মেঘ ও বৃষ্টি উদ্যাপন

রিমাইন্ডার-১, শিল্পী: নাজমা আক্তার
রিমাইন্ডার-১, শিল্পী: নাজমা আক্তার

দৃশ্যশিল্পে মূর্ত, বিমূর্ত রূপ নিয়ে দর্শক দ্বিধায় পড়েন। নাজমা আক্তার ক্যানভাসে তাঁর কথা বলেন রঙে, বর্ণে, সুরে, ছন্দে। ছবিতে স্মৃতি এসে ভর করে। আবার প্রকৃতির ছন্দে মেতে ওঠেন কখনো। ইউরোপীয় শিল্পধারায় এ ধরনের সৃষ্টিকর্মকে আলাদা করে বলা হয় বিশুদ্ধ বিমূর্ততা। বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনে বিমূর্ত শিল্পীর কারিগর মোহাম্মদ কিবরিয়া শুধু রং, রেখা, বুনট (টেক্সচার) নিয়ে দীর্ঘ সময় নিরীক্ষা করেছেন। নাজমা আক্তার মোহাম্মদ কিবরিয়ার উত্তরসূরি। এ প্রদর্শনীতে দর্শক একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এভাবে—শিল্পকর্মগুলো আলোকচিত্রের মতো সরাসরি না বলে একটি দৃশ্যকল্পের চুম্বক অংশকে নিয়ে সৃষ্ট। রং ও আকার এখানে মুখ্য। বর্ণনাপ্রধান শিল্পভাষা নির্মাণ হয়নি। পরিত্যক্ত ঘরদোর, বৃষ্টিমুখর দিনের আলো-ছায়া, উত্তাল লালরঙা দিন, শোকাবহ ঘুটঘুটে অন্ধকার, নদীর গায়ে চন্দ্রালোক এমন অসংখ্য মুহূর্ত হাজির করেছেন ক্যানভাসের গায়ে। দুটো ভাগে নাজমা আক্তারের কাজ বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত, রংপ্রধান ক্যানভাস হিসেবে এ ক্যানভাসগুলো বিবেচিত হয় কি না। বলা চলে রঙের লেপনের সঙ্গে বর্ণ বাছাইয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক রঙের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিল্পী। দৃশ্য ইন্দ্রিয়ের প্রধান উপকরণ আলোকে তাঁর ক্যানভাসে উপস্থিত করেছেন। মানুষের কাছে খাদ্য, বায়ু, জলের অপরিহার্যতার মতই ছবির মধ্যে আলোর উপস্থিতি ছবির জন্য প্রয়োজনীয়। নাজমা আক্তারের কাজে রঙের প্রলেপের সঙ্গে আলোর খানিক উপস্থিতি সুর তৈরি করেছে। বর্ণের বিভিন্নতায় আকৃতি একটির চেয়ে আরেকটি আলাদা হয়ে দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, আকৃতি আর রেখার ব্যবহারে চিত্রতল যে সাজে সেজেছে তার মধ্যে বর্ণের খোপে আকৃতি ম্রিয়মাণ। রেখা ও আঁচড়ে সরে যাওয়া জমিনের রঙে গতি অপ্রতুল। অনুভূতির গভীরে অনুরণিত হয় না এমন রেখা কি ক্যানভাসে শক্তি জোগায়? শিল্পী হয়তো একটি স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন। ধূসর, কালো, মেটে হলুদ রং আর আকস্মিক লালের উপস্থিতি স্মৃতি-কথনে রূপ নেয়। সংগীত আর প্রকৃতির ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে দেন ছবির বিষয়। নাজমা আক্তারের ছবি দর্শকদের মনে জিজ্ঞাসা তৈরি করে। অ্যাক্রিলিক রঙের প্রলেপের আগে বুনট ব্যবহার করে চিত্রতল অমসৃণ করেছেন। স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ দুটি মাধ্যমেই তিনি সিদ্ধহস্ত। জলরঙের ধোয়া পদ্ধতিতে চিত্রতলে যে রূপ সৃজিত হয় তার বিপরীত রূপ এখানে রয়েছে। অন্তর্গত উপলব্ধি, অনুভূতির প্রকাশ, শান্ত, উদ্বেল, সুর আর ছন্দের প্রবহমান ঝংকারধ্বনি নাজমার ক্যানভাসে জারিত হয়েছে। বিষয় উল্লেখ করে কিছু কাজকে আমরা পাঠকের জন্য আলাদা করে নিই। ‘অ্যা অ্যাবনডেন্ড হাউস’ শিরোনামের কাজে উজ্জ্বল লাল রঙের দেয়ালের ভেতর থেকে ভাঙা দরজা উঁকি দিচ্ছে। কালো রঙের তৈরি সারফেসে আঁকিবুঁকি পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়ির রূপ স্পষ্ট করেছে। ‘অ্যা ডে অব রেড গ্রে, অ্যান্ড ব্ল্যাক’ শিরোনামের কাজে লাল রঙের স্রোত নিম্নমুখী। কালো জমিনে শিল্পীর দেখা কালো অধ্যায়ের স্মৃতি সামনে এনেছেন। ‘রিমাইন্ডার’ সিরিজের কাজে রঙের ব্যবহার পরিমিত। কাগজের ওপর অ্যাক্রিলিকের প্রলেপে রঙের স্তর স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রদর্শনীর মোট ৬১টি চিত্রকর্মের মধ্যে একটির সঙ্গে আরেকটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। চেনা-জানা দৃশ্যকে প্রতীকের সাহায্যে বা কখনো রঙের প্রলেপে বলে দিয়েছেন দৃশ্যলোকের বিস্তারিত পাঠ। বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে গত ১ মার্চ শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী শেষ হবে ১০ মার্চ।