লুইস গ্লুক কী বিশেষ কোটায় নোবেল পেলেন?

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
কেন এবার সাহিত্যে নোবেল পেলেন মার্কিন কবি লুইস গ্লুক? ‘কবিতা’ ও ‘নারী’—এই দুটি অনুসঙ্গ কি তাঁকে নোবেলের দৌড়ে এগিয়ে দিয়েছে?

দুটি কারণে এবারের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারকে ‘বৈশিষ্ট্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন অনেকেই। প্রথম কারণ, বহুদিন বাদে কবিতা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেলেন কেউ। দ্বিতীয় কারণ, বহুদিন বাদে একজন নারী কবি পেলেন সেই পুরস্কার। অর্থাৎ ‘কবিতা’ ও ‘নারী’—এই দুটি অনুসঙ্গই নোবেল সাহিত্য পুরস্কারকে বিশিষ্টতা দান করেছে।

এই যুক্তি যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই যে প্রশ্নটি মনের মধ্যে উঁকি দেয় তা হচ্ছে, লুইস গ্লুক কি তবে ‘নারী’ ও ‘কবিতা’—এই দুই বিশেষ কোটায় পুরস্কার পেলেন? তাঁর কবিতা কি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো যথেষ্ট মানসম্মত নয়?
সাধারণ তথ্যজ্ঞান জানা মানুষমাত্রই জানেন, নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে বিশেষ কোটা বলে দৃশ্যমান কিছু নেই। অদৃশ্য অনেক কিছুই হয়তো রয়েছে, তবে তা বিতর্কসাপেক্ষ। সেসব বিতর্ক নিয়ে কথা বললে শুধু ডালপালাই মেলে, কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা যায় না। বাধ্য হয়ে স্বীকার করে নিতে হচ্ছে যে গুণেমানে উত্তীর্ণ লেখাকেই সুইডিশ একাডেমি পুরস্কার দিয়ে থাকে।

অতএব এক্ষণে বিচার্য বিষয় হচ্ছে, লুইস গ্লুকের কবিতা কতটা মানসম্পন্ন?
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী গণমাধ্যম ‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এর সাহিত্য সমালোচক উইলিয়াম লগান বলেছেন, গ্লুক তাঁর কবিতায় স্বগতোক্তির মতো করে শ্লোক বলে যান। তিনি তাঁর কবিতায় মানবাত্মার অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরেন। মানুষের চোখ যা এড়িয়ে যায়, তাতেই আলো ফেলেন গ্লুক। বর্তমান সময়ে তো বটেই, আমেরিকান সাহিত্যের ইতিহাসেই তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে বেঁচে থাকবেন।

শব্দ আর বাক্যের আড়ালে কোন কোন বিষয় নিয়ে তবে খেলা করেন লুইস গ্লুক, যাকে উইলিয়াম লগান বলছেন মানবাত্মার অন্ধকার দিক? গ্লুকের কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁর বেশির ভাগ কবিতায় স্থান পেয়েছে হৃদয়ের স্পর্শকাতরতা, একাকিত্ব, পারিবারিক বন্ধন, বিবাহবিচ্ছেদ, মৃত্যু, কাম, ক্রোধ, বেদনা, হতাশা ইত্যাদি। রোজানা ওয়ারেন নামের এক বিশিষ্ট মার্কিন কবি বলেছেন, লুইস গ্লিকের প্রথম দিকের কাব্যে স্থান পেয়েছে ব্যর্থ প্রেম, অপূর্ণ ভালোবাসা, ভেঙে যাওয়া পরিবার, শোক, সন্তাপ, বিরহ ইত্যাদি। আর শেষের দিকে এসে তিনি আবিষ্কার করেছেন আত্মিক একাকিত্ব। এই একাকিত্বের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন চিরায়ত মিথ ও উত্তরাধুনিক বিচ্ছিন্নতা। গ্লুকের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে, তিনি পারতপক্ষে লিরিক থেকে দূরে থাকেন।

লুইস গ্লুক
ছবি: সংগৃহীত

লুইস গ্লুকের প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। নাম ‘ফার্স্টবর্ন’। প্রথম বই দিয়েই তিনি তাঁর জাত চিনিয়েছেন। প্রকাশের পরপর বোদ্ধা সমালোচক থেকে শুরু করে কবিতার আমপাঠক—সবাই তাঁকে সাদরে বরণ করে নেন। এরপর ক্রমেই তিনি মার্কিন সাহিত্যে হয়ে ওঠেন একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয়। তো, কী ছিল সেই প্রথম কাব্যগ্রন্থে? যথারীতি মানবাত্মার বিশ্বাস ও বিশ্বাসহীনতা, মানবিকতা ও অমানবিকতা, নৈতিকতা ও অনৈতিকতা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, মিথ ও বাস্তবতা।

