
শিল্পী তাঁর শিল্পের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেন নিজস্ব আবেগ, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও নীতিগত অবস্থান থেকে। ফারজানা আহমেদ, সবার কাছে যাঁর পরিচয় উর্মি নামে—তিনিও এর ব্যতক্রম নন। স্বঅভিজ্ঞতা, দৃষ্টি ও চিত্রকলার সম্ভাব্য সীমানা উপলব্ধির প্রশ্নে উর্মির উপস্থিতি ব্যতিক্রমী। সচেতন দৃষ্টি, চারপাশে দ্রুত ধাবমান মানুষ সম্পর্কিত উপলব্ধি ও অঙ্কনশৈলী—এসবই তাঁর শিল্পকর্মের মূল পুঁজি। উর্মির ছবিগুলো তবে কেমন?
বলা যায়, চিত্রপটের আকার, কম্পোজিশন, বিষয়বস্তু উপস্থাপনের কৌশল ইত্যাদি নান্দনিক বিবেচনায় উর্মির ছবিগুলো সমকালীন পোর্ট্রেটচিত্রের কাতারে দাঁড়ায়। তাঁর ছবিতে কখনো নগ্ন, কখনো অতিরঞ্জিত বা বীভৎস আকারে প্রকাশ পায় শহুরে সমাজের জানা ও অজানা অসংখ্য মুখের ভেতরের অভিমান, যন্ত্রণা, রাগ, প্রতিশোধ বা সদৃশ ভাবপূর্ণ আবেগ ও অনুভূতি। আর শিল্পীর এই বীভৎস–দর্শনের মুখোমুখি হয়ে অস্থির হয়ে উঠি আমরা। বুঝতে পারি, এ ছবি আমাদের প্রথাগত একাডেমিক আধুনিক নন্দনবোধ থেকে কিছুটা আলাদা।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পদ্ধতিতে শিল্পশিক্ষা শেষ করার পর সমকালীন হতে চাইলে শিল্পীকে বেছে নিতে হয় নিত্যনতুন পথ। উর্মিও নিজের মাধ্যম হিসেবে কোনো একটি কৌশলে আবদ্ধ থাকেননি। ছাপচিত্রে স্নাতকোত্তর পাশ করার পর বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন মাধ্যম ও সহজলভ্য নানা উপকরণ নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন শিল্পের নানামাত্রিক নিরীক্ষায়। তাঁর বেশিরভাগ চিত্রেই হাতের আঙুলের সাহায্যে রঙের প্রয়োগ লক্ষণীয়। একদিকে মানুষের নিবিড় অনুভূতিকে বোঝার মানবিক প্রবণতা, অন্যদিকে শারীরিকভাবে চিত্রপটের সঙ্গে জড়িত হয়ে চিত্র দৃশ্যায়িত করার তাঁর যে প্রক্রিয়া তা বেশ চিত্তাকর্ষক। কেননা এ প্রক্রিয়ায় শরীর ও মন সংযুক্ত হয়ে একে অন্যকে প্রভাবিত করতে করে। কথাগুলো বললাম ‘নোউন আননোউন’ শিরোনামে উর্মির একক প্রদর্শনী দেখার পর। এ প্রদর্শনীর কিউরেটর শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান ও কেহকাশা সাবাহ।
ছবিগুলোকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় প্রকাশবাদী; এবং তা মূর্ত হয়ে ওঠে মনুষ্য অবয়বে। কিন্তু কাছ থেকে দেখলে চিরচেনা মূর্ততা বিমূর্ততার পানে ধাবিত হয়, রঙ-রেখা-রূপে। মূলত মানুষের সত্তাকে কাছ থেকে দেখার প্রতি উর্মির যে আগ্রহ, তা-ই তাঁর চিত্রমালাকে করে তোলে বিমূর্ত-প্রকাশবাদী। আবার এই অবয়বগুলোর গঠন প্রক্রিয়ায় বহিরাবরণ এবং বিস্তৃত চোখের মাঝখানে একইসঙ্গে যে অস্তিত্ব ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ পায়, তা স্পষ্টতই দ্ব্যর্থক ইঙ্গিতবাহী।
আমাদের দেহ আর আত্মাকে প্রতিবিম্বায়িত করে যেমন অন্য এক ভাষা গড়ে ওঠে, তেমনি ছবিতে দেহ ও আত্মাকে মিলিয়ে শিল্পীও যেন জানতে চেয়েছেন, ধরতে চেয়েছেন অজানা সেই ভাষাকে। ফলে উর্মির শিল্পকর্মের চরিত্রের মধ্যে এসেছে দোদুল্যমানতা; কখনো মূর্ত থেকে বিমূর্ত, অথবা এর বিপরীত। আবার কখনো সুন্দর থেকে বীভৎস, গাঢ় থেকে হাল্কা রঙে ফুটে ওঠেছে তাঁর ছবিগুলো।
ঢাকা আর্ট সেন্টারে ১৬ অক্টোবর শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হয়েছে ২৩ অক্টোবর। শেষ দিনে ছিল কিউরেটর ও শিল্পীর সঙ্গে বিশেষ আলোচনা পর্ব।