ম্যারাডোনাকে কেন বাঙালি এত ভালোবাসে

দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দূরের আর্জেন্টিনাকে এই দেশের মানুষ ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছে। ফুটবলের সূত্রে তো বটেই, তবে তার চেয়েও বড় যোগসূত্রের নাম ডিয়েগো ম্যারাডোনা, সেই ফুটবলার, যিনি খেলাটাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ম্যারাডোনাকে বাঙালিদের ভালোবাসার কারণ কি শুধু তাঁর ফুটবল খেলা, নাকি অন্য কারণও আছে?

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার দূরের দুটো দেশ। দূরত্বের চেয়েও বেশি দূরত্ব দুই দেশের ভাষা ও সংস্কৃতিতে। কিন্তু মিল আছে একখানে। আবেগের উথলানো জোয়ারে। দুই দেশের মানুষই ভীষণ রকমের আবেগী।

আর সেই আবেগটাই যেন নাড়ির বন্ধন হয়ে গেছে বাংলাদেশের মানুষের কাছে। দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দূরের আর্জেন্টিনাকে এই দেশের মানুষ ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছে। ফুটবলের সূত্রে তো বটেই, তবে তার চেয়েও বড় যোগসূত্রের নাম ডিয়েগো ম্যারাডোনা, সেই ফুটবলার, যিনি খেলাটাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। অনেক দূরের সেই দেশের সেই খ্যাপাটে, অত্যাশ্চর্য ফুটবল নৈপুণ্যে মোহিত করা মানুষটাকে বাংলাদেশ নিজের ঘরের ছেলের মতো ভালোবাসা দিচ্ছে ৩৪টা বছর ধরে।

১৯৮৬ সালের মেহিকান ঢেউ এই বঙ্গীয় বদ্বীপে আছড়ে পড়েছিল শুধু তাঁরই কারণে, সেবারই তিনি উঁচিয়ে ধরেছিলেন আরাধ্য সোনালি শিরোপাটা। সেই ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা নেই—জীবনকে পেছনে ফেলে চলে গেছেন অসীম শূন্যতায়—আমাদের বুকের ভেতরে এটা যে একটা তীব্র মোচড় দেবে, এটিই কি স্বাভাবিক নয়!

আর সেই মোচড়ের প্রমাণ হাতেনাতেই মিলেছে, বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এখন ম্যারাডোনাময়।

কোন দূর দেশের ম্যারাডোনার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিজীবনের কী যোগ? এ প্রশ্নে খুব সহজ উত্তর হতে পারে, যিনি যাপিত জীবনের শত যন্ত্রণা, পাওয়া না–পাওয়ার মধ্যে একটু নির্মল আনন্দ দিয়েছেন, তাঁর প্রতি একটা নির্মোহ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থাকতেই পারে। এর বাইরেও ম্যারাডোনার কী প্রভাব থাকতে পারে, তার ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। ছেলেবেলায় টেলিভিশন দেখার একমাত্র উপায় ছিল প্রতিবেশীদের বাসায় ঢুঁ মারা। তখন যাঁর বাসায় অন্তত সাদাকালো টেলিভিশন আছে, তাঁরও কত শ্লাঘা! প্রতিবেশীর বাসায় খুব সংকোচমনে টিভি দেখার এই যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্তি দিয়েছিলেন একজন—ম্যারাডোনা। তাঁর খেলা দেখবেন বলেই ’৯৪ বিশ্বকাপের আগে বাবা একটা রঙিন টেলিভিশন কিনে পুরো পাড়ায় বিরাট হইচই ফেলে দিয়েছিলেন! শৈশবে ম্যারাডোনার প্রতি এমন কৃতজ্ঞতা নিশ্চিত আরও অনেকের আছে।

বাঙালির এই উন্মাদনা নিয়ে ম্যারাডোনার সাড়া জাগানো আত্মজীবনীর ‘এল ডিয়েগোর’ শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রসঙ্গের সূত্র ধরে আছে বাংলাদেশের নাম। মূল স্প্যানিশ থেকে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মার্সেলা মোরা আরাউজো। বইটি শুরুই হয়েছে আরাউজোর ভূমিকা দিয়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘মনে আছে, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের হয়ে কাজ করার সময় একটা প্রতিবেদন নিয়ে গবেষণা করছিলাম। সে সময় খুঁজে পেয়েছি, ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাকে যখন বহিষ্কার করা হলো, বাংলাদেশে এত মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, সেটা রীতিমতো গণ-আত্মহত্যা চেষ্টায় রূপ নেয়।’

তুলনারহিত তাঁর ফুটবলজাদু, তাঁর বর্ণিল ক্যারিয়ার কিংবা বিচিত্র রঙে আঁকা তাঁর জীবনের ক্যানভাসটা আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে দিনের পর দিন। একজন ম্যারাডোনা সাদা, আকাশি–নীল জার্সি গায়ে তুলেছিলেন বলেই তো হাজার হাজার মাইল দূরের এক দেশে অযুত–নিযুত আর্জেন্টিনাভক্ত তৈরি হয়েছে। অথচ ম্যারাডোনা-যুগ শেষে আর্জেন্টিনার বলার মতো কোনো সাফল্যই নেই, অন্তত শিরোপা বিচারে। কিন্তু ম্যারাডোনা সেই যে জাদু দেখিয়ে গিয়েছিলেন, তার ঘোর যেন রয়ে গেছে আজও! প্রতি চার বছর অন্তর বিশ্বকাপ এলেই বাংলার আকাশ ছেয়ে যাবে ছোট–বড় শত–সহস্র আর্জেন্টিনার পতাকায়। পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল কিংবা চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি–ইতালি সমর্থকদের সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবে আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা। কারণ, তাঁদের উদাহরণ হিসেবে আছে একজন ম্যারাডোনা।

