মড়ক

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

বাপ–মা নাম রেখেছিল গোলাপি। আদর করে, নাকি অন্য কোনো নাম মনে পড়েনি বলে গোলাপি রাখা হয়েছিল, তা জান্নাতির মা জানে না। হ্যাঁ, গোলাপি এখন জান্নাতির মা। জান্নাতির বয়স মোটে সাত বছর। ছোটখাটো গড়ন। ঠিক গোলাপির মতোই। তফাত একটা আছে। গোলাপি গোলাপ দেখার সুযোগ না পেলেও জান্নাতি পায়। চোখে দেখতে পায় বলেই তো গোলাপি তার নাম রেখেছে জান্নাতি।

গোলাপির চোখের সমস্যা জন্মের পর থেকেই। মেয়ে বলে বাপ চিকিৎসায় খুব একটা মনোযোগ দেয়নি। খুব কম সময়েই তাই চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে গোলাপি। সেটা ঠিক কবে থেকে, তা-ও তার মনে নেই। শৈশবের শুরুর দিকের ঘটনা তা। গোলাপির শুধু চোখে ভাসে আবছা আলো। ওইটুকুই তার আলোকিত স্মৃতি। বাকি সব কালো।

অন্ধ বলেই শেষমেশ নূর আলমের সঙ্গে সংসার টিকল না গোলাপির। নূর তার বাবার মতোই রিকশা চালাত। তবে গোলাপির বাবা ছিল গ্রামের রিকশাওয়ালা, আর নূর শহরের। ফলে নূরের ভাবসাব একটু আলাদা ছিল। আরও আলাদা হয়ে যায় গোলাপিকে নিয়ে শহরে আসার পর। পোয়াতি হতে বেশি সময় নেয়নি গোলাপি। তারপরও নূরকে ধরে রাখা যায়নি। ছেলে হলে হয়তো ধরে রাখা যেত। এই আফসোস গোলাপির আছে।

তবে জান্নাতি যে পুরোপুরি তার মতো নয়, এতেই এখন শান্তি খোঁজে গোলাপি।
একটা খুব ছোট্ট গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছিল গোলাপি। কাজ তেমন কঠিন কিছু নয়, তবে সময় বেশি দিতে হতো। তা-ও ভালো। মালিক ভালো ছিল। দিনমজুরি যা দিত, চলে যেত মা-মেয়ের। কিন্তু মড়ক এসেই বিপদে ফেলেছে গোলাপিকে।

হুট করেই ১০-১২ দিনের ছুটি পেয়েছে গোলাপি। সঙ্গে এক দিনের অতিরিক্ত বেতন। কিন্তু এক দিনের বেতনে কি আর তিন দিন চলে? তা-ও গোলাপি তিন দিন টেনেটুনে চালিয়েছে। চতুর্থ দিনে এসে গোলাপির অন্ধকার জগতে নতুন করে কালো রঙের ছিটে লেগেছে।

মড়কের দিনে তাই বেজায় বিপদে পড়েছে জান্নাতির মা। জান্নাতির কোনো সমস্যা নেই। খিদে পেলেই মায়ের কাছে খাবার চাইতে পারে। কিন্তু গোলাপি পারে না। পরিচিত প্রতিবেশীরা নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত। কে দেবে সাহায্য? ঠ্যাকা কিসের?

শেষ চেষ্টা হিসেবে পাশের ঘরের করিমনের কাছে গিয়েছিল জান্নাতির মা। করিমনের জামাই ব্যাটারিচালিত রিকশা চালায়। করিমন গোলাপির সঙ্গেই কাজ করে। গোলাপিকে দেখে মুড়ির কৌটা এগিয়ে দেয় করিমন।
অবস্থা কী হইব রে? ট্যাকা তো শ্যাষ...

আমগোরও একই। সবাই ঘরে থাকলে কেমনে কী? জামাই বাইর হইসিল, পুলিশের বাড়ি খাইসে। পয়সা কামাইতে গিয়া উল্টা খরচ করা লাগসে।
চলুম ক্যামনে? কিচ্ছু বুঝবার পারতেছি না...

