লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-১৪: হুমায়ূন স্যারের হাত ধরেছিলাম

কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করবেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।

হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আনিস, আমার জীবনের দাম কী! এই শহরে আমার মেয়েরা আছে, তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয় না কত বছর, তুমি জানো?
হুমায়ূন আহমেদের ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস

হুমায়ূন আহমেদ—হুমায়ূন স্যার আমাকে বই উৎসর্গ করলেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। এর পর থেকে তাঁর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। স্যার কোনো অনুষ্ঠান করলে আমাকে ডাকতেন। মেহের আফরোজ শাওনের গানের অ্যালবাম বেরোবে। আমি গেলাম। স্যার আমাকে বক্তৃতা দিতে বললেন।

বাকি ঘটনা আমি আমার আগের একটি লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি:

এরপর স্যারের সঙ্গে আবারও দেখা হয়েছে। সাগর ভাইয়ের বাড়িতে। ঢাকা ক্লাবে ওস্তাদ আকবর আলী খানের সেতারবাদনের অনুষ্ঠানে। দেখা হলে স্যার বলেছেন, ‘আনিস, কাছে আসো। আনিস লেখক। ও ব্যাপারটা বুঝবে।’ বলে তিনি আমাকে কাছে টেনে নিয়েছেন এবং যে বিষয়টা নিয়ে আলাপ হচ্ছে, সেটাতে আমাকে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। আসলে পাত্তা দিয়েছেন অন্যদের সামনে।

লেখকদের সঙ্গে লেখকদের কোথাও একটা এই রকমের আত্মীয়তার সংযোগ থাকেই। এক লেখক হয়তো আরেক লেখকের বেদনা বুঝতে পারেন।

আমি একদিন এই রকম একটা দাওয়াতের আসরে স্যারের পাশে বসে আছি। স্যার একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছেন। আমি বলি, স্যার, আপনার না হার্টের অপারেশন হয়েছে। এত সিগারেট খান কেন?

স্যার বলেন, আনিস, আমার জীবনের দাম কী! এই শহরে আমার মেয়েরা আছে, তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয় না কত বছর, তুমি জানো?

হুমায়ূন আহমেদ
ছবি: অন্য আলো

আমি বলি, স্যার, আপনার দুঃখটা জেনুইন, কিন্তু আপনার সিগারেট খাওয়ার কারণ এটা নয়। আপনি আগেও সিগারেট খেতেন। এখন এটাকে কারণ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন।

বহু বছর আগের কথা। হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে নেত্রকোনায়। হাসান আজিজুল হক প্রধান অতিথি। আমি অন্যতম বক্তা। হাসান স্যারের সঙ্গে মাইক্রোবাসে আমরা নেত্রকোনা গিয়েছিলাম। রাতে খাওয়ার টেবিলে হুমায়ূন স্যার আমাদের খোঁজখবর করছিলেন। আমি বললাম, ‘স্যার, অনুষ্ঠানের পরে সাধারণত উদ্যোক্তারা আর খোঁজখবর রাখেন না। এর আগে একবার নেত্রকোনায় এসেছিলাম কবি হেলাল হাফিজ ভাইয়ের সংবর্ধনায়। আসার সময় মাইক্রোবাসে এলাম। ফেরার সময় মাইক্রোবাসের ড্রাইভার হারিয়ে গেল। শেষে পরের দিন বাসে ফিরতে হলো। কী হয়েছিল শোনেন...’ আমি প্রসঙ্গটা পাড়ছিলাম স্যারের সঙ্গে একটা হাসির অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার জন্য, ‘পরের দিন ভোরবেলা প্রথম বাসটাতে উঠিনি বাসস্ট্যান্ডের চায়ের লোভে। দ্বিতীয় বাসটা ধরে খানিকক্ষণ আসার পর দেখি, প্রথম বাসটা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। ওই বাস থেকে যাত্রীরা নামছেন, প্রত্যেকের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। কুয়াশার মধ্যে সামনের গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে ওই বাস তার প্রত্যেক যাত্রীর নাক কেটে যাত্রাভঙ্গ করেছে। এক কাপ চা আমার নাক বাঁচিয়ে দিয়েছে।’ কিন্তু স্যার হাসছিলেন না। তাঁর চোখমুখ শক্ত হতে শুরু করল। নেত্রকোনায় অতিথিকে ঠিকভাবে খাতির-যত্ন করা হয়নি নাকি? স্যার রেগে যাচ্ছেন। আমি কিছুতেই আর পরিবেশ লঘু করতে পারি না।

এতক্ষণ লেখার পরে মনে হচ্ছে, এই লেখায় এখন পর্যন্ত আমি যা লিখেছি, তার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে, দেখো, হুমায়ূন আহমেদ স্যার আমাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, আমি তাঁর কত কাছাকাছি হতে পেরেছিলাম।

