শহীদ আলতাফ মাহমুদের আদ্যোপান্ত

শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদ। মানুষের মুক্তির নির্মাণে এক অনির্বাণ নাম তিনি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ শিরোনামের অনন্য গানটি তাঁর সুরে অমরতা লাভ করেছে। এসব তথ্য আমাদের সবারই জানা। কিন্তু আমরা কি জানি ব্যক্তিজীবনে কেমন ছিলেন তিনি? ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়, সে সময় কেমন ছিল এই সুরকারের শেষ সময়গুলো? এসব খুঁটিনাটির সারৎসার বর্ণনা পাওয়া যাবে মতিউর রহমান সম্পাদিত আলতাফ মাহমুদ: এক ঝড়ের পাখি বইটিতে।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উন্মেষ পর্বে আলতাফ মাহমুদ নিজেকে যুক্ত করেছিলেন নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিচিত্র পর্বগুলোয় তাঁর যে অবদান, তা উঠে এসেছে বিভিন্ন লেখায়। বইটি দুই পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে আপনজনের চোখে আর দ্বিতীয় পর্বে বন্ধু ও সহকর্মীদের কলমে চিত্রিত হয়েছেন এই বিপ্লবী সুরকার।

তাঁর বিপ্লবযাত্রার শুরু রক্ষণশীল পরিবারিক গণ্ডির ঘেরাটোপ পেরোনোর মাধ্যমে। বরিশালের ফকিরবাড়ি রোডের সেই দোতলা টিনের বাড়ির ছকবাঁধা চিন্তাধারার মূলে আঘাত করেছিলেন ঝিলু। এই ঝিলুই পরবর্তীকালে হয়ে উঠলেন আলতাফ মাহমুদ।

১৯৪৮ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তাঁর জীবনে যুক্ত হয় নতুন পালক। দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও বামপন্থী প্রগতিবাদী চিন্তাচেতনায় ঋদ্ধ হন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে আইএসসি, তারপর কিছুদিন কলকতা আর্ট স্কুলের আঙ্গিনা মাড়িয়ে ১৯৫০ সালে পাড়ি জমান ঢাকার পথে। কণ্ঠে সুর এবং বেহালা বাদনের সহজাত দক্ষতা আর গণমানুষের প্রতি অদ্ভুত ভালোবাসা—এই তিনকে সম্বল করে অল্প দিনেই ঢাকার চিত্ত জয় করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ।

বইটিতে আছে আলতাফ মাহমুদের ঢাকাযাপনের আদ্যোপান্ত—আনিসুজ্জামান, ওয়াহিদুল হক, নিজামুল হক, শেখ লুতফর রহমান, কামাল লোহানী, মাহমুদ আল জামান, আলতামাস আহমেদ,নূরুল হক বাচ্চু ও মতিউর রহমানের প্রবন্ধে ফুটে উঠেছে অজানা অনেক ঘটনা। যেমন সে সময় আলতাফ মাহমুদের নিত্যসঙ্গী ছিল নিদারুণ অর্থকষ্ট।

বায়ান্ন থেকে একাত্তর অবধি ঢাকার প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক মঞ্চ ও জনসমাবেশে আলতাফ মাহমুদ ছিলেন এক অনিবার্য চরিত্র। মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর ছিল বড় ভূমিকা। এ বছর যেমন মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী, একইভাবে আলতাফ মাহমুদেরও অন্তর্ধানের ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ সময় নতুন সংস্করণে এই বইয়ের প্রকাশনা গৌরবোজ্জ্বল অতীতের দিকে ফিরে তাকানোর এক মোক্ষম উপলক্ষ বটে। সম্পাদক মতিউর রহমান যথার্থই বলেছেন, ‘ষাটের দশকের ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, স্বৈরাচারবিরোধী গণ–অভ্যুত্থানে কাটিয়ে আসা আমাদের সোনালি স্বপ্নের দিনগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছেন আলতাফ মাহমুদ।’

কৈশোর থেকেই কিছুটা উন্মূল যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। তাই তাঁর সংসারজীবন নিয়ে পাঠকের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ জানাচ্ছেন, ‘...সংগীতের সপ্ত স্বরই ছিল তাঁর একমাত্র বিচরণক্ষেত্র।...সন্তানের প্রতি পিতার স্নেহ যে কত মধুময়, তা তাঁর মধ্যে দেখেছি। দেখেছি, শাওনকে নিয়ে তাঁর খেলার মুহূর্তগুলো, শত কাজের চাপেও তাঁর সে আনন্দ ব্যর্থ হতে দেননি।’

বইয়ের নতুন সংস্করণে রয়েছে ১৯৭১ সালে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে সহবন্দী আবুল বারক আলভীর নতুন একটি লেখা। এ লেখা থেকে তাঁর শেষ সময়ের অনেক কিছুই জানা যায়। তা ছাড়া আলতাফ মাহমুদের স্বজনদের মধ্যে শিমূল ইউসুফ ও দিনু বিল্লাহ আমাদের জানিয়েছেন তাঁকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের পৈশাচিক নির্যাতনে কথা। আলতাফ মাহমুদকে ফ্যানের সঙ্গে পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিত আর্মিরা। গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট ডলে ডলে নেভাত, হাঁটুর হাড় ভেঙে দিয়েছিল, কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। পিশাচের বক্ষের ওপর বসে, মা, মাটি ও মাতৃভূমিকে ভালোবেসে তিনি উন্নত শির মরণকে বরণ করে নিয়েছিলেন।

মহাকালের মঞ্চে আলতাফ মাহমুদের অনিঃশেষ যাত্রাকে জানতে ও বুঝতে বইটি অবশ্যপাঠ্য।

আলতাফ মাহমুদ: এক ঝড়ের পাখি

সম্পাদনা: মতিউর রহমান

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২১, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ১২৩ পৃষ্ঠা, দাম: ২৭০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাবে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানগুলোয়।