লুলুর একাত্তর
হঠাৎ কানে এল শোরগোল, ‘দারওয়াজা খোলো, হামলোগ জানতে হে ইসমে গাদ্দার বাঙাল হ্যায়।’ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা আটকে পড়েন সেখানে। এরপর কী দুর্দশার মধ্য দিয়েই না গেছে তাদের দিনরাত্রি। এই লেখায় ধরা আছে সেই রুদ্ধশ্বাস চিত্র।
‘শিমু, শিলু, শিখু, শি¹শিগগির ওঠো।’ লুলু দ্রুত দশ মাসের ছোট্ট রাজিকে কোলে তুলে নিয়ে, বাকি তিন সন্তানের গা থেকে লেপ টেনে সরাতে সরাতে বলল, ‘শুনছ না সাইরেন বাজছে। তাড়াতাড়ি ট্রেঞ্চে চলো।’ লুলুর একমাত্র কন্যা দুই বছরের শিখু মোড়ামুড়ি করছিল। বড় ছেলে সিমু তাকে এক ঝটকায় কোলে তুলে এবং এক হাতে শিলুকে টান দিয়ে উঠিয়ে হাত ধরা অবস্থায়ই সবাই ছুটল ট্রেঞ্চের দিকে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ভারত বাংলাদেশের হয়ে সরাসরি যুদ্ধে নেমেছে। তারা পূর্ব ও পশ্চিম দুই সীমান্তেই আক্রমণ করেছে। কিছুক্ষণ পরপর পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান আকাশে টহল দিচ্ছে।
ট্রেঞ্চে এসে লুলু দেখে মুরশেদা আগেই তার বাচ্চাদের নিয়ে এসে গেছে। লুলু আর মুরশেদার স্বামী এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেফাজতে। অফিস থেকেই তাদের তুলে নেওয়া হয়েছে। আশপাশের গৃহকর্তাহীন বাঙালি পরিবারগুলোতে লুলুই নেত্রী। সে-ই তার লনের সামনে এই ট্রেঞ্চ খুঁড়িয়েছে। মাথার ওপর দিয়ে বিকট আওয়াজে উড়ে গেল একটা যুদ্ধবিমান। বাচ্চারা কী বুঝল কে জানে? চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল।
১৯৬১ সালে মুসলিম গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা মায়ের অকালপ্রয়াণের পর ৩৭ নাজিমুদ্দিন রোডের বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের ভারবাহী রাজিয়া খাতুন চৌধুরী ওরফে লুলুর বিয়ে হয়ে গেল স্বল্পভাষী স্বল্প হাসির সুপুরুষ লে. কর্নেল ডা. এ এফ এম আবদুল হকের সঙ্গে। আবদুল হক পেশায় ডাক্তার। সামরিক বাহিনীর মেডিকেল কোরে কর্মরত। বড় বোন আয়শা খাতুন চৌধুরীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিয়ে করবে না বলেই ভেবেছিল লুলু। এমএর পর এমএডও করেছিল লুলু। সাতটি বছর লুলুর পেছনে ছিনে জোঁকের মতো লেগে ছিল আবদুল হক। শেষটায় রাজি হয়ে যায় লুলু। সেই থেকে লুলুর ঠিকানা তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বামীর বদলির চাকরি। ফলে রাওয়ালপিন্ডি, পেশোয়ার, কোয়েটা—কত শহরেই তো লুলু পেতেছে তার সংসার।
আবার গুটিয়ে নিয়ে ছুটেছে অন্য কোনোখানে। এখানে আসা অব্দি ‘মিসেস হক’ নামের নিচে চাপা পড়ে গেছে লুলু পরিচয়।
সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক খান সাহেব আবদুর রব চৌধুরীর মেয়ে লুলু। বাবা তাদের বড় করেছেন এই আদর্শে যেকোনো কিছুই প্রশ্ন না করে গ্রহণ করবে না। পছন্দ না হলে প্রতিবাদ করবে। সেই কলেজজীবনেই তো সে আর তার বোন অলি বেশ কিছু ছাত্রী নিয়ে সচিবালয়ে চড়াও হয়েছিল তাদের ইডেন কলেজ বিল্ডিং ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে। পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রীর স্ত্রী কলেজে উর্দুতে বক্তৃতা দিতে শুরু করলে তার বোন অলির প্রতিবাদের সঙ্গে সঙ্গে, সে-ই তো ‘শেইম শেইম’ বলে চিৎকার করে উঠেছিল এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বাকি ছাত্রীরাও সমস্বরে বলে উঠেছিল, ‘শেইম শেইম’।
আর্মি অফিসারের স্ত্রী হিসেবে অন্য আরেক জীবনে অভ্যস্ত হতে হয়েছে তাকে। আবদুল হক আটক হওয়ার পর থেকে শুধুই মনে পড়ছে তাদের জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো। এই অপরিচিত ভূমিতে জীবনের নানা জটিলতার মধ্যেও সে আর আবদুল হক রচনা করেছিল সুখের সংসার। ভীষণ বিপদ আর গভীর শঙ্কার মধ্য দিয়ে ঘর আর ট্রেঞ্চ করতে করতে কেটে গেল কয়েটা দিন। এরই মধ্যেই বুকে বোধ করে চাপা এক উত্তেজনা। প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ খুব শিগগির দখলদার বাহিনীমুক্ত হতে যাচ্ছে। কী আনন্দ! কী আনন্দ! আবার এক সেকেন্ডেই তাকে ঘিরে ধরে গভীর এক আতঙ্ক, সে কি দেখতে পাবে তার স্বাধীন দেশ? দেখতে পাবে তো আবদুল হককে? তার প্রাণপ্রিয় বোন অলি (সাঈদা সিদ্দিকী), নজু ভাই (বিচারপতি আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী), মামুন ভাই (অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী), সফু আপা, লতিফ (ড. আবদুল লতিফ চৌধুরী), খালেক (আবদুল খালেক চৌধুরী), রুকু (ড. রকিব চৌধুরী)—কারও সঙ্গেই কি আর দেখা হবে না! ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।
বেশ কয়েক দিন পর হঠাৎ বাড়ির গেটে একটা গাড়ি এসে থামল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না লুলু। দেখল গাড়ি থেকে নামছে আবদুল হক। গেট গলিয়ে ভেতরে ঢোকা থেকে গাড়িবারান্দা পর্যন্ত হকের আসা মনে হচ্ছিল দৈববলে স্বর্গ থেকে নামছে সে। লুলুর হাতে ছিল একটা বিস্কুটের কৌটা। কোনোরকমে টেবিলে রেখে ছুটে বেরোল। কাছে আসতেই আঁতকে উঠল। এ কাকে দেখছে সে? ঠোঁট দুটো শুকনো, চোখ কোটরাগত, বয়স যেন বেড়ে গেছে দশ বছর। পরে আস্তে আস্তে জেনেছে, প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল আবদুল হক। হ্যাঁ, তাদের মেরে ফেলার কথাই ছিল। উচ্চপর্যায়ের অল্প কিছু অফিসারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছিল। তারা বাকি অফিসারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে এদের মেরে ফেললে তাদের ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দী সৈন্যদের আর ফেরত পাওয়া যাবে না।