আমি এতক্ষণ এটা সজ্ঞানে করিনি, লেখার তোড়ে করেছি। এখন আমি সজ্ঞানে বলতে চাই, হুমায়ূন আহমেদ হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের সেই পুরুষ, যাঁর সঙ্গে ‘আমার কথা হয়, আমার যোগাযোগ আছে’—এই রকম বলতে পারা যেকোনো তরুণ লেখকের জন্য অনেক বড় গৌরবের ব্যাপার। আমার জন্য তো বটেই।

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আনিসুল হক।
ছবি: সংগৃহীত

২০১১ সালের এপ্রিলের একদিন। আমি ‘দখিন হাওয়া’য় যাচ্ছি স্যারকে শুভেচ্ছা জানাতে, তাঁর আরোগ্য কামনা করতে। দুপুরবেলা। স্যার লুঙ্গি পরে খালি গায়ে বারান্দায় বসে আছেন। আমি আর আলীম আজিজ সালাম দিলাম। স্যার বললেন, দেখতে এসেছ, ভালো কথা। ভিড় করার দরকার নাই। যাও।

আমি বললাম, স্যার, ভালোভাবে যান, নিউইয়র্ক থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। আপনাকে আমাদের সাহিত্যের, প্রকাশনার, বইমেলার আরও অন্তত বিশ বছর দরকার।

স্যার বললেন, শোনো, তুমি যদি চাও তো মাত্র বিশ বছর চাচ্ছ কেন? বেশি করে চাও। এক শ বছর চাও। এক হাজার বছর চাও।
আমি হেসে ফেললাম।

স্যার হচ্ছেন জন্মরসিক। নিজের অসুখ নিয়ে তিনি নিষ্ঠুর রসিকতা করবেন। আশপাশের লোকদের অসহায়ত্ব দেখে আনন্দ পাবেন। আর তাঁকে ঘিরে লোকজন যে অকৃত্রিম কিংবা কৃত্রিম অভিব্যক্তি চোখেমুখে সংলাপে ফুটিয়ে তুলবে, তা লক্ষ করে মজা পাবেন এবং মজা করবেন। এই ধরনের মানুষকে ক্যানসার পরাজিত করতে পারবে না। মৃত্যু তাঁর কাছ থেকে এক শ হাত দূরে থাকতে বাধ্য।
‘দখিন হাওয়া’র দক্ষিণ দিকের বারান্দায় স্যার। আলো আসছে সেই বারান্দাপথে। স্যার সেই আলোর মধ্যে বসে আছেন। দৃশ্যটার মধ্যে একটা অপার্থিবতা আছে। এই মানুষটা আমাদের বেড়ে ওঠার আনন্দের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমরা বড় হয়েছি তাঁর বই পড়ে। ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস পড়ে। তাঁর ‘নন্দিত নরকে’ সেদিন কে যেন ফেসবুকে তুলে দিয়েছে। আশ্চর্য, অতি অল্প বয়সে এই রকমের দরদমাখা ভাষা, এই রকম মায়াভরা গল্প, এই রকম নিজস্বতা একজন তরুণ অর্জন করেছিলেন কীভাবে! তিনি আর কারও মতো নন। তিনি তাঁর নিজের মতো। তিনি লেখেন পূর্ব বাংলার ভাষায়। সেই ভাষা সরল, কিন্তু নিরাভরণ নয়। তিনি বর্ণনা এড়িয়ে যান না, কিন্তু সেই বর্ণনা পাঠককে নিমজ্জিত করে, দূরে ঠেলে দেয় না। তিনি টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখলেন এবং পাল্টে দিলেন আমাদের টেলিভিশন নাটককে। ‘আপনার যাওয়া লাগবে না’, হুমায়ুন ফরীদিকে বলা ছোট্ট মেয়েটির সেই সংলাপ আমি ভুলতে পারি না। সংলাপ যে মুখের ভাষায় লিখতে হয়, সেটা তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন। কী সব নাটকই না হতো আশি আর নব্বইয়ের দশকে আমাদের টেলিভিশনে। হুমায়ূন আহমেদের নাটক মানে সেই রাতটা আমাদের উৎসবের রাত। আলুচচ্চড়ি খাওয়া পরিবারে ওই রাত যেন পোলাও-কোর্মার রাত। তাঁর ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ আমাদের দিয়েছে দল বেঁধে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার আনন্দ।

