এত গভীর ও বিশ্লেষণধর্মী হতে পারে, তিনি তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত ।
মিজান ভাইকে কেমন দেখেছি? এই প্রশ্নটি কেউ করলে আমার চোখে ভেসে ওঠে কাজপাগল একজন মানুষের ছবি। নিজের জগতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাই বাইরের অনেক কিছুই তোয়াক্কা করতেন না তিনি। যখন কাজ করতেন, এক মনে কেবল কাজই করতেন, অন্য কোনো দিকে খেয়ালই থাকত না। মিজান ভাইয়ের কথা মনে হলে মোটা দাগে এ কথাগুলোই তো মনে হয় প্রথমে।
মিজান ভাই—মিজানুর রহমান খানের কলমের ডগায় রচিত হয়েছে অসংখ্য আইনের বিশ্লেষণ, তিনি লিখেছেন বিচার বিভাগের সংস্কার নিয়ে। বিশেষত স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় এবং বিচার প্রশাসনের কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে তাঁর অবদান নিঃসন্দেহে মাইলফলক হয়ে থাকবে। একটি লেখার শব্দচয়ন থেকে শুরু করে প্রাসঙ্গিকতা, ধারাবাহিকতা ও গভীরতম পর্যবেক্ষণ দিয়ে যে ব্যবচ্ছেদ তিনি চালাতেন, তাতে মনে হতো তিনি শুধু লিখছেন না, পথও দেখিয়ে দিচ্ছেন। কেবল আইন, সংবিধান কিংবা বিচার অঙ্গনই তো নয়, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষণেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার একটি হচ্ছে ‘১৯৭১: আমেরিকার গোপন দলিল, মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড’। এ প্রকাশনার জন্য তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন এবং সরেজমিনে চষে বেরিয়েছেন দেশ-বিদেশ। কথা বলেছেন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশি-বিদেশি অনেক বিশ্লেষকের। ফলে তাঁর এই বইয়ে মার্কিন দলিল থেকে বের করে আনা যেসব সত্য উদ্ঘটিত হয়েছে, তা সব সময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পাবে বলে মনে করি।
মিজান ভাইকে কেমন দেখেছি? এই প্রশ্নটি কেউ করলে আমার চোখে ভেসে ওঠে কাজপাগল একজন মানুষের ছবি। নিজের জগতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাই বাইরের অনেক কিছুই তোয়াক্কা করতেন না তিনি। যখন কাজ করতেন, এক মনে কেবল কাজই করতেন, অন্য কোনো দিকে খেয়ালই থাকত না। মিজান ভাইয়ের কথা মনে হলে মোটা দাগে এ কথাগুলোই তো মনে হয় প্রথমে।
সংবিধানের বিশ্লেষক হিসেবে তাঁর রয়েছে অনবদ্য কাজ। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবিধান পড়িয়েছেনও। সংবিধানের সংশোধনীগুলো নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন, দেখিয়েছেন এর অসামঞ্জস্য। রাষ্ট্রকে দিয়েছেন ভাবনার খোরাক। তাঁর লেখা ‘সংবিধান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক ’, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: এক অশনিসংকেত’ ও ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের স্বরূপ’ বইগুলো একেকটি শক্তিশালী দলিল হিসেবেই আইন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের খোরাক জোগাবে দিনের পর দিন।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়ও উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে মিজানুর রহমান খানের। বিশেষত স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তীকালে শক্তিশালী বিচার প্রশাসন গঠনে তাঁর ছিল অনবদ্য আবদান। আইনজীবী তিনি নন, আইনে পড়াশোনাও করেননি, অথচ তাঁর লেখা পাড়ার জন্য শত শত আইনজীবী এবং বিচারক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতি নিতেন, শিখতেন অনেক কিছু।