আবদুল হক তো বাড়ি ফিরল। স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। তবে তারা হয়ে পড়ল গৃহবন্দী। হকের ফেরার পরদিনই সৈন্যরা তাদের এবং অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের বাড়িগুলো ঘিরে ফেলল। কয়েকটা দিন গৃহবন্দী অবস্থায় ভেতর থেকে শুধু শুনল ভারী বুটের আওয়াজ—খট, খট, খট। বুটের আওয়াজগুলো এক গতিতে চলতে থাকলে কিছুটা আশ্বস্ত থাকে লুলু। যে মুহূর্তে একটু থামে, তখনই হিম হয়ে আসে হাত-পা, এই বুঝি ঢুকে পড়ল ভেতরে।
হঠাৎ বাড়ির গেটে একটা গাড়ি এসে থামল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না লুলু। দেখল গাড়ি থেকে নামছে আবদুল হক। গেট গলিয়ে ভেতরে ঢোকা থেকে গাড়িবারান্দা পর্যন্ত হকের আসা মনে হচ্ছিল দৈববলে স্বর্গ থেকে নামছে সে। লুলুর হাতে ছিল একটা বিস্কুটের কৌটা। কোনোরকমে টেবিলে রেখে ছুটে বেরোল। কাছে আসতেই আঁতকে উঠল। এ কাকে দেখছে সে? ঠোঁট দুটো শুকনো, চোখ কোটরাগত, বয়স যেন বেড়ে গেছে দশ বছর। পরে আস্তে আস্তে জেনেছে, প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল আবদুল হক। হ্যাঁ, তাদের মেরে ফেলার কথাই ছিল।
হঠাৎ একদিন জানতে পারল, তাদের নিয়ে যাওয়া হবে কোনো ক্যাম্পে। স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তির জন্য তারা জিম্মি। যারা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখবে, তারা থেকে যেতে পারে পাকিস্তানে। মনে মনে বলে লুলু, কোনো বাংলাদেশি অফিসারই তোদের দেশের প্রতি আনুগত্য দেখাবে না। আর লুলু, সে তো ১৯৫২ থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থক।
লুলু ঘুরে ঘুরে দেখল তার সংসার। কত কষ্ট করে তিলে তিলে গুছিয়েছে সে। সব ফেলে যেতে হবে। তবে বাঙালি অফিসারদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে, এ কথাটা কেমন করে যেন সর্বত্র চাউর হয়ে গেল। সারা দিন ধরে একের পর এক ব্রোকার এসে আসবাব, ডেকরেশন পিস, ডিনার সেট, রেডিও, টিভি পানির দামে কিনে নেওয়ার জন্য উত্ত্যক্ত করতে শুরু করল। কেমন হতভম্ব হয়ে গেল লুলু। কিছু জিনিস বিক্রি হয়ে গেল।
আবার অনেক কিছু প্রতিবেশী পাকিস্তানি অফিসারদের স্ত্রীদের দিয়ে দিল। লুলুর এত শখের ডিনার সেটটা দিয়ে দিল এক প্রতিবেশীকে। সে বারবার বলল, ‘ইয়ে আপকি ইয়াদগার ব্যানকে র্যাহে যায়েগি!’ অল্প কিছু জিনিস, যা ট্রেনে নেওয়া যায়, তাই নিয়ে লুলু আর সব বাঙালি অফিসারের পরিবারের মতো কপর্দকশূন্য অবস্থায় অজানা ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠল। তাদের পরিবার আর ড. সিরাজ জিন্নাতের পরিবার যাচ্ছে একই বগিতে। অজানা আতঙ্কে সবার মুখ থমথমে। সিরাজ জিন্নাতের স্ত্রী ফরিদা আস্তে আস্তে বলল, ‘লুলু আপা, আমাদের বাচ্চারা তো ছোট। মিসেস আজহারের মেয়েরা সাবালিকা হয়ে উঠছে। পথে যদি বিক্ষুব্ধ পাকিস্তানিগুলো তার কোনো একটা মেয়েকে ধরে টান দেয়। কী করবেন তিনি?’