আমাদের দিবসরজনীগুলোকে আনন্দপূর্ণ অর্থময়তা দিয়েছেন এই খালিগা লোকটা, তাঁর এই ডান হাতটা দিয়ে লিখে, এখন বসে আছেন আলো-ঝলমলে বারান্দায়।
আমি স্যারের কাছে গেলাম। তাঁর ডান হাতটা দুই হাতে চেপে ধরলাম। বেস্ট অব লাক স্যার। গেট ওয়েল সুন।
স্যার বললেন, শোনো, তোমার লেখা কিন্তু আমি পড়ি। এই সপ্তাহের গদ্যকার্টুনে তো সব পুরোনো জোকস দিয়েছ।আমি কী বলি, আর স্যার কী বলেন।

বহু বছর আগের কথা। হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে নেত্রকোনায়। হাসান আজিজুল হক প্রধান অতিথি। আমি অন্যতম বক্তা। হাসান স্যারের সঙ্গে মাইক্রোবাসে আমরা নেত্রকোনা গিয়েছিলাম। রাতে খাওয়ার টেবিলে হুমায়ূন স্যার আমাদের খোঁজখবর করছিলেন। আমি বললাম, ‘স্যার, অনুষ্ঠানের পরে সাধারণত উদ্যোক্তারা আর খোঁজখবর রাখেন না। এর আগে একবার নেত্রকোনায় এসেছিলাম কবি হেলাল হাফিজ ভাইয়ের সংবর্ধনায়। আসার সময় মাইক্রোবাসে এলাম। ফেরার সময় মাইক্রোবাসের ড্রাইভার হারিয়ে গেল। শেষে পরের দিন বাসে ফিরতে হলো। কী হয়েছিল শোনেন...’ আমি প্রসঙ্গটা পাড়ছিলাম স্যারের সঙ্গে একটা হাসির অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার জন্য, ‘পরের দিন ভোরবেলা প্রথম বাসটাতে উঠিনি বাসস্ট্যান্ডের চায়ের লোভে। দ্বিতীয় বাসটা ধরে খানিকক্ষণ আসার পর দেখি, প্রথম বাসটা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। ওই বাস থেকে যাত্রীরা নামছেন, প্রত্যেকের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। কুয়াশার মধ্যে সামনের গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে ওই বাস তার প্রত্যেক যাত্রীর নাক কেটে যাত্রাভঙ্গ করেছে। এক কাপ চা আমার নাক বাঁচিয়ে দিয়েছে।’ কিন্তু স্যার হাসছিলেন না। তাঁর চোখমুখ শক্ত হতে শুরু করল।

হুমায়ূন আহমেদ নামের এই লোকটা অন্য ধাতুতে গড়া। শামসুর রাহমানের ৫০তম জন্মদিনে সৈয়দ শামসুল হক একটা কবিতা লিখেছিলেন। শামসুর রাহমান, আপনি দীর্ঘজীবী হোন, ত্বরান্বিত হোক আমাদের স্বপ্নসমূহের অনুবাদ।
সৈয়দ শামসুল হকই আরেকবার, বহু বছর আগে, হাসপাতালে অসুস্থ হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গিয়ে বলেছিলেন, হুমায়ূন, তোমাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে, কারণ তোমার ডান হাতে পাঁচ আঙুল নয়, ছয় আঙুল। ষষ্ঠ আঙুল হলো তোমার কলম। তোমাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে, কারণ, তুমি ছয় আঙুল নিয়ে জন্মেছ।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর নোবেল পুরস্কার ভাষণে এক বিপরীত ইউটোপিয়া নির্মাণের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, যুদ্ধ, বন্যা, মহামারি সত্ত্বেও আমার উত্তর হচ্ছে জীবন। পারমাণবিক যুদ্ধে ধ্বংস আসন্ন জেনেও লেখকদের কর্তব্য হচ্ছে বিপরীত একটা ইউটোপিয়া নির্মাণ করা।

বাংলাদেশের লেখকেরা এই দায় নিয়ে জন্মেছেন। ১৬ কোটি মানুষের দুঃস্বপ্নতাড়িত বাস্তবতার বিপরীতে এক স্বপ্নজগৎ নির্মাণ করা, যেখানে জ্বলজ্বল করবে জীবন, আশা, আনন্দ।
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সেই আশা, আনন্দ ও স্বপ্নলোকের প্রধান নির্মাতা। সৈয়দ শামসুল হকের মতো করে বলি, হুমায়ূন আহমেদ, আপনি দীর্ঘজীবী হোন, ত্বরান্বিত হোক আমাদের স্বপ্নসমূহের অনুবাদ।

আমি হুমায়ূন স্যারের ডান হাত দুই হাতে ধরে আছি, মুহূর্ত কয়েকের জন্য। দখিন হাওয়া বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় তখন অনেক আলো। (চলবে)
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১১ নভেম্বর ২০১২