শশিভূষণ পাল: বাংলার বিস্মৃত চিত্রশিল্পী
বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া এক চিত্রশিল্পীর নাম শশিভূষণ পাল। তাঁর প্রচেষ্টায় এই পূর্ব বাংলায় গড়ে উঠেছিল শিল্প–শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’। আজ এই শিল্পীর জন্মদিনে চোখ ফেরানো যাক তাঁর জীবন ও কর্মে।
বাংলাদেশের শিল্পকলায় পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী শশিভূষণ পাল (১৮৭৮-১৯৪৬)। বর্তমান বাংলাদেশ ভূসীমানায় প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি। বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে এই মহান শিল্পীর অবদান ও সৃষ্টি অনেকটাই বিস্মৃতই রয়ে গেছে। বাংলার এই শিল্পী দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশ থেকে একদিন সুখ্যাতি বয়ে এনেছিলেছন, তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যক্তিপ্রচেষ্টায় এ দেশের প্রথম শিল্প–শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’। তবে আজকের বাস্তবতায় এই শিল্পী অনেকটাই বিস্মৃত। অকিঞ্চিৎকর এই লেখাটি মূলত পরিচিতিমূলক। আজ শশিভূষণ পালের জন্মদিনে তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি কিছুটা আলো ফেলাই এ লেখার উদ্দেশ্য।
শশিভূষণ পাল খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশার বৈশ্য বারুজীবী বংশে বাংলা ১২৮৪ সনের পৌষসংক্রান্তির দিনে (১৪ জানুয়ারি ১৮৭৮) জন্মগ্রহণ করেন। সাংস্কৃতিক পরিবেশে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর বাবা শ্রীমন্ত পাল ছিলেন সংগীতানুরাগী। তিনি মুখে মুখে গান রচনা ও বিভিন্ন ধরনের ছড়া তৈরি করতেন।
শশিভূষণের শিল্পপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় শৈশব থেকেই। অল্প বয়সেই তিনি তৈরি করতে থাকেন নানা কিছু। মাটির পুতুল, কাঠ দিয়ে রেলগাড়ি, ঘড়ি, বাঁশি, বেহালা প্রভৃতি। বাংলা ও ইংরেজি হুবহু কপি করে লিখতে পারতেন শিশু শশিভূষণ।
পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নিয়মিতভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি তিনি। খুলনার দৌলতপুরের এন্ট্রান্স স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর আর পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি। বাবার মৃত্যুর পর কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন তিনি। তবে শিল্পের প্রতি দুর্নিবার আগ্রহের কারণে মাঝেমধ্যে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে যেতেন।
সে সময়ের খ্যাতিমান শিল্পীদের অনুপ্রেরণা এবং আর্ট স্কুল থেকে চিত্রবিদ্যার পদ্ধতি-কলাকৌশল শিখে এসে নিজ বাড়িতে তা চর্চা করতে থাকেন শশিভূষণ। একপর্যায়ে এ বিষয়ে খুব দ্রুতই নৈপুণ্য লাভে সক্ষম হন।
শশিভূষণ পালের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। ভারতের শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে তাঁর আঁকা একটি ছোট আকারের পোস্টকার্ড, যেটির এক পাশে ছিল সে সময়ের সারা কলকাতার দৃশ্য এবং অন্য পাশে বারো শ লাইন তিনি এমনভাবে বিন্যাস করেছিলেন যে লেখার মধ্যে দৃশ্যমান ছিল হরিদ্বারের প্রাকৃতিক দৃশ্য। এই পোস্টকার্ড ভারতের বরোদা মহারাজার জাদুঘরে সংরক্ষিত। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম রয়েছে, সেই ছবিটি সামনে থেকে দেখলে কেশব চন্দ্র সেন, ডান দিক থেকে দেখলে জাস্টিস শম্ভুনাথ এবং বাঁ দিক থেকে দেখলে রাজা রামমোহন রায়ের অবয়ব দৃশ্যমান হয়। এই ছবি বর্তমানে লন্ডন জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
আর্ট স্কুলের সে সময়ের অধ্যক্ষ মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও জাস্টিস গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে শশিভূষণ পাল নিজের আঁকা কিছু চিত্রকর্ম উপহার দেন। তাঁর ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে এই শিল্পীকে আর্থিক সম্মাননা দিয়েছিলেন তাঁরা।
প্রথম থেকেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শশিভূষণ পাল। প্রথমে তিনি সাঁওতাল পরগনার পাকুড়রাজার হাইস্কুলে যোগদান করেন, পরে খুলনার দৌলতপুর ও সেনহাটিতেও ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি শিল্পচর্চা ও বিশ্বের নানা প্রান্তে শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণও অব্যাহত রাখেন। তৎকালীন রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্যের ছবি এঁকে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেন তিনি। গ্লাসগো ও প্যারিস প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকর্ম প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হয়। ইংল্যান্ডসহ দেশ–বিদেশের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে ৪০টির বেশি স্বর্ণপদক, রৌপ্যপদক এবং সম্মানসূচক প্রশংসাপত্র অর্জন করেন তিনি।