বাচ্চাগুলো তো অতশত বোঝে না। এত দিন গৃহবন্দী থেকে এখন বের হতে পেরে কর্নেল সিরাজ জিন্নাতের দুই ছেলে মামুন ও মাসুম আর লুলুর বাচ্চাদের কলকলানিতে মেতে আছে পুরো বগি। রাজি নামের ছেলেটা বেশ ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কাটাচ্ছে তার ট্রেনভ্রমণ। কী আশ্চর্য! পথ যেন আর ফুরোয় না। ট্রেন চলছে তো চলছেই। মাঠঘাট, প্রান্তর, রুক্ষ মরুভূমি ট্রেনের জানালা দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে। একসময় অবসন্ন হয়ে বাচ্চাগুলোও ঝিমিয়েও পড়ল। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কিছুটা তন্দ্রা এসে গিয়েছিল লুলুর। মুহূর্তেই তন্দ্রা ছুটে গেল। তাদের বগির গায়ে লাঠিসোঁটার বেদম বাড়িতে। কোনো এক স্টেশনে ট্রেনটি থেমেছিল। স্থানীয় লোকেরা কেমন করে যেন জানতে পারে এই ট্রেনে বাঙালি অফিসাররা আছে। শোরগোল কানে এল, ‘দারওয়াজা খোলো, দারওয়াজা খোলো, হামলোগ জানতে হে ইসমে গাদ্দার বাঙাল হ্যায়।’ ট্রেনে ওঠার আগে থেকেই কর্তৃপক্ষের নির্দেশ দেওয়া ছিল। কোনো স্টেশন এলে দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হবে।
তা-ই করেছিল সবাই। লুলুর মনে হলো, এই বুঝি দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল উন্মত্ত জনতা। বাঙালিদের রক্ত না ঝরানো পর্যন্ত যেন তাদের রুদ্ররোষ নির্বাপিত হবে না। ভাবতে অবাক লাগে, যুদ্ধ মানুষকে কীভাবে বদলে দেয়।
অন্যের কথা কেন? লুলু নিজেই তো এর শিকার। ব্যাটম্যান সাব্বির দীর্ঘদিন ধরে ছিল লুলুর সঙ্গে। সে তো পরিবারের একজনই হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের শেষ দিকে এসে লুলু খেয়াল করল, সাব্বিরের চোখেমুখে কেমন যেন একটা ঘৃণার ভাব। একদিন তো বলেই বসল, ‘তোমার মুলুকের লোকগুলো খুব খারাপ। আমার ভাইদের মেরে ফেলছে। আমার একেক সময় ইচ্ছা হয় এখানকার বাঙালিদের কিছু করি।’ একলহমায় সাব্বিরের ওপর থেকে সব বিশ্বাস উঠে গেল লুলুর। সেনাবাহিনী তাকে প্রত্যাহার করে নিলেও সাব্বির কিন্তু লুলুর মায়া ছাড়তে পারছিল না। ঘুরেফিরে সে আসতেই থাকল। এমনকি বাচ্চাদের স্কুল ছুটির সময়ও গিয়ে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। মায়ের মন অজানা শঙ্কায় ভরে উঠছিল। তাই লজ্জা-শরম ফেলে লুলুকে একসময় বলতে হয়, ‘সাব্বির, তুমি আর বাচ্চাদের স্কুলের সামনে যেয়ো না।’ সাব্বিরের সেই অবিশ্বাসে ভরা বিস্ফারিত চোখ লুলুর বুকের মাঝখানে শেল হয়ে বিঁধছে সেই থেকে। যুদ্ধ ব্যাপারটা বোধ হয় এমন। ভালোবাসার মানুষদের দুদিকে দাঁড় করিয়ে দেয়। আজ যারা তাদের মারবার জন্য ট্রেনের দরজা ভাঙতে চাচ্ছে, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এরাই কিন্তু লাহোর রক্ষা করার জন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কৃতজ্ঞ চিত্তে বুকে জড়িয়েছিল।
