শব্দ হারানোর দিনে

করোনার দমবন্ধ সময়ে অনেক লেখকই থমকে আছেন, লিখতে পারছেন না কিছু। ‘রাইটার্স ব্লক’ থেকে মুক্তির উপায় কী? এই বন্ধ্যা অবস্থায় কী করতেন লেখকেরা? অন্তর্জাল ঘেঁটে জানাচ্ছেন নুসরৎ নওরিন

রাইটার্স ব্লক কাটানোর জন্য আর্নেস্ট হেমিংওয়ে দাঁড়িয়ে লিখতে পছন্দ করতেন।

লেখালেখি নির্জনতা দাবি করে। তাই মহামারির বাধ্যতামূলক বিচ্ছিন্নতার দিনগুলো লেখালেখির জন্য স্বর্ণখনি হওয়ার কথা ছিল। অনেকের ক্ষেত্রে তা কিন্তু হয়নি। অরেঞ্জ প্রাইজ বিজয়ী আমেরিকান ঔপন্যাসিক লিন্ডা গ্রান্ট যেমন বলছেন, ‘আমি আমার কল্পনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারছি না। সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারছি না। সারা পৃথিবীতে কী চলছে, আমার মস্তিষ্ক তা-ই বুঝে উঠতে ব্যস্ত।’ ব্রিটিশ বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক জন কার্টেনে গ্রিমউড বলেছেন, ‘বিষয়টা খুবই অদ্ভুত। আমরা সারা জীবন বলে এসেছি আমাদের যদি একটা গুহায় আটকে রাখা হয়, তবে ডেডলাইন এবং প্রেরণার কোনো সমস্যাই থাকবে না। তারপর এটা ঘটল এবং দেখা গেল এটা একটা বিপর্যয়।’

শুধু মহামারির ক্রান্তিকাল নয়, স্বাভাবিক সময়েও ‘রাইটার্স ব্লক’একজন লেখকের জীবনের স্বাভাবিক অংশ। ১৯৪০-এর দশকে আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী এডমন্ড বার্গলার প্রথম ‘রাইটার্স ব্লক’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন। তবে সমস্যাটিকে লেখালেখির ইতিহাসের সমান বয়সী বলা যেতে পারে।

১৮৮১ সালের কলেরা মহামারির সাক্ষী মার্ক টোয়েন ও ১৯১৮-১৯-এর স্প্যানিশ ফ্লু দেখা আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কিংবা এফ স্কট ফিটজেরাল্ডের মতো খ্যাতনামা অনেক লেখক এই সমস্যায় ভুগেছেন। ইংরেজি ভাষার সাহিত্যিক এস টি কোলরিজ, হারম্যান মেলভিল, জোসেফ কনরাড আছেন এ তালিকায়।

লেখা নিয়ে চিন্তা করতে করতে পায়চারি করেন ফিলিপ রথ।

মার্ক টোয়েন তাঁর দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব হাকলবেরি ফিন-এর কাজ দুই বছর করতে পারেননি। কীভাবে লেখাকে এগিয়ে নেওয়া যায়, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগিয়ে যাওয়ার সিক্রেট হলো শুরু করা। শুরু করার সিক্রেট আপনার জটিল ও বিপুল কাজগুলোকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে ফেলা এবং এগুলোর মধ্যে প্রথমটি থেকে আরম্ভ করা।’

জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ড্যান ব্রাউন লেখার মধ্যে একঘেয়েমি কাটাতে একটা বিশেষ ফ্রেমের সাহায্য নেন। গ্র্যাভিটি জুতো পায়ে তিনি সেই ফ্রেমে পা ওপরে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলে থাকেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে দাঁড়িয়ে লেখা পছন্দ করতেন। বুকসমান উঁচু একটা শেলফে টাইপরাইটার সেট করে নিয়েছিলেন তিনি। দাঁড়িয়ে লেখার অভ্যাস ছিল ভার্জিনিয়া উলফ ও লুইস ক্যারলেরও। অন্যদিকে ফিলিপ রথ লেখা নিয়ে চিন্তা করতে করতে পায়চারি করেন। তাঁর দাবি, প্রতি পৃষ্ঠা লেখার জন্য তিনি আধা মাইল হাঁটেন। ট্রুম্যান কাপোটির অভ্যাস ছিল শুয়ে শুয়ে লেখা। এ সময় তাঁর এক হাতে কফি কিংবা শেরি অথবা মার্টিনি থাকত, অন্য হাতে কলম। প্যারিস রিভিউকে বলেছেন, ‘আমি সম্পূর্ণ অনুভূমিক একজন লেখক।’ টু কিল আ মকিংবার্ড-এর লেখক হার্পার লি তাঁর না
লিখতে পারার জন্য দায়ী করেছিলেন বন্ধুদের অযাচিত ভিড়কে। নিমন্ত্রণহীন বন্ধুরা হুটহাট চা খেতে এসে নাকি তাঁর লেখার সময় নষ্ট করতেন।

