রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে যত কাণ্ড
>রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি নিয়ে আমরা যেমন মাতোয়ারা, তেমনি নোবেল পাওয়ার পর থেকে তাঁকে ঘিরে ‘অবুঝ’ ভক্তকুলের কাণ্ড-কীর্তিও ছিল বলার মতো। তার কয়েকটি নিদর্শন
যদি বলা যায়, কম বয়সে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার শাস্তি কী? উত্তর হলো, বহু বছর পুরস্কারের ভার বহন করতে হয়, সহ্য করতে হয় ভক্তদের মধুর ‘যন্ত্রণা’। এই ভার ও যন্ত্রণা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বইতে হয়েছে ২৮ বছর। কবিতা লিখে ১৯১৩ সালে যখন নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন, তারপরও কবিতা লেখার আর কোনো মানে আছে! যা হোক, ২৭ বছর পুরস্কারের ভার বহন করার পর তিনি লিখলেন ‘মাছিতত্ত্ব’: ‘মাছি বংশেতে এল অদ্ভুত জ্ঞানী সে।/ সাধনের মন্ত্র তাহার/ ভন্ ভন্ ভন্ ভন্কার।/ সংসারে দুই পাখা নিয়ে দুই পক্ষ/ দক্ষিণ বাম আর ভক্ষ্য-অভ্যক্ষ/ কাঁপাতে কাঁপাতে পাখা সূক্ষ্ম অদৃশ্য/ দ্বৈতহীন হয় বিশ্ব।/ তারপর: সুগন্ধ পচা গন্ধের/ ভালো মন্দের/ ঘুচে যায় ভেদ-বন্ধন,/ এক হয় পঙ্ক ও চন্দন।’
রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভার ‘মাছিপ্রকাশ’ পর্বটি আসার আগেই তাঁকে একটি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। একই সঙ্গে ‘গুরুত্ব’ ও ‘দেবত্ব’—দুই ভার নিয়ে গুরুদেব তখন যে কতটা বেকায়দায় ছিলেন, তা তিনিই ভালো বলতে পারতেন। তবে তাঁর আশপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও কখনো কখনো হতভম্ব হয়ে পড়তেন ভক্তকুলের নানা ঘটনায়। নানাজন বিভিন্ন লেখাজোকায় তুলে ধরেছেন সেসব।
দেবদর্শনে এসেছেন অনেকেই। রানীচন্দ লিখছেন: ‘বিচিত্র রকম অতিথি আসত গুরুদেবের কাছে। তাদের সবাইকে তিনি সয়ে নিতেন। একবার এক মান্যগণ্য বিশিষ্ট ভদ্রলোক এলেন সস্ত্রীক। গুরুদেবের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, ভদ্রমহিলাও বুঝি ভাবলেন, কিছু একটা বলা উচিত। তাঁদের কথার মধ্যে হঠাৎ বলে উঠলেন, “আচ্ছা, রবি বাবু, আপনি এখনো কবিতা-টবিতা লেখেন?” আমরা শুনে থ। গুরুদেব একটু হকচকিয়ে গেলেন। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে গম্ভীর মুখে নিমীলিত নেত্রে বললেন, “তা, হ্যাঁ, এখনো একটু লিখি বৈকি।” পাগল—পাগল আসত কত রকমের। এত রকমের পাগল যে সংসারে আছে গুরুদেবের কাছাকাছি থেকে না জানলে তা ভাবতে পারতাম না কখনো।’
রানীচন্দ্র থেকে এ উদ্ধৃতি অমিতাভ চৌধুরীও দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা, রবি অনুরাগীরা, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, কবি ও সন্ন্যাসী, রবিঠাকুরের পাগলা ফাইল, সত্যজিতের পরিবার ও রবীন্দ্রনাথ, সূর্যাস্তের আগে রবীন্দ্রনাথসহ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা ধরনের বই লিখে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের চারপাশে পাগলাটে ধনের যাঁরা ছিলেন কিংবা তাঁর কাছাকাছি আসার জন্য যাঁরা যথেষ্ট পাগলামির পরিচয় দিতে পেরেছেন—শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতীর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়-পরিজনের ফাইলপত্র, দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে নিজের বইয়ে তাঁদের কাউকে কাউকে তুলে এনেছেন অমিতাভ। যেমন, আপনি যদি এখন জানতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ বিয়ে-বহির্ভূত সম্পর্কে এক সন্তানের জনক, ভিমরি খাবেন নিশ্চয়!