যাহোক, ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সবাই, এ যাত্রায় বেঁচে গেল তারা। তিন দিন এভাবে ক্রমাগত চলার পর করাচি, এরপর সেখান থেকে মান্ডি বাহাউদ্দিন ক্যাম্প। গন্তব্যে পৌঁছে লুলুর চক্ষু ছানাবড়া। কাঁটাতারে ঘেরা একটা কম্পাউন্ড। বন্দুক নিয়ে পাহারা দিচ্ছে রুক্ষ চেহারার সেপাইরা। এই আবাসনটা তৈরি হয়েছিল জওয়ানদের জন্য। ঘরের ভেতরে ঢুকে এক লাফে বেরিয়ে এল লুলু। কীভাবে চার সন্তান নিয়ে তারা ছয়জন এখানে থাকবে? দুটো ছোট কামরা, একটা বাথরুম আর সামনের ছোট্ট বারান্দায় রান্নার ব্যবস্থা। কী যে অপরিষ্কার এই ঘরদোর! মনে পড়ল, লুলুর সামনে-পেছনে বাগানওয়ালা বাংলোগুলো, যেখানে বিয়ের পর থেকে থেকেছে লুলু। আর বিয়ের আগে ৩৭ নাজিমুদ্দিন রোডের আড়াই বিঘা জমির ওপর গড়া সেই বাসস্থান! হায় জীবন! কোথায় ব্যাটম্যান আর কোথায় জমাদার! কোমরে শাড়ি গুঁজে, নিজ হাতে সব পরিষ্কার করল লুলু। শুরু হলো তার ক্যাম্প সংসার।
ক্যাম্পের ভেতরেই রয়েছে সিএসডি। সপ্তাহে এক দিন করে সব সাপ্লাই আসে, দ্রুত গিয়ে কিনতে না পারলে সব শেষ হয়ে যায়। মাংস বা মুরগি বেশ দুষ্প্রাপ্য। গতকাল কী হলো, সদ্য কিছু মুরগি এসেছে। অল্পক্ষণেই তা কেনাবেচা শেষ। শেষ মুরগিটা নিয়ে দুই অফিসারের মধ্যে প্রায় হাতাহাতি অবস্থা। একজন মুরগির পায়ের দিক ধরেছেন আর একজন গলার দিক। আমি আগে নিয়েছি, আমি আগে নিয়েছি, বলতে বলতে দুজনেই দুদিক থেকে টান দেওয়াতে মুরগির মুণ্ডু ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একজনের হাতে এসে গেল। ঘটনায় দুই অফিসারই বিব্রত।
লুলুর আপন চাচাতো বোন নীলুর স্বামী আহরার চৌধুরী। তারা পোস্টেড ছিল শিয়ালকোটে। সেখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কোহাট ক্যাম্পে। কোহাট থেকে আবার স্থানান্তর করা হলো এই মান্ডি বাহাউদ্দিন ক্যাম্পে। নীলুরা যখন এসে নামল, তাদের দিকে তাকাতে পারছিল না লুলু। অন্তঃসত্ত্বা নীলু কীভাবে এই লম্বা ট্রেন ভ্রমণ করে এল! ডাক্তারখানা বলতে একটা ঘর। সেখানেই ড. রোকেয়া আনিসের হাতে নীলুর মেয়ে জন্মাল। কী ফুটফুটে সেই মেয়ে! তাদের ক্যাম্পজীবনে কিছুটা আনন্দ নিয়ে এল এই ছোট্ট শিশুটি। তিন দিন পর্যন্ত লুলুই সব করল। নীলুটা ভীষণ ফ্যাকাশে আর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এই সুন্দরী ক্যাম্প-কন্যার নাম রাখা হলো মিম।
কিছুদিন যেতে না যেতেই নতুন উৎপাত শুরু হলো। পাহারাদার সেপাইরা কয়েক দিন পরপর বাড়ি তল্লাশি শুরু করল। অভিযোগ, নাশকতার আশঙ্কা বা তাদের কাছে খবর আছে, অফিসারদের কাছে বেআইনি অস্ত্র লুকানো আছে—এমন সব অভিযোগ। আর খোঁজার সে কী ধরন! তোশক-বালিশ তো লন্ডভন্ড করেই, রান্নাঘরের মসলার কৌটাগুলো পর্যন্ত বাদ যায় না। চাকু ঢুকিয়ে সব তল্লাশ করা হয়। সবাই বোঝে আসলে তারা কী খুঁজছে, কিন্তু বুঝেও না বোঝার ভান করে। পর্দা সরিয়ে সরিয়ে দেখে পর্দার সঙ্গে কোনো পুঁটলি বাঁধা আছে কি না, যেখানে থাকতে পারে দামি অলংকার। একবার তো এক সেপাই বলেই বসল, ‘তুমতো কর্নেল কা বিবি হো, তোমহারা কোই জিউরাত নেহি, এয়সা কাভি নেহি হো সাক্তা, কিধার ছুপায়া জিউরাত?’ লুলু মনে মনে একচোট হাসল। ব্যাটারা, তোরা গয়না পাবি কোথায়? সব তো পানির দামে বিক্রি করে দিয়ে এসেছি। এমনকি লুলুর এত সাধের বিয়ের সেটটাও। দু-একটা যা চুড়িটুড়ি ছিল, তা তাদের এক পাঞ্জাবি সহকর্মী বন্ধুর কাছে আমানত রেখেছে।