শশিভূষণ পালের চিত্রকর্মগুলোর দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, সেগুলো আঁকা হয়েছে মূলত পশ্চিমা রীতিতে। প্রতিকৃতি অঙ্কনে তাঁর নিপুণ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ল্যান্ডস্কেপ, মানুষের অবয়বধর্মী চিত্রকর্ম এঁকেছেন। বিষয়বস্তু হিসেবে তাঁর সময়কালের চিত্র আমরা দেখতে পাই। কেতাদুরস্ত ইংরেজ সাহেব চেয়ারে উপবিষ্ট এবং তার পাশে দণ্ডায়মান ধুতি পরা দুজন ভারতীয় বাঙালি। বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহের ছবিও এঁকেছেন শশিভূষণ। এঁকেছেন রাজদরবারের চিত্র। বাদ যায়নি তাঁর সুনিপুণভাবে আত্মপ্রতিকৃতিও। ক্ষুদ্রাকৃতির চিত্রকর্মের মধ্যে অনেক মানুষের অবয়ব সুন্দর বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন তিনি। যুদ্ধের ছবিগুলোতে ঘোড়ার চিত্র আঁকায় তাঁর যে দক্ষতা, তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।
তাঁর কাজে রঙের ঘনত্ব পুরু করে উপস্থাপিত হতে দেখি আমরা। ক্যানভাসে তাঁর চিত্রকর্ম থাকলেও ক্ষুদ্র আকারের এসব চিত্রকর্মের অধিকাংশই বোর্ডের ওপর তেলরঙে আঁকা। আফসোসের বিষয় হলো, কালের পরিক্রমায় এগুলো একেবারে বিনষ্ট হওয়ার পথে।
এই চিত্রসম্পদ মানুষকে একদিন আকৃষ্ট করেছিল, শশিভূষণ পালের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। ভারতের শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে তাঁর আঁকা একটি ছোট আকারের পোস্টকার্ড, যেটির এক পাশে ছিল সে সময়ের সারা কলকাতার দৃশ্য এবং অন্য পাশে বারো শ লাইন তিনি এমনভাবে বিন্যাস করেছিলেন যে লেখার মধ্যে দৃশ্যমান ছিল হরিদ্বারের প্রাকৃতিক দৃশ্য। এই পোস্টকার্ডটি ভারতের বরোদা মহারাজার জাদুঘরে সংরক্ষিত। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম রয়েছে, সেই ছবিটি সামনে থেকে দেখলে কেশব চন্দ্র সেন, ডান দিক থেকে দেখলে জাস্টিস শম্ভুনাথ এবং বাঁ দিক থেকে দেখলে রাজা রামমোহন রায়ের অবয়ব দৃশ্যমান হয়। এই ছবি বর্তমানে লন্ডন জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
স্বদেশচেতনায় উজ্জীবিত শশিভূষণ পাল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আঁকেন ‘মাতৃপূজা’ শিরোনামের একটি ছবি। এই ছবি সে সময় মানুষকে মুগ্ধ ও উজ্জীবিত করেছিল।
চিত্রকর্মের জন্য দেশ-বিদেশে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে বহু শিল্পরসিক শশিভূষণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। এঁদের মধ্যে যেমন ছিলেন রাজপুরুষ, তেমনি ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। শশিভূষণের আগে ভারতবর্ষের কোনো চিত্রশিল্পীর জীবনে এমন ঘটনা বিরল।
তৎকালীন সময়ে ‘ডিউক অব কন্ট’ কলকাতায় এলে বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ড গভর্নমেন্ট হাউসে তাঁর সঙ্গে শশিভূষণ পালকে পরিচয় করিয়ে দেন। এ সময় তাঁকে একটি চিত্রকর্ম উপহার দেন শশিভূষণ। এই চিত্রকর্ম তিনি ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। এই চিত্রের সুবাদেই তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড লিটনের সঙ্গে শশিভূষণের সাক্ষাৎ ঘটে। ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বাংলার এই শিল্পীকে ‘রায় সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করে। শশিভূষণ পালকে গভর্নমেন্ট হাউসে সনদটি প্রদান করেন লর্ড লিটন।
সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়ে দিল্লির দরবারে চিত্রপ্রদর্শনী করেছিলেন শশিভূষণ। সেই প্রদর্শনী দেখে সম্রাট ও তাঁর স্ত্রী এই শিল্পীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রদর্শনীতে প্রিন্স অব ওয়েলস, ডিউক অব কন্ট, আল অব মিন্টো, তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ, লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার এডওয়ার্ড নর্মান বেকার প্রমুখ ইংরেজ সাহেব উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা শশিভূষণকে পদক, সোনার কলম, সম্মানসূচক অর্থ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। বলা দরকার, এই আঁকিয়েকে নিয়ে সে সময় শিল্পীকে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘ভারতবর্ষ’সহ বিলেতের পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয়।
১৯৪৬ সালের ১ জুলাই ৬৮ বছর বয়সে মারা যান শশিভূষণ পাল। তবে এখানে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্মটির কথাই বলা হয়নি। লেখার শেষ পর্যায়ে এবার সংক্ষেপে সেদিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক: ১৯০৪ সালে বাংলাদেশ ভূসীমানায় প্রথম শিল্প–শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন শশিভূষণ পাল। ‘মহেশ্বর পাশা স্কুল অব আর্ট নামে এই অঙ্কন বিদ্যাপীঠটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, সে সময় পূর্ববঙ্গে আর কোনো শিল্প–শিক্ষায়তন ছিল না। খুলনার মহেশ্বরপাশায় অবস্থিত এই শিক্ষায়তনে প্রায় ৪১ বছর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সময়ের পরিক্রমায় সেই বিদ্যায়তনটি ১৯৮৩ সালে প্রথমে শশিভূষণ আর্ট কলেজ, পরে খুলনা আর্ট কলেজে রূপান্তরিত হয়। এখন সেটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরে চারুকলা ইনস্টিটিউট তথা ‘চারুকলা স্কুল’ হিসেবে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এ প্রতিষ্ঠানে শশিভূষণ পালের আঁকা ৫৩টি চিত্রকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে।
শশিভূষণ পালের জন্মদিনে বাংলার এই বিস্মৃতপ্রায় শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]