ট্রুম্যান কাপোটির অভ্যাস ছিল শুয়ে শুয়ে লেখা

এই সমস্যা কাটাতে ইংরেজ লেখক নিল গেইম্যান বলেন, ‘কয়েক দিনের জন্য লেখাটা বন্ধ রাখুন। অন্য কিছু করুন। ওটা নিয়ে না ভাবার চেষ্টা করুন।’ তিনি বলেন, এরপর বসে লেখাটি প্রথম থেকে এমনভাবে পড়তে হবে, যেন এটাই প্রথম পড়া। কোনো সংশোধন থাকলে পাণ্ডুলিপিতে লিখে রাখতে হবে।

অনেক সময় মাথায় প্রচুর শব্দ আসে, লেখার উৎসাহে টগবগিয়ে ফুটতে থাকেন লেখক। হেমিংওয়ে এমন সময়ে এক বসায় সব লিখে ফেলার বিরোধী। তাঁর মতে, তখন বরং থামা উচিত। প্রতিদিন স্বাভাবিকভাবে লিখে যাওয়া উচিত। পরদিন আবার লিখতে শুরু করার আগপর্যন্ত লেখাটা নিয়ে ভাবারও দরকার নেই। এভাবে অবচেতন মন সব সময় বিষয়টা নিয়ে কাজ করতে থাকবে। কিন্তু সচেতনভাবে ভাবলে বা দুশ্চিন্তা করলে লেখাটা নষ্ট হবে, শুরু করার আগেই ক্লান্তি চলে আসবে।

হিলারি ম্যানটেলের এ রকম সময় লেখার ডেস্ক থেকে দূরে থাকতে বলেন। ‘হাঁটুন, গোসল করুন, ঘুমান, রান্না করুন, গান শুনুন, ধ্যান কিংবা ব্যায়াম করুন।...কিন্তু কাউকে ফোন করবেন না কিংবা পার্টিতে যাবেন না, তাহলে অন্যদের কথাবার্তা আপনার হারানো শব্দের জায়গা নিয়ে নেবে।’

নোবেলজয়ী টনি মরিসন ‘রাইটার্স ব্লক’ শব্দটিকেই স্বীকার করতে চান না। ১৯৯৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কখনো কখনো এমন সময় আসে, যখন আপনি জানেন না আপনি কী করছেন। কোন ভাষায় লিখবেন বা কী ঘটনা লিখবেন, সেটা আপনার আসে না। বিলাভেড লেখার সময় আমি তিন বছর এটা নিয়ে ভেবেছি।...লিখতে আমার আরও তিন বছর লেগেছিল। কিন্তু আগের তিন বছরও আমি কাজই করছিলাম, যদিও একটা শব্দও লিখিনি।’

একজন পাঠকের প্রশ্নের জবাবে ঝুম্পা লাহিড়ী বলেন, ‘...কেউ যদি নিয়মিতভাবে একটা শিডিউল মেনে লিখে যায়, তাহলে কিছু একটা হবেই।’ ঝুম্পার লেখালেখি কখনো আটকে গেলে তিনি বই পড়েন। বিরতি নেওয়ার কথা বলেন ঔপন্যাসিক প্যাট বার্কারও। ‘...শব্দ আসছে না মানে এখনো শব্দটা লেখার সময় হয়নি। একটি বিরতি নিন এবং অন্য কিছু করুন, আপনার মনের মধ্যে এটাকে থিতু হতে দিন...।’

কথিত আছে, ভিক্টর হুগোর ভৃত্যের দায়িত্ব ছিল তাঁর সব জামাকাপড় লুকিয়ে ফেলা, যাতে তিনি সম্পূর্ণ নগ্ন থাকেন বা শীতের দিনে বড়জোর কম্বলের মধ্যে থাকেন। এর উদ্দেশ্য তিনি যাতে লেখা বাদ দিয়ে কোনোভাবেই বাইরে না যান। হুগোর মতো লেখায় নিজেকে বাধ্য করতে ঔপন্যাসিক জনাথন ফ্র্যানজেন তাঁর কম্পিউটারের ইথারনেট পোর্ট বন্ধ রাখেন, যাতে বাইরে না গেলেও ইন্টারনেট হয়ে বাইরের দুনিয়া ঘরে ঢুকে না যায়।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, কেবিনেট ম্যাগাজিন ডট ওআরজি, নিকোল বিয়াঙ্কি ডটকম, লিটহাব ডটকম, দ্য টাইমস