শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের বিস্তৃত বয়ান

অপারেশন ভারতীয় হাইকমিশন: মহিউদ্দিন আহমদ

কোনো কোনো সত্য ঘটনা বা অভিযান অনেক সময় টান টান উত্তেজনার শ্বাসরুদ্ধকর রোমাঞ্চকে হার মানায়। এমনই এক নাটকীয় ঐতিহাসিক ঘটনা পাঠকের সামনে তুলে এনেছেন লেখক মহিউদ্দিন আহমদ। এবার পাঠকের সামনে তিনি হাজির হয়েছেন অপারেশন ভারতীয় হাইকমিশন নিয়ে, যা এর মধ্যেই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।

১৩৬ পৃষ্ঠার বইটি পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়েই পাঠক পাবেন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, যা শুরু হয়েছে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) যাত্রার সূচনা থেকে। এতে উঠে এসেছে ১৯৭৩-এর ৭ মার্চে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় নির্বাচন ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ। এ ছাড়া ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের ঘটনা পাঠককে ভাবনার খোরাক জোগাতে পারে। সম্ভবত এই দিনের ঘটনার মাধ্যমেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংঘাত ও রক্তপাতের একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। ওই দিন একটি মিছিল নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসা ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটে। এরপর এসেছে ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাপ্রবাহ আর তাতে জাসদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিবরণ। ‘ডেটলাইন ২৬ নভেম্বর’ শিরোনামের প্রথম অধ্যায়টি শেষ হয়েছে ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে, যে দিনটি সম্পর্কে লেখক লিখেছেন, ‘কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে টগবগে তরুণদের মধ্যে থাকে বিপ্লবের উন্মাদনা। তাঁদের একটি দল নামলেন এমন একটি বিপজ্জনক অভিযানে। লক্ষ্য হলো ঢাকার ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কে ভারতীয় হাইকমিশনে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করা। এর পরিণতি হয় বিয়োগান্ত।’

অপারেশন ভারতীয় হাইকমিশন মহিউদ্দিন আহমদ প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: মার্চ ২০২১, ১৩৬ পৃষ্ঠা, দাম: ৩০০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানগুলোতে।

ছোট এই বইয়ের একটি বড় চরিত্র তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে জাতিসংঘে যখন কূটনৈতিক যুদ্ধ চলছে, তখন ভারতের হয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। সমর সেন বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে। ঢাকার পরিস্থিতি সে সময় টালমাটাল।

সমর সেনের পর পাঠকের সামনে হাজির হবেন সৈয়দ বাহারুল হাসান সবুজ, যিনি জাসদের বিপ্লবী গণবাহিনীর কমান্ডার। লেখকের এক প্রশ্নের জবাবে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। একটি হলো জাসদের অবরোধ কর্মসূচিতে গুলি, অন্যটি সমর সেনকে জিম্মি করার প্রচেষ্টা।

২৬ নভেম্বর সকালে পরিচালিত হয় সেই রুদ্ধশ্বাস, নজিরবিহীন অভিযান। বাহারুল সবুজের বর্ণনা অনুযায়ী, অভিযানের সময় তিনজন (বেলাল-মাসুদ-সবুজ) আগেই হাইকমিশনের ভেতরে সমর সেনের সেক্রেটারি মুখী সাহেবের কক্ষে অস্থান নেন। আর বাকি তিনজন (বাহার-বাচ্চু-হারুন) নিচে। হাইকমিশন চত্বরে প্রবেশ করার পরপরই সমর সেনের সঙ্গে থাকা পুলিশদের নিরস্ত্র করে ফেলেন ওই তিনজন। এরপর ওপর থেকে অন্য তিনজনও আসেন নেমে। সমর সেনকে নিয়ে ওপরের কক্ষে যাওয়ার জন্য রওনা হন তাঁরা। এ সময় একটা সিঙ্গেল শট ফায়ার হয়। সবুজের বর্ণনামতে, এই গুলিটি হয়েছিল পেছন থেকে। এরপর ঘটে নাটকীয় ঘটনাটি। বাহারুল সবুজের বর্ণনায়, ‘আমি হাইকমিশনারের একদিকে, বেলাল অন্যদিকে। পেছনে বাহার।[...] হাইকমিশনার বলছেন, স্টপ ফায়ার। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। হঠাৎ দেখি দশ-বারোজনের একটা দল গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। আমরা ধীরে ধীরে বসে পড়লাম। হাইকমিশনারের গায়েও গুলি লেগেছে।’ (পৃষ্ঠা: ৫১)।

এর কিছু সময় পরই শেষ হয় এই ব্যর্থ অভিযান।

সৈয়দ বাহারুল হাসান সবুজের পর বইটিতে আসে কামাল উদ্দিন আহমেদ ও আয়েশা পারুলের গল্প। তাঁরা সরাসরি ওই অভিযানে যুক্ত না থাকলেও ছিলেন পার্শ্বচরিত্র। যে চরিত্রের বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা করেছেন লেখক। বইটি এক রুদ্ধশ্বাস অজানাকে চোখের সামনে তুলে ধরবে।