বিক্রি না করে উপায় ছিল না। তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা ওই গয়নাগুলো আরও বাড়িয়ে দিতে পারত। ভাবতেই বুকটায় মোচড় দিয়ে ওঠে লুলুর। বিয়ের গয়না বলে কথা। দুঃখ নেই, এই ক্যাম্পজীবনে পেট ভরে সন্তানদের খাবার খাওয়াতে টাকাগুলো কাজে লাগছে। ছাতুর মতো সব আটা, তাই দিয়ে রুটি বেলে লুলু। সবজির পরিমাণও যথেষ্ট নয়। শিলুটা পেট ভরার অভিনব এক কায়দা শিখে নিয়েছে। সবজি শেষ হয়ে গেলে শিলু এক কাপ চা নেয়। তাতে বেশ চিনি দেয়। রুটিকে রোল করে সেই মিষ্টি চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খায়। লুলু চেয়ে চেয়ে দেখে। কখনো মজা পায়, কখনো ভাবে, স্বাভাবিক অবস্থায় এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে কি কখনো চায়ের অভ্যাস করতে দিত সে।
হঠাৎ একদিন আদেশ এল রেডিও, টুইনওয়ান ইত্যাদি রাখা চলবে না। ওগুলো নাকি সংকেত প্রেরণে ব্যবহার হতে পারে, তাই সেগুলো নিরাপত্তার পক্ষে হুমকি। সেপাইগুলোর চোখ চকচক করছিল। রাগে-অপমানে বাঙালি অফিসাররা সব যন্ত্র একখানে করে আছাড় দিয়ে ভাঙল।
সময় কীভাবে চলে যায়। প্রায় দুই বছর পার হয়ে গেল ক্যাম্পে। একপর্যায়ে স্বাক্ষরিত হলো বন্দিবিনিময় চুক্তি। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে মান্ডি বাহাউদ্দিনের সংসার গুটিয়ে লুলু আর অসংখ্য আটকে পড়া বাংলাদেশি পরিবার তাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
রেডক্রসের চার্টার্ড প্লেনটা যখন কুর্মিটোলা এয়ারপোর্ট স্পর্শ করণ, লুলুর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘৩৭ নাজিমুদ্দিন রোড, চানখাঁর পুল, হোসেনি দালান, বর্ধমান হাউস, মেডিকেল কলেজ, শহীদ মিনার...দেখো দেখো, আমি তোমাদের লুলু, আমি এসে গেছি!’ এয়ারপোর্টে অলি আর নজু ভাইকে দেখে লুলুর মুক্তঝরানো হাসি যেন আর থামতে চায় না।
বিবাহিত জীবনের সবটুকু পার্থিব অর্জন ফেলে শূন্য হাতে ফিরে এল লুলু। এখন নতুন করে আবার সংসার গড়বে তারা। শিখুর কলকলানিতে তৈরি হবে কত না আনন্দঘন মুহূর্ত! দুলাভাই (ড. আশরাফ সিদ্দিকী) কোনো রাতে খাট ভেঙে সেই ভাঙা খাটে শুয়ে থাকলে শিখু তার আধো আধো বলে বলবে, ‘খালু ধপ আবাল গুম।’ আর পান খাওয়া অলি খালাম্মার মুখ থেকে চিবোনো পান তর্জনী দিয়ে টেনে নিতে নিতে বলবে, ‘খাম্মা, ছালিয়া খাব, ছপ খাব।’
বিছানায় শুয়ে পায়ের ব্যথায় এপাশ-ওপাশ করছিল লুলু। এরই মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল সে যেন সেই রাওয়ালপিন্ডির ট্রেঞ্চে। আবদুল হক আটক পাকিস্তানিদের হাতে। দুষ্টু সাব্বিরটা ছোঁ মেরে তার শিলু আর শিখুকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সাব্বির সাব্বির বলে চিৎকার করতে করতে ঘুম ছুটে গেল লুলুর। চোখ মেলে দেখে ভোর হইহই করছে। ফ্যানের বাতাসে ক্যালেন্ডারটা উড়ছিল। তা থেকে আওয়াজ হচ্ছিল—খটখট। সেদিকে চোখ পড়তেই দেখল ২০২১ সাল।
