শিল্প ও শিল্পী যখন মানুষের পাশে

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

লকডাউনে মোবাইলের অ্যাপগুলো যেন বিশেষ বন্ধু হয়ে আজ সবার পাশে আবস্থান নিচ্ছে। ইউটিউবে নানা ভিডিও দেখতে দেখতে লন্ডনের পপব্যান্ড ব্লুর ‘গিল্টি’ গানটা দেখছিলাম ও শুনছিলাম। চার-চারটে গলা মিলে একটা গান, যেখানে ছন্দসমতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন লক্ষ করা যায়, সেখানে কোনো একক শিল্পীর আধিপত্য নেই। চারজন শিল্পী আলাদা আলাদা বাক্য গলায় ধারণ করলেও গানটিতে কোনো একটা জায়গায় বারবার মিলেমিশে একাকার হয়ে যান সবাই। গড়ে তুলতে সক্ষম হন একটি সার্থক শিল্প। সম্মিলিত প্রয়াসের শক্তি এভাবেই ভালো কাজ বের করে আনে। শিল্পকর্ম হোক একক বা দলীয় উদ্যোগে, সামঞ্জস্য থাকাটা জরুরি। সামঞ্জস্যতা থাকতে হয় একক বা দলীয় ভাবনার ও ভাবনার প্রকাশের মধ্যে। মাধ্যমটা যেকোনো কিছুই হতে পারে—কণ্ঠ, রং, তুলি, পাথর বা কাঠের খণ্ড। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চারুশিল্পীরা আজকের করোনাদিনের ভাবনা নিয়ে দলীয়ভাবে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন অনেকটাই সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তবে দল বেঁধে শিল্পভাবনার প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা বা উদ্যোগ পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। সময়কে দেখে, তার প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে কাজ করার জন্য শিল্পীদের জোট বাঁধতে হয়েছে যুগে যুগে।

১৮৪০ সালের ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে গোটা ইউরোপেই শিল্পীরা ভাববাদিতার জায়গায় থেকে বেরিয়ে অনেকটা বাস্তবানুগ ধারায় ভাবতে চেয়েছিলেন। সেখানে থেকে তাঁরা দলগতভাবেই শিল্পকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বব্যাপী। এই সময়ে বাংলাদেশে চারুশিল্পীরা যে শুধু ছবি আঁকছেন তা নয়; নানা উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষের পাশে থাকছেন। তাঁদের শৈল্পিক দক্ষতাকে মানবকল্যাণে কাজে লাগাচ্ছেন। আমরা দেখেছি, এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা রাজপথে বের না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলীসহ দেশের স্বনামধন্য শিল্পীরা অর্থ সংগ্রহ করে কীভাবে ডাক্তারদের জন্য ফেসশিল্ড আর পিপিই নিজ হাতে তৈরি করেছেন।

শুধু তা-ই নয়, তাঁরা সেগুলো তৈরি করে ছড়িয়ে পড়েছেন সমগ্র দেশে। তাঁদের তৈরি করা ফেসশিল্ড, পিপিই দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পৌঁছে গিয়ে দেশের করোনাকালে সম্মুখযোদ্ধাদের উপকারে এসেছে। বর্তমানে অতিমারির কালে বাংলাদেশের শিল্পীরা নানাভাবে নিজেদের কাজ করে চলেছেন। এই লেখায় বলা হয়েছে তেমনই দু-একটি প্রকল্পের কথা।

বৃহত্ত্ব: হোম আর্ট প্রজেক্ট ২০২০

আজকের এই বৈশ্বিক ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে যখন মানুষের এত ভোগান্তি, যখন খেয়ে–পরে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা মূল লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন শিল্প ও শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশন এক সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেখানে তারা বাছাইয়ের মাধ্যমে সম্ভাবনাময়ী সৃষ্টিশীল কিছু তরুণশিল্পীকে জায়গা করে দিচ্ছেন, শিল্পান্বেষণের সুযোগ করে দিচ্ছেন, তাদের কাজের সকল রকম আর্থিক জোগান দিয়ে চলছেন। যে প্রকল্পের মধ্যমে এই কাজ করা হচ্ছে সেটির নাম ‘হোম আর্ট প্রজেক্ট ২০২০’। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী বলেন, ‘শিল্পীরা বরাবরই সময়কে একটু ভিন্নভাবে দেখতে চায়, ভাবতে চায়।’ আর এই মহামারির সময়ে শিল্পীদের শিল্পনির্মাণের জায়গাটা চলমান রাখতেই এমন প্রয়াস বলে জানান বিশ্বজিৎ গোস্বামী। ‘হোম আর্ট প্রজেক্ট ২০২০’ নামেই বোঝা যাচ্ছে, শিল্পীরা তাঁদের যাঁর যাঁর বাড়িতে বসে কাজ করবেন। তাহলে এবারে সমন্বিত হওয়ার জায়গাটা কোথায়? প্রকল্পের কাজগুলোর বিষয়ভিত্তিক সমন্বয় হবে? নাকি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে শিল্পীরা একটি যাত্রার মধ্য দিয়ে যাবেন?

