সম্পূর্ণ রঙিন সিনেমা

বাউল কিংবা পথিক সে নয়। বাউল কিংবা পথিক হলে তার অন্ধত্ব একটা রোমান্টিকতা পেত। কিন্তু এই মানুষটি সে রকম অন্ধ যে বেঁচে থাকতে থাকতে হঠাৎ বেসুরো সুর তোলে, কিংবা জীবনের অলিগলি পথ হাঁটে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। সে বাউল নয়, পথিকও না। সে ক্ষীণ গলিতে বাস করা এক অন্ধ মানুষ।


দিনের আলো ফোটার পর জেগে ওঠে ক্ষীণ গলি, মানুষ, সময়। সবাই জাগে চোখ মেলে। অন্ধ মানুষটি জেগে ওঠে অন্ধ হয়েই। আর রাত গভীর হওয়ার পর একটা একটা জানালা থেকে ঠিকরে আসা কৃত্রিম আলোগুলো যখন ছুটি নেয়, ক্ষীণ গলি তখন অন্ধ হয়েই যায় বৈকি। এই মানুষটির মতন, যার নাম মকবুল।

ক্ষীণ গলির বাসিন্দা সে; যেখানে কালিন্দা গ্রামের শেষের অংশ সৈয়দপুর শহরের দিকে মিশেছে। মানুষ বাড়ছে, গ্রাম গেরুয়া রং ছেড়ে হাওয়াই মিঠাই রং ধরেছে, আর সবুজ–হলুদ জমির ছায়া কেটে কেটে গলি বাড়ছে। মানুষও। কালিন্দার বাজারের পাশেই রয়েছে সেই ক্ষীণ এক গলি। গলির মুখে পান-বিড়ির দোকান। আর একটা কাঠের আসবাবপত্রের দোকান। বড় বড় আলমারির আড়ালে গলির মুখটা প্রায় দেখাই যায় না। খানিকটা পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে ঢুকতে হয় গলিতে। আর এখানের বাসিন্দাদের যেহেতু গাড়িঘোড়া নেই, তাই তাদের হেঁটে এই সামান্য গলি পার হতে তেমন সমস্যা হয় না।


অন্ধ লোকটি, যার নাম মকবুল, কালিন্দাজুড়েই ঘোরে। সূর্যের আলোর বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তার চলার গতিও বাড়ে, গ্রামজুড়ে। যারা চোখে দেখতে পায়, তারা ভাবে, আহা মকবুল তো জানে না, সূর্যের আলো ধুলায় মিশে কেমন গোধূলি হয়ে যায়, সে কি আসলে সূর্যের রংই চেনে? কিংবা ধুলো? গোধূলির মেঘ কিংবা দূরের সমুদ্র?


মকবুল হয়তো এমন করে ভাবে না। প্রতিদিনের যাপিত জীবনে তার মূল ভাবনা পথের হিসাব নিয়ে। কয় কদম হাঁটলে বাজার ছাড়িয়ে গ্রামের রাস্তায় ঢুকে পড়া যাবে, ডান ছাড়িয়ে বাঁয়ে গেলে ভ্যান আর রিকশার মোড়—এই হিসাব মিলিয়ে চলতে হয় তাকে, তার এই পঁচিশ বছর বয়সের জীবনে। প্রতিদিন দেখতে পাওয়া অন্য মানুষের চেয়ে তাই তার কয়েক কদম বেশি হাঁটতে হয়, আস্তে পথ পাড়ি দিতে হয়, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এবং তার আছে এক চমৎকার কণ্ঠস্বর। জমাট বাধা, ভরাট, গমগমে।


মকবুল পথে থাকে দিনজুড়ে। জমজমাটি কণ্ঠস্বরের অধিকারী, কিন্তু সে বাউল বা পথিক নয়। পেশায় সে একজন ক্যানভাসার। গমগমে গলায় মাইক হাতে, ভাড়া রিকশায় কিংবা ভ্যানে এলাকার বিভিন্ন কোম্পানির ক্যানভাসিং করে মকবুল। সৈয়দপুর থেকেও লোক আসে তার কাছে ক্যানভাসিংয়ের বায়না নিয়ে।