আশ্চর্য! পঞ্চাশ বছর আগের উদ্বেগ তাকে এখনো তাড়া করে! সে তো এখন ডিওএইচএসে, তার নিজের বাড়িতে। ১৯৮৩ সালে স্বামী মেজর জেনারেল এ এফ এম আবদুল হকের অবসরের পর থেকে এ বাড়িতেই রয়েছে লুলু। একে একে চলে গেছে ভাইবোনেরা, এমনকি তার ছোট ভাই রুকু। তাকে একা ফেলে আবদুল হকও চলে গেছে ২০০৩ সালে। সিরাজ জিন্নাত নেই। নেই রোকেয়া আনিস। আজ নেই তার পাশে তার বড় তিন সন্তান সিমু, শিলু ও শিখু। শিমু শান্তিতে শুয়ে আছে চট্টগ্রামে গরীবুল্লাহ শাহের পায়ের কাছে। ১৯৯০-এর দশকজুড়ে একনামে সবাই চেনে সেই সিলসের উদ্যোক্তা, তার শিলু শুয়ে আছে কাছেই বনানীতে। প্রাণঘাতী ক্যানসারের শেষ আক্রমণের আগে শিখু বলে গিয়েছিল তাকে যেন আটলান্টাতেই রাখা হয় তার দুই ফুটফুটে মেয়ের কাছে। তা-ই হয়েছে।
তিন দিন এভাবে ক্রমাগত চলার পর করাচি, এরপর সেখান থেকে মান্ডি বাহাউদ্দিন ক্যাম্প। গন্তব্যে পৌঁছে লুলুর চক্ষু ছানাবড়া। কাঁটাতারে ঘেরা একটা কম্পাউন্ড। বন্দুক নিয়ে পাহারা দিচ্ছে রুক্ষ চেহারার সেপাইরা। এই আবাসনটা তৈরি হয়েছিল জওয়ানদের জন্য। ঘরের ভেতরে ঢুকে এক লাফে বেরিয়ে এল লুলু। কীভাবে চার সন্তান নিয়ে তারা ছয়জন এখানে থাকবে? দুটো ছোট কামরা, একটা বাথরুম আর সামনের ছোট্ট বারান্দায় রান্নার ব্যবস্থা। কী যে অপরিষ্কার এই ঘরদোর!
তবে আছে, তার বুকজুড়ে আছে ১৯৭১-এর রাওয়ালপিন্ডিতে জন্মানো ছোট ছেলে রাজি। সে এখন বিলেতে বড় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। শিলুর আইটি স্পেশালিস্ট ছেলে মারুফ আর নাতবউ, তার বাসাতেই পাঁচতলায় থাকে। রোজ তার খোঁজ নেয়। সিমুর ছেলে ভিকি থাকে কানাডায়। শিখুর দুই মেয়েই মায়ের মতো ডাক্তারি পড়েছে। ছোটটা এখন স্পেশালাইজ করছে অনকোলজিতে। রাজি যখন স্কাইপে রোজ লুলুর সঙ্গে কথা বলে, ছোট নাতি তার মিষ্টি মুখে, রাগত চোখে লুলুকে বলে, ‘আমার বাবা তোমার না।’
ড. সিরাজ জিনাতের মান্ডি বাহাউদ্দিন ক্যাম্পে খেলে বেড়ানো বড় ছেলে মাসুম এখন লন্ডনে স্পেশালিস্ট সার্জন। ছোট্ট মামুন আজ হার্ট ফাউন্ডেশনের হেড সার্জন। ড. রোকেয়া আনিসের মেয়ে রায়ান আনিস দেশের নামকরা কার্ডিওলজিস্ট। ক্যাম্পে জন্মানো সেই মিমের ছেলেই এখন বিবিএ পড়ছে। ট্রেঞ্চে পাশে বসা মোর্শেদার ছেলেরা গড়ে তুলেছে মোমেন রিয়েল এস্টেট। লুলুর এই ডিওএইচএসের বাড়ি তাদেরই তৈরি।
জীবনের এই অধ্যায়ে এসে লুলু সবাইকে বলে, যে মুহূর্তে যেভাবেই থাকো, জীবনের সবটুকু দান আকণ্ঠ পান করো। কারণ, জীবন তার ভাঁজে ভাঁজে কত যুদ্ধই যে পুরে রেখেছে! সেসব যুদ্ধে কখনো হার, কখনো জিত। মুক্তি নেই, লড়ে যেতে হবে শেষ দিন পর্যন্ত। লুলু তো সাহসের সঙ্গেই লড়ে যাচ্ছে তার জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একেকটা একাত্তর।