যে তাকে ছেড়েছে, ফিরে ফিরে গিয়েছে অনেকবার...

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এই লেখার কাব্যময় গদ্যে উন্মোচিত হয়েছে বিদ্যায়তনের এক ভিন্ন রকম মুখাবয়ব।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অমর একুশে‘ অবলম্বনেকোলাজ: মনিরুল ইসলাম

জাহাঙ্গীরনগর আমাদের লুকোচুরির বন। আমরা যারা লুকোতে চাইতাম তাদের আশ্রয়, যারা প্রকাশ হতে চাইতাম, তাদেরও। এ এক ছিন্ন দ্বীপ, বিজন প্রান্তর। আমরা দূরদূরান্ত থেকে সেখানে গিয়েছিলাম, কেউ পদ্মা পার হয়ে, কেউ যমুনা, লঞ্চে করে, ট্রেনে চড়ে, সমতল কিংবা পার্বত্য চড়াই-উতরাইয়ের পথ বেয়ে। সেখানে শিখতে গিয়েছিলাম। জ্ঞানের জন্য। আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য। জীবনের জন্য।
সে এক দারুণ প্রাঙ্গণ। সারি সারি গাছ, গাছে গাছে ফুল, বড় বড় দিঘি, বহু বাঁকের পথ, ছোট ছোট টিলা, শাপলা–ফোটা সরোবর। আমাদের শরীরে নানাস্থানের জল–হাওয়ার গন্ধ। কথায় নানা রকম সুর। কিন্তু যেন সবাই মিলে সেখানে আরেকটা দেশ।
আমাদের ঘুরেফিরে দেখা হতো পরস্পরে, কারণ এ এমন এক বিদ্যালয়, কোনো এক গ্রামের মতো, যেমন গ্রামের কোনো পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে দিনের কখনো সবার সঙ্গে একবার না একবার দেখা হয়ে যাবেই। সেখানে ব্যাপক ভালোবাসা হতো। নানা ধরন গাছ, ঝোপ, ঝাড়, এই প্রেমের লুকোচুরির আশ্রয়। যেন আমরা নিজেদের ঘর–পরিবার ছেড়ে সেখানে গিয়ে হয়ে উঠেছিলাম আরেকটি বিশাল পরিবার। এত সখ্য ভাব আর কোনোখানে হতে পারে, জানা নেই।

সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে যেমন হৃদয়ের লুকোচুরির খেলা হতো শুরু, তেমনি দুনিয়া-পেটানো হইহুল্লোড় জমে উঠত নানান জায়গায়। চৌরঙ্গী, ডেইরি ফার্ম, প্রান্তিক...কত জায়গা। সন্ধ্যার জমাট অন্ধকারকে ভেঙেচুরে ঘটত স্পর্ধিত কণ্ঠের বিচ্ছুরণ।

কে কোথায় কী রচনা করেছেন, কার ভাবের মধ্যে কিসের খামতি, কার সঙ্গে কার কিসের বিচ্যুতি, কী করে আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে, কোথায় এখনো আশার আলো ফুটে উঠছে, কোথায় অন্যায়, ন্যায়—সব সব যেন সেখানেই কণ্ঠে কণ্ঠে আলোচিত হয়ে তুলত নিনাদ। আমাদের বন্ধুতা কেবল নয়, শত্রুতাও হতো। কখনো মতান্তরে, ভাবনার দ্বন্দ্বে, হিংসায়, ঈর্ষায়, কখনোবা বালসুলভ অভিমানে। সে মিটেও যেত। সংসারে যেমন ঘটে। আমরা এ অন্যকে ঠারাতে ঠারাতে দেয়ালে ঠেকিয়ে দিতাম পিঠ, তারপর হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিয়ে আসতাম ফের নিজেরই চলার রাস্তায়, হাতে হাত রেখে কৃষ্ণচূড়া-গন্ধ-মাতানো পথে। শীতের কুয়াশা মেখে দূর থেকে ভেসে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, জলে শুয়ে থাকে, ডুব দেয়, খুনসুটি করে, উসকায় হৃদয়। আমরা তাদের দেখতে দেখতে জীবনের কত-না মানে খুঁজেছি, ভালোবেসেছি। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কখনোবা আমাদের চোখে ফুলকি জ্বেলে দিত সংশপ্তক। মুক্তমঞ্চে কারও ঝাঁজালো কণ্ঠের গান জানাত মুক্তির এখনো আছে বাকি!