মাইকিংয়ের বিষয়ের ধরন আর গভীরতা অনুযায়ী মকবুলের অভিব্যক্তি ও কণ্ঠস্বরের ওঠানামা বাড়ে বা কমে। তাই এ অঞ্চলের আর সব ক্যানভাসার থেকে সে আলাদা। সে যখন বলে, ‘জসীমকে ছোবল দিল সর্পরাজ কালনাগ। কী হবে এখন শাবানার? তার কান্না জড়ানো দিন, আর বিরহের রাত শেষে ফিরে কি পাবে হারানো স্বামী জসীমকে? জানতে হলে দেখুন “সর্পরাজের ছোবল”। সম্পূর্ণ রঙিন সামাজিক ছবি। চলছে সৈয়দপুর শহরের যমুনা হলে। দেখুন দলে দলে, পরিবারে।’


মকবুলের কণ্ঠের প্রেমময় টলটলে কারুকাজ, যেন ডানা ঝাপটানো রাজহাঁসের জলখেলা। থিরথির আবেগে কেঁপে ওঠে কালিন্দার লোকজন, পথ হেঁটে যাওয়া পথিক বালিকা-বধূরা। জসীম কি ফিরে আসবে শাবানার কাছে? তা নিয়ে চলত জোর আলোচনা–তর্ক। আর ছবি হলে উঠলে দলে দলে লোক যেত তা দেখতে। যেত না শুধু মকবুল।


তবে যখন হারানো বিজ্ঞপ্তি কণ্ঠে নিয়ে রিকশা কিংবা ভ্যানে ঘুরে বেড়াতো মকবুল, ‘একটি পাঁচ বছরের ছেলে হারানো গিয়েছে। তার পরনে ছিল সাদা গেঞ্জি আর কালো প্যান্ট...’, মকবুলের কণ্ঠের আর্দ্রতা ছুঁয়ে যেত শ্রোতাদের ঘর্মাক্ত কপালের ভাঁজ, চোখের অস্থির পাপড়ি—আহা, অত ছোট ছেলে হারিয়ে গেল, ফিরে পাক বাপ-মা তারে ফিরে পাক। আর হিদায়াতি চুলকানির মলমের ক্যানভাসিংয়ের সময়, এ যেন অন্য এক মকবুল। কী আত্মপ্রত্যয়ী তরতাজা কণ্ঠ, যাতে কালিন্দার আশপাশের মানুষ বিশ্বাস করত, চুলকানির মলমে জাদু আছে। যার প্রয়োজন নেই, সেও টুক করে কিনে পকেটে পুরে নিত হিদায়াতি চুলকানির একখানা মলম। কে জানে কবে কাজে লাগে? এমন করেই মাটির পথে ভ্যানের ক্যাঁচক্যাঁচ বাদনে, কালিন্দাজুড়ে ভেসে বেড়াত মকবুলের দুপুরের গান।
ঠিক যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। মকবুলকে এই নামে ডাকে কালিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজগর আলী। তাকে দেখলেই বলে, ‘তোর পিছে পিছে গ্রামের সব পোলাপান ইন্দুরের মতন ঘুরে বেড়ায়। তোর হাতের বাঁশি কই রে...’


মকবুল হাসে। বাঁশি তার জীবনের অনুষঙ্গ নয় বটে। তবু সে যখন পথ চলে, ভ্যানে কিংবা হেঁটে, তার পিছু হাঁটে পাড়ার কৌতূহলী মানুষেরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা বাচ্চা পোলাপান। তারপরও বৃদ্ধ নিপাবালা, রওশন চাচা, জহির—এরাও যে সেই দলে মাঝেমধ্যে যোগ দেয়, মকবুল তা জানে।

ক্যানভাসিংয়ের কাজ শেষ হয়ে যায় বিকেলের শুরুতেই। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত যে সময়টুকু, এই সেই কাজে ঘরের বাইরে থাকে মকবুল, ওর পেছনে কৌতূহলী পোলাপানের দঙ্গল তখনো ঠিক ঘুরতে থাকে। প্রধান শিক্ষক আজগর আলীর ভাষায় ‘ইন্দুরের মতন’।
এর আরও একটা কারণ আছে অবশ্য। মকবুলের সময়ের হিসাব নিখুঁত বলে দেওয়ার এক তাজ্জব গুণ আছে। একে তো সে অন্ধ মানুষ, তার ওপর কোনো হাতঘড়ির মালিক সে নয়। কেমন করে সময় বলতে পারে ঠিকঠাক, কে জানে? ক্যানভাসিংয়ের সময় পিছে ঘোরা দঙ্গল খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। কারণ মকবুল তখন অনর্গল মাইকে কথা বলতে থাকে। কিন্তু মাইকিং শেষ হওয়ার পর যে ঘটনা ঘটে, তা যেন ঠিক একরকম জাদু, অন্য দুনিয়ার কারবার। রাজা-রানি হাতি-ঘোড়ার গল্পের মতন। মাইকিং শেষ করে মকবুল যখন বাজারে গিয়ে ভ্যানের দোকানের সামনে থামে, পেছনের দল প্রশ্ন করে তখন।