দেশি কাদম্বরী থেকে শুরু করে বিদেশি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো পর্যন্ত অনেকের সঙ্গে রবিঠাকুরের মাত্রাতিরিক্ত সম্পর্কের ইঙ্গিত দেওয়া হয়ে থাকলেও তিনি অগোচরে সন্তান জন্ম দিয়েছেন, এমন অপবাদ দেয়নি কেউ। চিঠিতে এক নারী দিলেন সেই অপবাদ।
সুবাস নামের ওই নারী ৭ আষাঢ় ‘প্রিয়তম নাথ’ সম্বোধন করে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন: ‘প্রিয়তম নাথ, তোমার চিঠি পেয়েছি। এত দিন পরে যে এ দুঃখিনীর কথা মনে করেছ, এই আমার সৌভাগ্য। তবে আর রাগ করব কেন? আমার দিনগুলো যে কীভাবে কাটছে তা যদি তুমি এতটুকুও বুঝতে পারতে, তাহলে একখানা পত্র লিখতে এত দেরি করতে না। থাক, তোমার শরীর আজকাল কেমন আছে? এ বাড়ির সব ভালো আছে। তোমার ছেলে ভালোই আছে। তুমি আমার প্রাণভরা ভালোবাসা জেনো। চুমো দিয়ে বিদায় নিচ্ছি। ইতি, তোমারই সুবাস।
পু. দিদিমা কাল রাতে এখানে আসবে। চিঠি লিখতে দেরি করো না।’
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অনিল কুমার চন্দ এবং অনিল কুমারের সহযোগী সুধীরচন্দ্র কর ১৯৩৩ থেকে ১৯৪১—এই সময়ে গুরুদেবের নামে আসা অধিকাংশ চিঠি সংরক্ষণ করেছেন। এ ধরনের চিঠিগুলো শান্তিনিকেতনে ‘পাগলা ফইল’ নামে সংরক্ষিত আছে।
রবীন্দ্রনাথ সুবাসকে সত্যিই অনেক দিন পর চিঠি লিখেছেন কি না, সত্যিই সুবাসের ছেলের বাবা হয়েছেন কি না—এসব বিষয়-আশয়ে গবেষণার পরামর্শ না দিয়ে বরং অমিতাভ চৌধুরী বিষয়টি গোড়াতেই খারিজ করে দিয়েছেন। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন এটা কোনো ফাজিলের কাজ। পরে চিঠিতে হাতের লেখা দেখে নিশ্চিত হয়েছেন, পত্রলেখক নেহাত ফাজিল নয়, একজন নারী, হাতের লেখাটি নারীর এবং ওই নারী পাগল!
রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছেন ১৯১৩ সালে। তাঁর নোবেলপ্রাপ্তিতে সারা বাংলার সবাই যে ধন্য ধন্য করেছে, এমন তো নয়—নিন্দার কাঁটাও ছুড়েছেন দু-একজন। একজন তো সরাসরি জানতেই চেয়েছেন, পুরস্কার বাগাতে ঠাকুরের কত খরচ হলো?
হ্যাঁ, কবিকে প্রশ্নটি ওই ব্যক্তি করেছিলেন চিঠিতে। দেরিতে হলেও আবিষ্কৃত হয়েছে সেই চিঠি। মজার ব্যাপার হলো, রবিঠাকুরকে চিঠিটি যিনি লিখেছিলেন, তিনি নিজেও ছিলেন নোবেল পুরস্কারপ্রত্যাশী। তাই একটি লোভনীয় প্রস্তাবসহ কবিকে তিনি পাঠালেন নিম্নোক্ত চিঠি: ‘সবিনয় নিবেদন, আপনার নোবেল প্রাইজ পাওয়ার টেকনিক অতি সত্ত্বর জানান। তাহা হইলে আমি যদি প্রাইজ পাই, মোট প্রাপ্য টাকার অর্ধাংশ আপনাকে দিব।’
আহা লোভনীয় প্রস্তাবই বটে!
