রাত কত হলো?

রাত কত হলোপ্রথম আলো

এত মেঘও জমা ছিল তবে! জমা ছিল এত এত উচাটন উতল বাষ্পের দেশ? কোথা থেকে এল এই বাষ্পসকল? মেয়েটির খোলা চোখ কি তার আদি ভূমি তবে? নাকি ওই পাটকল।

প্রতিটি বাষ্পবিন্দুরই আছে আলাদা ইতিহাস। কারখানার গেট থেকে ছিনতাই হওয়া মেয়েটির চোখের মতো নয় রাঙামাটির মেয়েটির চোখ। কিংবা এমন আরও আরও চোখের মিছিল যদি ভাবা যায়। কোনো চোখই পারে না আর কোনোটির নির্ভুল প্রতিস্থাপক হতে। সব চোখেরই আছে আলাদা ইতিহাস, পৃথক অ–সুখ। তাদের বাষ্প মিছিল তাই যায় না মিলে, তারা সব পৃথক ফোঁটা হয়ে নেমে আসে। অসংলগ্ন সে আহাজারি, যেন কোন অতীতের গ্রামে এসেছে কোন প্রাণের মড়া। থেকে থেকে চলছে তারই ফোঁপানো সংগীত।

অথচ ভাবালু সম্রাট বসে যায় কলম হাতে। ‘রিমঝিম বৃষ্টির’ পদ্য লিখবে সে। অথচ শুটিংওয়ালারা নেমে গেছে ক্যামেরা–ট্রাইপড সমাহারে বৃষ্টির লিপি ধারণের তৎপরতায়। অথচ প্রেশার কুকার বাজাচ্ছে সিটি ভেজা দিনের ভোজন উল্লাসে। অথচ বেজে চলেছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রবীন্দ্রসংগীত। অথচ বাউ করার আগে আগে মহামান্য ভাঁড়েরা নিয়ম মেনে ছুড়ে দিচ্ছে আরও কিছু অব্যর্থ কৌতুক। আর হইহই করে উঠছে জনতা ও বিশ্লেষণবাজের দল। টিআরপির খেল শুরু হলো বলে। এভাবে আসতেই থাকে, আসতেই থাকে। কৌতুকই আরাধ্য এই তামাশার দেশে।

ফলে অগণিত ‘মেয়েটির’ খোলা চোখ থেকে হঠাৎ ডানা পাওয়া বাষ্পের দল গিয়ে জমা হয় সময়ের মেঘে। কালিদাসহীন সেই অপ্রেমের মেঘ ক্রমে কালো হয়। কালো হতে হতে অন্ধকার ডাকে সে, যেনবা রাত। যেনবা দিন এক উপমা শুধু। যেন সূর্য এক প্রতীক–সর্বস্ব ব্যাপার–স্যাপার, ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’ ভাঁওতার দিকে তাকিয়ে যে মুচকি হাসছে। যেন এসব উপমার জীবন সে ত্যাগ করেছে। তার কি ডানা গজাল তবে? তবে সে–ও কি দিল হাওয়ায় উড়াল, বাষ্প–ভারী হাওয়ায়!

ফলে রাতই সত্য হয়ে ওঠে। আর দিনগুলো পুরোনো কড়িকাঠ ধরে চেয়ে থাকে শূন্য চোখে। অতএব সেই ঋত্বিকই ফিরে আসেন বারবার। হাতে তুলে নেওয়া দড়ির ফাঁসের দিকে দারুণ ভ্রুকুটিতে তাকিয়ে, বড় তির্যক ও একরোখা চোখ পাকিয়ে অনায়াসে প্রশ্ন ছুড়ে দেন—রাত কত হলো? অথচ এর কোনো মীমাংসা নেই। রাত যেন এক অনিঃশেষ ধারণা কেবল, যার শুধু বিস্তার আছে। যেন পদ্মা, মেঘনা, গোমতি বা ডাকাতিয়া নিছক নাম শুধু। যেন আদতে আমাদের বাস সেই সুবর্ণরেখারই পারে। যেন এক ভীষণ উদ্বাস্তুকালের প্রলম্বনই একমাত্র সত্যসার।

মাথার পেছনে ঘড়িটির মতো তাই টিক টিক করে ঋত্বিক বারবার করে বলে যেতে থাকেন সেই একই প্রশ্ন—রাত কত হলো? যেখানে যার ছায়া দেখি, সে–ই যেন হয়ে ওঠে হরপ্রসাদ। যেন প্রতিটি ফোকরে ওত পেতে আছে সেই একই জানালা। যে জানালার নিচে এইমাত্র চিৎকার করে উঠল রাঙামাটির সেই মেয়ে। একটু আগেই সেখানে ছিল কোনো এক কারখানা গেট। তারও আগে সেই কবে থেকে সেখানে অনশন করছিল পাটকল ও প্রেসক্লাব। গোটা দেশ, গোটা চরাচর একটানে ঢুকে পড়ে এ পথ দিয়ে। এ কেমন জানালা বানালে কারিগর, যা দেয় শুধু অন্ধকারকেই প্রবেশাধিকার? এ কেমন জানালা বলো, যেখানে বারবার এসে দাঁড়ান হরপ্রসাদ কিংবা ঋত্বিক?