এ প্রসঙ্গে বৃহত্ত্বের একজন সদস্য ও প্রকল্পের মূল সমন্বয়ক নিঝুম জান্নাতুম নাহার জানান, অভিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলীর বিচারক্রমে ইতিমধ্যে ১৫ জন শিল্পী বাছাইয়ের পর্বটি সম্পন্ন হয়েছে। তাঁদের শিল্পকর্ম তৈরির সব রকম আর্থিক সুবিধা বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রদান করা হচ্ছে। তাঁরা বাড়িতে বসেই নিজ নিজ চিন্তার জায়গা থেকে আলাদাভাবে কাজ করছেন। জানা যায়, অনলাইনে মনিটরিংয়ের মধ্য দিয়ে শিল্পীদের কাজ তদারকি করছেন তিনজন মেন্টর। জুম কলের মাধ্যমে সব ধরনের বিচারকার্য ও কর্মশালার কাজগুলো চলছে। হোম আর্ট প্রজেক্টের বিচারকার্য সম্পাদনের গুরুদায়িত্বটি পালন করেছেন দেশবরেণ্য তিন শিল্পী—অলক রায়, নিসার হোসেন ও তৈয়বা বেগম লিপি। ১৫ জন শিল্পীর মেন্টর হিসেবে থাকছেন বাংলাদেশের আরও তিন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী—ঢালী আল মামুন, মাহবুবুর রহমান ও বিশ্বজিৎ গোস্বামী।

জিরো ওয়েস্ট ফুডআর্ট

সমসাময়িক পৃথিবীতে ভাইরাসের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট আরও নানা সংকট ভাইরাসের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা তো আছেই, পাশাপাশি মানুষ মানুষের পাশে সাধ্যমতো কতটা দাঁড়াতে পারছে, সে ব্যাপারটিও ঘোলাটে। এ সময় শিল্পবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘বৃত্ত’ তাদের উদ্যোগে যে কাজটি করছে, তা হলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দ্বারে খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজটি তারা করছে এবং এ ক্ষেত্রে এই খাবারগুলো সব উৎপাদন করা হচ্ছে। ফল, সবজি, চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য চাষের পর তা এলাকাভিত্তিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে। শিল্পীরা তাঁদের নিজেদের ও পরিচিত পরিজনের জমি ব্যবহার করছেন।

এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফলস্বরূপ শিল্পীরা অকার্যকর কিছু ফলনকে তাঁদের শিল্পমাধ্যমরূপে ব্যবহার করে শিল্পসামগ্রী নির্মাণ করছেন বা এমন কিছু নির্মাণ করতে চলেছেন, যা সাইট-স্পেসিফিক কোনো শিল্পমাধ্যমে রূপ নেয়। তাতে করে যে ফলনটি ফেলে দিতে হতো, তার অপব্যয় হচ্ছে না। অর্থাৎ খাবারের অপচয়কে নিরুৎসাহিত করার জন্যই এই পরিকল্পনা করা হয়। বৃত্ত আর্টস ট্রাস্টের একজন কর্ণধার শিল্পী তৈয়বা বেগম লিপি জানালেন, মূলত একটি কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে শিল্পীরা একত্র হয়ে কাজ করছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে—কেউ চট্টগ্রামে, কেউ নারায়ণগঞ্জে আবার কেউ গাইবান্ধাসহ নানা জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কাজ করছেন।’ তিনি আরও জানান, চাষ করা ফল–সবজি আশপাশের পরিবারের সঙ্গেও ভাগ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির সঙ্গে চট্টগ্রামের ‘Santaran Art Organization’ ও ঠাকুরগাঁওয়ের ‘Gidree Bawlee’ প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের নিজেদের এলাকা থেকে একাত্ম হয়েছে।

আজ যখন খাদ্যের এত সংকট, তখন এমন একটি উদ্যোগ সত্যিই সময়োপযোগী। শিল্পীরাও খাবারের মতো অভিনব মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে একদিকে যেমন শিল্পনির্মাণের কাজটি করছেন, অন্যদিকে নিজেদের মানবিক কাজে নিয়োজিত করছেন।


যুগে যুগে, দেশে দেশে, পৃথিবীর সব সংকটকালে এভাবেই শিল্পীরা সাংগঠনিকভাবে একত্র হয়েছেন, তাঁদের স্বভাবসুলভ তীব্র স্পর্শকাতরতাকে কাজে লাগিয়ে পথে নেমেছেন, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিক হতে পেরেছেন, পাশাপাশি নির্মাণের উল্লাসে মেতে অসামান্য শিল্প সৃষ্টি করেছেন।


অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]