কবির নোবেল প্রাপ্তির পর সংবর্ধনা পর্বের উত্তাপ কিছুটা কমে আসতেই ১ অগ্রহায়ণ ১৩২০ রবীন্দ্রনাথ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লিখেছিলেন: ‘সম্মানের ভূত আমাকে পাইয়াছে। আমি মনে মনে ওঝা ডাকিতেছি—আপনাদের আনন্দে আমি সম্পূর্ণ যোগ দিতে পারিতেছি না। আপনি হয়তো ভাবিবেন, এটা আমার অত্যুক্তি হইল। কিন্তু জানেন আমার জীবন কিরূপ ভরাতুর হইয়া উঠিয়াছে।’
বিচিত্র রকম আবদার সহ্য করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। কেউ কেউ গল্প-উপন্যাসও লিখে দিতে অনুরোধ করেছেন তাঁকে। ফরিদপুরের জীবন কুমার পাল লিখেছেন: ‘দয়া করিয়া “অদৃষ্টের ফের” নাম দিয়া একটি ছোটখাটো (ফুলস্কেপ কাগজের২/৩ পৃষ্ঠা) “উপন্যাসিক” গল্প লিখিয়া পাঠাইবেন। আর আপনার চয়েস মতো একটি কবিতা (ছোট) বা গল্পও তৎসহ লিখিয়া পাঠাইতে সংকোচবোধ করিবেন না আশা করি।
আমি একজন আইএ পাশ স্টুডেন্ট। সেই স্ট্যান্ডার্ড মতোই লিখবেন। যত সত্ত্বর পারেন নিম্নলিখিত ঠিকানায় গল্প ২টি পাঠাইবেন। ইতি।
সঙ্গে একখানা স্ট্যাম্প দিয়া দিলাম। ২০ বৈশাখের মধ্যে পাঠাইবেন।’
এক জীবনে অসংখ্য চিঠি পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সেসব চিঠিতে কত রকম আবদার আর আকাঙ্ক্ষা। একবার গাঙ্গচর কুমিল্লার নীলিমা চৌধুরী নামে একজন কবিকে লিখলেন তাঁর নির্দোষ আকাঙ্ক্ষার কথা। কিন্তু চিঠি পড়ে দেখা যায় যে, আকাঙ্ক্ষা শেষাবধি রূপান্তরিত হয়েছে নির্দেশে: ‘এক কাজ কর, তুমি এক মাসের জন্য চলে এসো কুমিল্লার এদিকে।...আচ্ছা! তুমি কি এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হওনি? আমার চিঠির জবাব দিচ্ছ কবে? আমি কিন্তু আসছে বুধবারের মধ্যে চাই। বুঝলে তো? তোমার নিজের হাতেই কিন্তু সব করতে হবে। অসুস্থতার দোহাই দিলে চলবে না।’
‘পুনশ্চ’ দিয়ে নীলিমা চৌধুরী আরও লিখেছেন: ‘আসছে বুধবারের মধ্যে তোমার জবাব পেতে চাই-ই চাই!’
‘পাগলা ফাইল’-এ অনিল চন্দ যেসব চিঠি জমিয়েছেন, তার সবই পাগলের প্রলাপ নয়, নীলিমার চিঠিটি নিশ্চয়ই প্রেমপত্র।
এই সব ‘পাগল’ ভক্ত কোনো সময়ই পিছু ছাড়েনি রবীন্দ্রনাথের। একবার পোষা বিড়াল কোলে নিয়ে বর্ধমান থেকে ট্রেনে চেপে শান্তিনিকেতন এলেন এক নারী। এসে তিনি বললেন, ‘বৌঠান, গিয়ে বল জোঁড়াসাকো থেকে সরলা দেবী এসেছেন।’ সরলা দেবী রবিঠাকুরের পিসতুতো বোন। পরে রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবী এসে ওই নারীকে দেখে তো অবাক—কে এই নারী!
এমন অজস্র ‘পাগলের’ মুখোমুখি হয়েছিলেন কবি। তাঁদের কত কাণ্ড-কীর্তি! বরিশালের অক্সফোর্ড মিশনের এক ভক্তের ভক্তি তো খানিকটা টলেই গেল, যখন তিনি জানলেন যে রবীন্দ্রনাথ খ্রিষ্টান নন! তাঁর চিঠিতে এবার চোখ বোলানো যাক: ‘পরম পূজনীয় গুরুদেবের শ্রীচরণে আমার নিবেদন, আমি একজন নগণ্য বাঙালি খ্রিষ্টান। আমার ধারণা ছিল জগতে যাঁরা কর্মক্ষেত্রে বড় তাঁরা সকলেই বড় খ্রিষ্টান। আপনার সম্বন্ধে আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। সেই ভুলটা আজ আমার ভেঙে গেল।...আপনার কর্মক্ষেত্রে আপনি খুব বড়। আরও বিশেষ বুঝেছি যে, আপনি এশিয়া মহাদেশের বড় কবি এবং তারি সাথে বুঝেছিলাম, আপনি নিশ্চয়ই এশিয়া মহাদেশের ঈশ্বর মানবের বড় দাস, বড় খ্রিষ্টান হবেন; কিন্তু আজ যখন জানতে পারলাম আপনি একজন ব্রাক্ষ্ম, বুকটা ধড়াস করে উঠল। ভক্তিটাও একটু টলে গেল।’
এমন আরও ঢের কাণ্ড-কীর্তি আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঘিরে। আজ এটুকু বললাম, বাকিটা আরেক বৈঠকে বলা যাবে।