শুধু দুঃস্বপ্নই আমাদের বাঁচাতে পারে

সব্যসাচী মিস্ত্রী

আবদুল জব্বার সাহেব একটা গল্প লেখেন। ফেসবুকে গল্প লেখার খেলা চলছে, এক শ শব্দের গল্প। হাজি চান মিয়া স্কুলের গণিতের শিক্ষক আবদুল জব্বার। তাঁরও একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। ৫২ বছরের আবদুল জব্বার অর্শরোগে ভোগেন, জর্দা দিয়ে পান খান, প্রচুর টিউশনি করেন, নয়াবাগ স্টেশন রোডে তিনি পাঁচ কাঠা জমির ওপরে দেড়তলা বাড়ির মালিক এবং বাসিন্দা, তাঁর ২৩, ২১ ও ১৮ বছরের তিনটা কন্যাসন্তান আছে। তাঁরা যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও হরগঙ্গা কলেজে পড়েন। তাঁর স্ত্রী গুলশান আরার বয়স ৪৮, তাঁকে ৬২ বছরের বলে মনে হয়। আবদুল জব্বারের ফেসবুক করার দরকার ছিল না। তিনি তাঁর দোতলার অর্ধেক খোলা ছাদে কাকেদের বিষ্ঠার সারি দেখে দেখেই সকাল দুপুর রাত্রিবেলা পার করে দিতে পারতেন। কারণ ঘটনা করোনাকালের। টিউশনি বন্ধ। স্কুল বন্ধ। আয় কমে জমা টাকায় টান পড়ছে।


ঘটনা এই সব না। আবদুল জব্বার ফেসবুকে গল্প লেখেন। এক শ শব্দের গল্পটা এই:
‘রোজ শনিবার বেলা তিনটার সময় আমার বৈকালিক ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। আমি একটা স্বপ্ন দেখি। একটা হলদু রঙের ষাঁড় আমাদের দোতলার ছাদে উঠে শুকাতে দেওয়া শাড়ি ও লুঙ্গি খাচ্ছে। তখন আমার মনে হয় এটা স্বপ্ন। আমার ঘুম থেকে জাগা উচিত। আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি, ছাদে যাই। কিন্তু ছাদে কোনো গরু দেখি না। তখন আমি নিশ্চিত ঘুমাতে থাকি। পরের শনিবার পর্যন্ত ঘুমাই। এবং বেলা তিনটায় ষাঁড় দেখি। সে সময় আমি ঘুমের মধ্যে ফেসবুকে এক শ শব্দে গল্প লিখি। এই হলো সেই গল্প। আপনারা আমার ঘুমের মধ্যে এই গল্প পড়ছেন। আমি বাস্তব, কিন্তু আপনারা স্বপ্ন।’

গল্পটা তিনি পোস্ট করেন। হ্যাশট্যাগ শতশব্দ যোগ করেন। আয়োজক সংস্থা ‘একুশ শতক’ নামের অনলাইন সাহিত্য সাময়িকী তাঁর গল্পটিকে সেরা বলে মনোনীত করে। তাঁকে পাঁচ হাজার টাকার বই রকমারির মাধ্যমে পাঠানো হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
এরপরই অভিযোগ ওঠে যে গল্পটা নকল। একজন ব্যক্তি ফেসবুকে দাবি করে বসেন যে এই গল্পটা রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের হুবহু কপি। এটাকে কপি বলে না, বলে চুরি।


আবদুল জব্বারের কাছে ‘একুশ শতক’–এর সম্পাদক ইনবক্স মেসেজ লেখেন। ‘ভাই, এই অভিযোগ কি সত্যি? আপনি কি সত্যই রবীন্দ্রনাথের “ছুটি” গল্প থেকে চুরি করেছেন।’


আবদুল জব্বার বলেন, ‘আমি ছোটবেলায় “ছুটি” গল্প পড়েছিলাম। আমার ঠিক মনে নাই। আমি আবার পড়ে দেখি। তারপর বলতে পারব কোনো মিল আছে কি না!’


তিনি এই কথাটাই স্ট্যাটাস হিসেবে লিখে প্রকাশ করেন, ‘আমি ছোটবেলায় “ছুটি” গল্প পড়েছিলাম। আমার ঠিক মনে নাই। আমি আবার পড়ে দেখি। তারপর বলতে পারব কোনো মিল আছে কি না!’


