রাহাত ভাইয়ের স্মৃতি
রাহাত খানকে আমরা রাহাত ভাই বলে ডাকতাম। তিনি আমাদের ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। সময়ে-অসময়ে আমাদের পাঁচ-দশ টাকা অপরিশোধ্য অর্থও দান করতেন। খুব বিপদে পড়লে তাঁর সেগুনবাগিচার বাসায় আমরা লাঞ্চ করতে পারতাম। লীনা ভাবিও আমাদের অতিথি হিসেবে পছন্দই করতেন।
আমরা মানে আমি আর আবুল হাসান।
এই দুই বাউন্ডুলে তরুণ কবিকে তিনি খুব সম্ভাবনাময় কবি বলেও প্রচার করে বেড়াতেন, লিখেও বলেছেন সে কথা। কোথায় লিখেছেন তা এখন আর মনে পড়ছে না।
১৯৭২-৭৩ সালের দিকে তিনি কলকাতার বিখ্যাত দেশ পত্রিকায় ‘ঢাকার চিঠি’ শিরোনামে একটি লেখা লিখতেন। সেখানে একবার আমাদের ওপর তিনি একটি লেখা লেখেন। ওই লেখায় তিনি আমাদের বোহিমিয়ান জীবনযাপনের একটি চিত্র তুলে ধরে লিখেছিলেন: ‘এই তরুণ কবিদ্বয় ঢাকা শহরের কখন কোথায় থাকেন, কখন কী খান, তারা নিজেরাও তা জানেন না। তাদের জন্য ঢাকা শহরের অনেক বাসাতেই রান্না হয়। অনেক সময় ইটের বালিশে মাথা পেতে তারা পথের পাশে, রেলস্টেশনে, মসজিদে রাত কাটান। ওরা মনে করেন ইটের বালিশে ঘুমালে কবিদের মাথা শক্ত হয়।’
ওআমাদের জীবনযাপনের এ রকম মাথা গরম করা চিত্র দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে লেখাটি পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর শিল্পনগরীতে থাকা আমার বড় ভাই ও ছোট বোনের চোখে পড়ে। লেখা পড়ে আমার দাদা হাসেন, ছোট বোন কাঁদে।
আমার ছোট বোন সোনালী আবুল হাসানকেও চিনত। আবুল হাসান একাধিকবার আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে।
আমার সরল ছোট বোন সোনালী আমাদের দুর্দশার কথা দেশ পত্রিকায় পাঠ করে এতটাই কষ্ট পায় যে আমাকে একটি দীর্ঘ পত্র লেখে। সোনালীর পত্রটি ছিল এ রকম: ‘মেজদা, তোমাদের আর ঢাকায় থাকার দরকার নেই। তুমি হাসান ভাইকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে আসো। এইখানকার কবিরা মহাসুখে বাস করে। তোমাদের নিয়ে রাহাত খানের লেখাটি পড়িয়া আমি সারারাত ঘুমাইতে পারিনি।
হাসান ভাই আসতে না চাইলে তুমি চইলা আসো। আমি তোমার দায়িত্ব নিব।’
তাঁর লেখাটি পড়ে আমার দুর্গাপুরবাসিনী ছোট বোনের কী করুণ দশা হয়েছিল, সেই কথা রাহাত ভাইকে বলা হয়েছিল কি না, ঠিক মনে পড়ছে না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সপরিবার নিহত হওয়া এবং ২৬ নভেম্বর আমার কবিবন্ধু আবুল হাসানের অকালমৃত্যুর পর রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগসূত্রটি ছিন্ন হয়ে যায়।
ঝালকাঠির অপর্ণাকে বিয়ে করার পর রাহাত ভাইয়ের নবজীবনে আমার আর প্রবেশ করা হয়নি।
করোনার মহামারি না হলে আপনার মৃত্যুশয্যায় আপনাকে দেখার জন্য আমি অবশ্যই বারডেম হাসপাতালে যেতাম, রাহাত ভাই।