মড়কের দিনে তাই বেজায় বিপদে পড়েছে জান্নাতির মা। জান্নাতির কোনো সমস্যা নেই। খিদে পেলেই মায়ের কাছে খাবার চাইতে পারে। কিন্তু গোলাপি পারে না। পরিচিত প্রতিবেশীরা নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত। কে দেবে সাহায্য? ঠ্যাকা কিসের?

ওই শোন, তোরে কওয়া হয় নাই। কাইল এখানে প্যাকেট খাওন দিছিল। বিভিন্ন বাড়িত যা। চাইল-ডাইল পাইতে পারস। জান্নাতিরে নে লগে। কিছু না কিছু পাইবি। তোরে আরও বেশি দিব। জান্নাতিরে আমি শিখায় দিতেসি।

এইডা ছাড়া আর কী করবাম। যাই... তুই শিখায় দে জান্নাতিরে।
হেইডা কইতেছি। তয় বেশি পাইলে আমারেও কিছু দেইস...
আইচ্ছা।

চুক্তি মোতাবেক জান্নাতিকে সব শেখায় করিমন। গোলাপি বেরিয়ে পড়ে।
প্রথম বাড়িতে অবশ্য কেউ উত্তরই দিল না। দ্বিতীয় বাড়িতে গেটের ভেতর থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে মা-মেয়ে ভয় পেয়ে পালায়। জোরে পা চালাতে গিয়ে উষ্টা খায় গোলাপি। ব্যথা পেলেও তা সয়ে যাবে বলেই মনে মনে ভেবে নেয় জান্নাতির মা। এমন হোঁচট জীবনে কত খেয়েছে!

পাঁচ বাড়ি ঘুরে অবশেষে সাহায্যের দেখা পেল গোলাপি। জান্নাতি জানাল, অনেক উঁচু বাড়ি। গোলাপিকে দেখেই তারা হয়তো বুঝেছিল। এই প্রথম চোখে অন্ধকার দেখাকে আশীর্বাদ বলে মনে হলো গোলাপির।


একটা পোঁটলা জান্নাতির হাতে দেওয়ার খবর পেল গোলাপি। তা পেয়েই মেয়েকে মায়ের প্রশ্ন, ‘কী দিসে রে?’

‘আমি তুলবার পারি না’, বলেই জান্নাতির চিৎকার, ‘আম্মা, আলু দিসে!’ ডিম-আলুর সালুন জান্নাতির খুব পছন্দের।

‘ছেরি, খালি আলু দেহস’, রাগ উঠে যায় গোলাপির। ‘চাল আছে কি না, দেখ ছেরি, আলু খাইয়া প্যাট ভরব? খালি আলু দেহে...’

‘দেহা যায় না তো, বুঝবার পারি না... তুমি খুঁইজা নেও...’—আহ্লাদি কণ্ঠে বলে জান্নাতি।
এবার আর সামলাতে পারে না গোলাপি। মেয়ের পিঠে দুই ঘা বসিয়ে দিয়ে পোঁটলা নিজের দিকে টানে। সুনসান রাস্তায় জান্নাতির কান্না বেশি জোরেই কানে লাগে। তা অগ্রাহ্য করেই ব্যস্ত হয়ে পোঁটলায় হাত গলায় জান্নাতির মা। তখন মেয়ের কান্নার চেয়ে নিজের বুকের ঢিপঢিপ শব্দই বেশি কানে বাজছিল তার।

একটু হাতড়াতেই একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে হাত ঠেকে গোলাপির। মুখে হাসি ফোটে তার। পোঁটলার মুখ বন্ধ করে জান্নাতিকে কাছে টেনে নেয় তার মা। শুরু হয় মেয়ের কান্না থামানোর চেষ্টা। তাতে রসদ জোগায় সদ্য পাওয়া সুসংবাদ।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]