একজন লেখক হিসেবে অবশ্যই এটা মিজানুর রহমান খানের সার্থকতা। আইন-আদালত নিয়ে সাহসী ও বস্তুনিষ্ঠ লেখার জন্য মিজান ভাই আদালতের কাঠগড়াও দাঁড়িয়েছেন একাধিকবার। শক্তিশালী ও নির্ভীক লেখক ছিলেন বলেই হয়তো তাঁকে পোহাতে হয়েছিল নানা বাধা-বিপত্তি। তবুও থেমে থাকেননি তিনি। যখন যেখানে কাজ করেছেন, সেখানে লিখেছেন যৌক্তিক বিশ্লেষণ। সর্বশেষ কর্মস্থল প্রথম আলোয় লিখেছেন নানা কিছু, যার মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁর নিখুঁত বিশ্লেষণ। মনে পড়ে, আগাম জামিন নিয়ে তাঁর লেখার সূত্র ধরেই উচ্চ আদালতেও এসেছিল আগাম জামিন বিষয়ে নির্দেশনা। নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন বিচার বিভাগের স্বতন্ত্র গঠন বজায় রাখতে তিনি ছিলেন এক অকুতোভয় সৈনিক। সর্বশেষ ভার্চ্যুয়াল আদালত বজায় রাখার পক্ষেও সোচ্চার ছিলেন তিনি।
আইন বিষয়ের একজন ছাত্র হওয়ার সুবাদে মিজান ভাইয়ের একজন মনোযোগী পাঠক ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই। তারপর তাঁর নেতৃত্বে প্রায় ১০ বছর আইন বিষয়ে সম্পাদনা ও গবেষণার সুযোগ পেয়েছিলাম। বলা দরকার, তাঁর ছাত্রই যেন ছিলাম আমি। এই সুবাদে খুবই কাছ থেকে তাঁকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, পড়াশোনা, জ্ঞানের গভীরতা—এ সবকিছু অনুধাবন করেছি তাঁর কাছাকাছি এসেই। কোনো বিষয়ে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দিলে কীভাবে তাতে খুঁটিনাটি নানা দিক তুলে আনতে হয়, তা আমাকে সূক্ষ্মভাবে শিখিয়েছেন মিজান ভাই। তাঁর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ছিল আইন অঙ্গনের রথী-মহারথী আইনবিদদের। তাঁকে দেখেছি কোনো লেখা লিখতে বসলেই কয়েকজন আইনবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন, নানাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতেন, তারপর লিখতে বসতেন। তাঁর অফিসের ডেস্কে এবং এবং বাসায় যেন আইনের সমৃদ্ধ একটা চেম্বার গড়ে উঠেছিল। দুর্লভ কিছু প্রকাশনা ছিল তাঁর সংগ্রহে। আইনের বিভিন্ন বই, রেফারেন্স, জার্নাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত তাঁর কাজের টেবিলে। আইন, বিচার, সংবিধান, রাজনীতি, কূটনীতি—এই বিষয়গুলো নিয়েই ছিল তাঁর ছিল ভরসা করার মতো পাণ্ডিত্য। সেই মানুষটি আজ নেই।
মিজানুর রহমান খান আজ নেই। তিনি আইনজীবী, বিচারক কিংবা আইন অঙ্গনের কেউ নন। অথচ তিনি আইন অঙ্গনের প্রতিটি মানুষের মন জয় করে তাঁদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিলেন। আইন অঙ্গনের কেউ না হয়েও তিনি ছিলেন আইন অঙ্গনের পরম বন্ধু—এ জন্যই শেষশ্রদ্ধা জানানোর জন্য তাঁর মরদেহ নেওয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে। সম্ভবত আইন অঙ্গনের বাইরে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যাঁর শেষশ্রদ্ধা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গণে হয়েছে। দেশের আইন ও বিচারাঙ্গন মিজানুর রহমান খানের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
প্রিয় মিজান ভাইকে নিয়ে পুরোপুরি লিখতে গেলে, তাঁর কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে হয়তো কয়েক কিস্তি লেগে যাবে। তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বুকের ভেতরে দুমড়েমুচড়ে উঠছে, আমার চোখগুলো অস্পষ্ট হয়ে উঠছে বারবার। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। কারণ মিজান ভাইয়ের সান্নিধ্যে থাকার ফলে তাঁর কাছ থেকে শেখার ও জানার সুযোগ পেয়েছি বিস্তর। তাঁর অকালপ্রয়াণে যে ক্ষতি হলো, তা অপূরণীয়। আইন, সংবিধান ও বিচার অঙ্গন নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ও কর্মগুলো পূর্ণতা পাবে, এটা তো আশা করতেই পারি, না?
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]