লুইস গ্লুকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের নাম ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিশ’; যে গ্রন্থের জন্য তিনি ১৯৯২ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। কাব্যগ্রন্থটির তিনটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগে রয়েছে একটি কল্পনার বাগান। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে বাগানের মালি ও তৃতীয় ভাগে রয়েছে ঈশ্বরের বন্দনা। প্রথম ভাগে দেখা যায়, ফুলগুলো কথা বলছে মালির সঙ্গে। দ্বিতীয় ভাগে মালি নিজেই কথা বলছে নিজের সঙ্গে। তৃতীয় ভাগে ঈশ্বরবন্দনা। তিনটি ভাগ একসঙ্গে পাঠ করলে মনে হয় যেন এক অনাস্বাদিত জীবনভ্রমণ করলেন পাঠক; যে ভ্রমণে রয়েছে অজানা অনেক প্রশ্ন, অচেনা অনেক পথ, ঘন কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া পাহাড়, আবার পাহাড় পেরিয়ে ফিরে পাওয়া সমতল।

এদিক থেকে ‘মেডোল্যান্ডস’ কাব্যগ্রন্থটি একটু ভিন্ন ধাঁচের। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থের কবিতায় গ্লিক ব্যবহার করেছেন রোমান ও গ্রিক মিথ। এই বইয়ের কবিতার পরতে পরতে রয়েছে ওডেসিস ও পেনোলেপের আর্তনাদ।

ভিন্ন ধাঁচের আরও একটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে গ্লুকের। সেটির নাম ‘ভিতা নোভা’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। এই বইটির জন্য ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পুরস্কার ‘বোলিনজেন’ পেয়েছিলেন গ্লুক। এই কবিতাগুলোতেও স্থান পেয়েছে যথারীতি বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সংসার, স্বপ্নভঙ্গ ইত্যাদি। বই সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে গ্লুক বলেন, এই বইয়ের কবিতাগুলো খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা। মনে আছে, একটানা অনেক দিন না ঘুমিয়ে কবিতাগুলো লিখেছিলাম।

আরও যা কিছু ঘুমাতে দেয় না গ্লুককে তার মধ্যে রয়েছে চিরায়ত মিথ ও পৌরাণিক গল্প। এসব বিষয়কে উপজীব্য করেই লিখে ফেলেন ‘দ্য সেভেন এজেস’। প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। বইটিতে তিনি তাঁর নিজস্ব ভাবনা ও স্মৃতিচারণার সঙ্গে মিথের অসামান্য মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়েছেন। এ রকম মিথ নিয়ে খেলেছেন আরও একটি গ্রন্থে—‘আভের্নো’। ‘আভের্নো’ পড়লে বোঝা যায় মিথ তাঁকে কতটা প্রভাবিত করেছিল। মিথ চরিত্র দেবী পারসেফেনির ভাবনাকে ধারণ করে বইটি লিখেছেন তিনি। মিথের সঙ্গে মিলিয়েছেন বর্তমানকে, যে বর্তমানে বাস করে একজন মা ও মেয়ে। এই বইয়ের চিত্রকল্প ও মেটাফর বুঝলেই বোঝা যায়, কী অসামান্য কাব্যশক্তি নিয়ে জন্মেছেন লুইস গ্লুক।
এরপর ‘আ ভিলেজ লাইফ’ সম্পর্কে না বললে গ্লিকের অসামান্য কাব্যশক্তির বর্ণনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সমালোচকদের ধারণা ‘আ ভিলেজ লাইফ’ই গ্লিকের সবচেয়ে সেরা সৃষ্টিকর্ম। এখানে গ্রাম বলতে তিনি সময় ও সভ্যতাকে নিপুণ দক্ষতায় চিত্রিত করেছেন। এঁকেছেন নিজের জীবনেরই ছবি। তবে বিমূর্তভাবে।

লুইস গ্লুক এ পর্যন্ত ১২টি বই লিখেছেন। এর মধ্যে ১৯৬২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত লেখা কবিতাগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত কবিতা নিয়ে বই করেছেন ‘গ্লুকস সিলেক্টেড পোয়েমস ১৯৬২-২০১২’ নামে। বইটি সম্পর্কে ‘নিউ রিপাবলিক’ বলেছে, পানি কীভাবে আগুনে রূপ নেয় তারই অপূর্ব স্বাক্ষর যেন এই বই।

এ ছাড়া গ্লিকের উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য হাউস অব মারসল্যান্ড’, ‘দ্য গার্ডেন’, ‘ডিসেন্ডিং ফিগার’, ‘আরারাত’ ইত্যাদি। তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ সালে। নাম ‘ফেইথফুল অ্যান্ড ভার্চ্যুয়াস নাইট’। এরপর ২০১৭ সালে বেরিয়েছে তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘আমেরিকান অরিজিনালিটি’।

লুইস গ্লিক ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড, পুলিৎজার পুরস্কার, লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। সর্বশেষ পেলেন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার।
সুতরাং তাঁর সব সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করলে মনে হয় না তিনি শুধু ‘কবিতা’ ও ‘নারী’ কোটায় বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ রিপাবলিক, লস অ্যাঞ্জেলস টাইস।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]