তখন একযোগে কমেন্টস আসতে থাকে, তার মানে আপনি চুরি করেছেন। আপনি ছোটবেলায় “ছুটি” পড়েছেন, সেটা আপনার মনে নাই, মানে অবচেতনে সেটা আপনার ওপরে ভর করেছে। অতএব আপনি চোর।


এরপর তার নামে ফেসবুকে ছড়াতে থাকে যে আবদুল জব্বার চোর।
তাঁর তিন মেয়ে তাঁকে ঘিরে ধরে আর বলেন, ‘আব্বা, আপনি কি চুরি করছেন?’
‘কিছু না।’
‘ক্যামনে কিছু না। কিছু না হলে লোকে আপনাকে চোর বলে ক্যান?’
‘মা রে, আমি চুরি করি নাই।’
‘তাইলে কী করছেন?’
‘গল্প লিখছি।’

‘এই তো বারায়া গেল’—কন্যা তিনজনের জননী মুখ থেকে পানের পিক ফেলে এত জোরে যে ভাদ্রের রোদে রেলিংয়ে বসা ত্রিশটা কাক একযোগে উড়ে যায়। ‘তার মানে একটা কিছু চুরি আপনে করছেন’, কন্যাদের মাতা বলেন।
‘গল্প লেখা মানে কি চুরি করা?’
‘আপনে যেইটা লেখছেন সেটা যে গল্প আপনে জানলেন কেমন কইরা?’

‘ছোটবেলা থেকে কত গল্প পড়ছি না। সেখান থাইকা।’
‘এই জন্যই তো লোকে আপনেরে চোর কয়। আপনে অন্যের মতোন কইরা লেইখা সেইটা নিজের নামে চালাইছেন।’ বিবি হাঁচি দিতে দিতে বলেন। তিনি কনুই দিয়া মুখ ঢাকেন, করোনাকালের ভদ্রতা তাঁকে সেই ট্রেনিং ভালোই দিয়েছে।
আবদুল জব্বারের মোবাইল ফোনে রিং হয়। কলার ‘প্রিন্সিপাল সাহেব’।


‘হ্যালো স্যার, আসসালামু আলাইকুম।’
‘জব্বার সাহেব, এই সব কী শুনি?’
‘জি?’
‘আপনি নাকি কী সব করে বেড়ান?’
‘কী সব?’
‘ফেসবুকে নাকি কী সব ভিডিও বার হইছে?’
‘মানে কী?’
‘এসএমসির প্রেসিডেন্ট এমপি সাহেবের পিএস ফোন করে বলছে, আপনাকে সাসপেন্ড করতে।’
‘ক্যানো? কী অভিযোগ?’
‘আপনার নামে আইসিটি আইনে মামলা করা হবে। রাখি।’


আইসিটি আইনে মামলা হয়। পুলিশ আসে বাড়িতে। তিন কন্যা পুলিশের গাড়ি দেখে সামনের ড্রামকাটা গেট বন্ধ করেন। বলেন, ‘আব্বা, আপনে পেছনের দরজা দিয়া পালান।’
গেটের ওপরে কাকের সারি। তারা সার বেঁধে মলত্যাগ করে ড্রামকাটা গেটের রং সাদা বানিয়ে রেখেছে। তাতে পুলিশ ধাক্কা দেয়।
আবদুল জব্বার পালানোর চেষ্টা করেন। কিছুতেই পেছনের দরজা দিয়া তিনি বের হতে পারেন না। তাঁর লেজ দরজার চিপায় আটকে যায়।


তখন তাঁর মেয়েরা বলেন, ‘আব্বা, আপনি গোঙান ক্যান? আব্বা, আপনি ঘুম থাইকা জাগেন।’
আবদুল জব্বার বলেন, ‘আমি তো জাগতে পারতেছি না। আমার লেজ চিপায় আটকে গেছে।’
মেয়েরা বলেন, ‘আব্বা, আপনি স্বপ্ন দেখতেছেন।’
বড়জন বলেন, ‘নাইটমেয়ার।’
মেজজন বলেন, ‘এখন তো বিকেল।’
ছোটজন বলেন, ‘এইটারে কয় দুঃস্বপ্ন।’
কিন্তু পুলিশ পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলার পরও আবদুল জব্বার পেছনের দরজা দিয়া পালানোর কাজটা সারতে পারেন না। তাঁর একবার মনে হয় তিনি স্বপ্ন দেখছেন। ঘুম ভেঙে গেলে সুবিধা। কিন্তু তিনি তো ষাঁড় নিয়ে স্বপ্ন দেখবেন। এটা কি তাহলে স্বপ্ন নয়? এটা কি তাহলে বাস্তব? তাহলে একমাত্র উপায় হলো ঘুমিয়ে পড়া। বাস্তব থেকে পালানো। আবদুল জব্বার পেছনের গোপন সিঁড়ির মধ্যে শুয়ে পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেন।


ভেড়া গোনার কাজ করতে থাকলে ভেড়াওয়ালা আসে। বলে, ‘আমগো ভেড়া আপনে গুনেন ক্যান?’ তখন আবদুল জব্বার বোঝেন যে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। কারণ এই ধরনের কথা ভেড়াওয়ালার বলার কথা না। এইটা যেহেতু বাস্তবে সম্ভব না কাজেই তিনি স্বপ্ন দেখছেন।
আবদুল জব্বার ভালো বাঁচা বেঁচে যান।


অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]