এখানে অন্যায়ও হতো, হয়। সংসারে যেমন ঢোকে বিষ, বিষবৃক্ষ রোপিত হয়, তেমনই এখানেও। ক্ষমতার অপব্যবহারে, লালসায়, লোভে জুলুম, জবরদস্তি এখানেও হয়েছে, হতো, হয়। নিপীড়িত, লাঞ্ছিত হয়েছে নারীও। আমরা শিউরে উঠেছি, কেঁপেছি, উপায় খুঁজেছি। তবু এই সংসারে অন্যায়ে সমঝোতা হতো না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া তো অন্যায়ই। তাই মুষ্টিবদ্ধ হতো হাত। চোখে আগুন, শিরদাঁড়া টান টান। এই কম্প্রমান প্রাণগুলো জড়ো হতো, হতে থাকত। সবুজ প্রান্তরে রক্তের লালিমাও পড়েছে ছোপ ছোপ। তবু এই প্রাঙ্গণে ফের ফের অমানিশার জাল ছিন্ন করে সূর্য উঠেছে। জয়হাস্যমুখ নিয়ে।

কে কোথায় কী রচনা করেছেন, কার ভাবের মধ্যে কিসের খামতি, কার সঙ্গে কার কিসের বিচ্যুতি, কী করে আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে, কোথায় এখনো আশার আলো ফুটে উঠছে, কোথায় অন্যায়, ন্যায়—সব সব যেন সেখানেই কণ্ঠে কণ্ঠে আলোচিত হয়ে তুলত নিনাদ। আমাদের বন্ধুতা কেবল নয়, শত্রুতাও হতো। কখনো মতান্তরে, ভাবনার দ্বন্দ্বে, হিংসায়, ঈর্ষায়, কখনোবা বালসুলভ অভিমানে। সে মিটেও যেত। সংসারে যেমন ঘটে। আমরা এ অন্যকে ঠারাতে ঠারাতে দেয়ালে ঠেকিয়ে দিতাম পিঠ, তারপর হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিয়ে আসতাম ফের নিজেরই চলার রাস্তায়, হাতে হাত রেখে কৃষ্ণচূড়া-গন্ধ-মাতানো পথে। শীতের কুয়াশা মেখে দূর থেকে ভেসে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, জলে শুয়ে থাকে, ডুব দেয়, খুনসুটি করে, উসকায় হৃদয়। আমরা তাদের দেখতে দেখতে জীবনের কত-না মানে খুঁজেছি, ভালোবেসেছি।

জাহাঙ্গীরনগর এক আশ্চর্য আশ্রম! নিরেট জ্ঞানের চর্চার এক জায়গা প্রকৃতির এমন সাজানো মমতায় আগলে থাকার হদিস তো খুব বেশি নেই। তাই এখানে প্রথাগত জ্ঞানের আগল ভাঙার সাধন হতো বেশি। আমাদের সেই আগল ভাঙার গানে সুর তুলতেন অনেকজনই। রফিক, সেলিম, আনু (মোহাম্মদ রফিক, সেলিম আল দীন, আনু মুহম্মদ)...কতজন! খুলে দিত ভাবনার বন্ধ জানালা, হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ত উষাকালের আভা, নির্ঝরের গান, আমরা তারপর নিজেদের গান বেঁধে নিতাম।

এ এক শান্ত-অলস-সুন্দরের তপোবন যেন। এখানে তেমন কোনো তাড়াহুড়ো নেই; বরং আমরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছি জীবনের মধু। জটলায়, আড্ডায়, সান্ধ্য ভ্রমণে, কখনোবা ঘরের ভেতর। এত বিচিত্র ভাবের সমাবেশ এক বিরল ব্যাপার। প্রকৃতির বিশাল-ব্যাপ্ত উদার আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা নিকেতন, তাই যেন এখানে আমরা বারবার ফিরে তাকিয়েছি আপন মাটির দিকে, নিজের ভিতের উৎসমূলে। নিজেদের পরিচয় বিস্মরণদূর থেকে কাছে টেনে চিনতে চেয়েছি নতুন করে।

এবং আমরা ভালোবেসেছি। আমাদের পাঠের-জ্ঞানের আলাদা সীমানাগুলো অতিক্রম করে আমরা মিলিত হয়েছি মুক্ত প্রান্তরে। কোনো কিছু অচেনা ঠেকেনি। শ্রেণিকক্ষ ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু তার বাইরে সবাই প্রায়ই একাকার হয়ে গিয়েছি ভাবের জোয়ারে। আমাদের চলার পথগুলো নানা রেখা ধরে মিশে যেত। এভাবেই তৈরি পথগুলো। সব পথ মিশে গেছে এক ঠিকানায়। হাঁটতে বেরোলে টের পাওয়া যেত। ঘুরেফিরে আসে চেনা মুখ, অচেনাও দেখে দেখে চেনা হয়ে যায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের ভালোবাসা। নস্টালজিয়া। বন্ধুতা। সমঝোতা। মোকাবিলা। আমাদের লুকোচুরি ভরা সংসার।
যে তাকে ছেড়েছে, ফিরে ফিরে গিয়েছে অনেকবার...
যেতে হয় বলে।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]