বাঙালির এই উন্মাদনা নিয়ে ম্যারাডোনার সাড়া জাগানো আত্মজীবনীর ‘এল ডিয়েগো’র শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রসঙ্গের সূত্র ধরে আছে বাংলাদেশের নাম। মূল স্প্যানিশ থেকে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মার্সেলা মোরা আরাউজো। বইটি শুরুই হয়েছে আরাউজোর ভূমিকা দিয়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘মনে আছে, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের হয়ে কাজ করার সময় একটা প্রতিবেদন নিয়ে গবেষণা করছিলাম। সে সময় খুঁজে পেয়েছি, ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাকে যখন বহিষ্কার করা হলো, বাংলাদেশে এত মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, সেটা রীতিমতো গণ-আত্মহত্যা চেষ্টায় রূপ নেয়।’

১০ নম্বর জার্সি পরা ম্যারাডোনা তাঁর খেলা দিয়ে বাঙালির মন জিতে নিয়েছিলেন
ছবি: সংগৃহীত

সেই বিশ্বকাপে ডোপ টেস্টে ধরা পড়েছিলেন ম্যারাডোনা। তিনি এ দেশের কেউ নন, আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়লে বাংলাদেশের ক্ষতি বা লাভের কিছুই নেই, কিন্তু ঠিক আগের দুটো বাক্য মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে এ কারণে, কোনো সম্পর্ক না থেকেও যেন কী এক অদ্ভুত সম্পর্কে যেন বাঁধা আছে বাংলাদেশ আর আর্জেন্টিনা। ফলে ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার শোকে পুরো বাংলাদেশ কেঁদে ওঠে। অনেকেই আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলতে চায়।

আজ এতগুলো বছর পরেও, বাংলাদেশের কোনো চায়ের দোকানে হয়তো আপনি মশগুল আড্ডার ছেঁড়া সংলাপে শুনতে পাবেন, ‘...সেটা ছিল ম্যারাডোনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’

তাঁর বেপোরায়া জীবন, অকপট বক্তব্য–মন্তব্যও কম আলোড়িত করেনি মানুষকে। ম্যারাডোনার আত্মজীবনের ইংরেজি অনুবাদক মার্সেলা তাই লিখেছেন, ‘নিজের অনুভূতি প্রকাশে তিনি কখনো ভয় পাননি। লেট অ্যালোন হিজ মাইন্ড।’ ম্যারাডোনার বিতর্কিত সব কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তাঁর ’৮৬ বিশ্বকাপজয়ী দলের সতীর্থ হোর্হে ভালদানো একবার লিখেছিলেন, ‘ফর সো মেনি ইয়ার্স উই হ্যাভ টোল্ড হিম রিপিটিডলি, ‘‘ইউ আর আ গড, ‘‘ইউ আর আ স্টার’’, ইউ আর আওয়ার স্যালভেশন’’, দ্যাট উই ফরগেট টু টেল হিম দ্য মোস্ট ইম্পর্টেন্ট থিং: ‘‘ ইউ আর আ ম্যান’’।’

ভালদোনা যে ভুলে যাওয়ার কথাটা বললেন, এটা কিন্তু সচেতনভাবেই। নইলে ’৯৪ বিশ্বকাপের ওই ঘটনার পরও ম্যারাডোনার প্রতি ভালোবাসা এতটুকু না কমে উল্টো বাড়বে কেন! ম্যারাডোনা নিজেও অবশ্য মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছেন ’৯৪ বিশ্বকাপের ঘটনাটা একটা ষড়যন্ত্র। এই সত্য তিনি উদ্‌ঘাটন করেই ছাড়বেন, তাতে যদি সারা জীবন লেগে যায় লাগবে। আত্মজীবনীতে আর্জেন্টিনা কিংবদন্তি লিখেছেন, ‘আমি সব সাক্ষ্য–প্রমাণ জোগাড় করতে চাই, একদিন এটা আমি পাবই। তখন ফিফার কাছে যাব। হয়তো সেদিন আমার বয়স ৬০ হয়ে যাবে। আমি যাব, ওদের দরজায় লাথি মারব এবং সত্যটা খুঁজে বের করব।’

কী আশ্চর্য, ম্যারাডোনা এত সংখ্যা বাদ দিয়ে কেন শুধু ৬০ সংখ্যাটাই উচ্চারণ করেছিলেন! ‘ঈশ্বরের হাত’ যিনি পেয়েছিলেন, তিনি কি ইঙ্গিত পেয়েছিলেন ঈশ্বর তাঁকে ৬০ বছরের জীবন দেবেন!

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]