‘ও মকবুল, বলত কয়টা বাজে?’ মকবুল বলে, ‘৩টা বেজে ৪৩ মিনিট।’ কখনো ‘৫টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি’। দিন হোক বা রাত, মকবুল একদম ঠিক ঠিক বলে দেয় সময়ের হিসাব। মানুষ ঘড়ি দেখে মিলিয়ে নেয়। মকবুল সময় বলে যায়, মানুষ সময় মিলিয়ে নেয়। ঠিক ঠিক। বিরক্ত সে খুব কম হয়। তবে মাঝেমধ্যে উত্তর দিতে যখন ভালো লাগে না, চুপ করে থাকে। পেছনের দল দু-একবার, প্রশ্ন করে থেমে যায়। বোঝে আজ কোনো আশা নেই। কিন্তু বেশির ভাগ দিনে, মকবুল কাউকে নিরাশ করে না। সময়-অসময়, হাটে, মাঠে, মেলায় ঠিক ঠিক বলে দেয় সময়ের হিসাব।


এমন করেই কাটে মকবুলের দিন। কালিন্দা আর তার চারপাশজুড়ে। এর বাইরে কেমন করে দিন কাটানো যায়, তা সে জানে না। এই যে কালিন্দাজুড়ে জীবন, হোক তা একঘেয়ে সুর, চেনা তো। সে জানে সে ভিন্ন। সে কৌতূহলের। তার জন্য এ অঞ্চলের ছোটদের ভালোবাসায় মিশে থাকে বিস্ময়। আর বেড়ে ওঠা মানুষদের ভালোবাসায় বিস্ময়ের সঙ্গে খানিকটা করুণাও মিশে থাকে—সে যে দেখতে পায় না। আর মিশে থাকে এক ছটাক ঈর্ষাও, সে কিনা দেখতে না পেয়েও সময়কে পড়ার ক্ষমতা রাখে! মানুষের কণ্ঠের তীক্ষ্ণ খোঁচায় সে তা বুঝতে পারে। কিন্তু মকবুল এ-ও জানে, তাকে ঘৃণা করে না কেউই। ঘৃণা পাওয়ার মতো অত গুরুত্বপূর্ণ মানুষও আবার সে নয়। এই ভেবে এক পরিতৃপ্তির হাসি তার মুখে ভাসে। না দেখতে পেয়েও যে সে প্রতিদিন বেঁচে থাকে, সেই সুখে। দিন শেষে। সন্ধ্যা নামলে চোখওয়ালা মানুষগুলোর জটলা কমে যায়। সবাই ঘরে ফেরে। মকবুলও ফেরে, অন্ধকার দিন থেকে অন্ধকার রাতে। বাহির থেকে ঘরে।


দুটো ঘর মিলে মকবুলের সংসার। মকবুলদের সংসার বলা ভালো। একটি ঘরে মকবুল ফেরে। আর আরেকটি ঘর তার বড় বোন ও তার স্বামীর। নিঃসন্তান দম্পতি আর মকবুল। এই নিয়েই সংসার। তাতে আপাতদৃষ্টিতে কোনো বিভেদ নেই, আলাদা কোনো উচ্ছ্বাসও নেই। বোনের স্বামীর মুদির দোকান আছে বাজারে। আয়রোজগার ভালোই হয়। মকবুল তার আয়ের অর্ধেকের বেশি তুলে দেয় বোনের হাতে। ছোটবেলায় অনাথ হওয়া ভাই-বোন, একসঙ্গেই বাস করে যাচ্ছে। বোনের বিয়ের পরও অন্যথা হয়নি। অন্ধ ভাইকে আলাদা করেনি বোন। আর মকবুলও জানে, এই পৃথিবীতে একজন মানুষের কাছেই তার ফিরে আসার ঘর। সব মিলিয়ে তাদের সংসার নির্ঝঞ্ঝাটে চলে যায়।

মাইকিংয়ের বিষয়ের ধরন আর গভীরতা অনুযায়ী মকবুলের অভিব্যক্তি ও কণ্ঠস্বরের ওঠানামা বাড়ে বা কমে। তাই এ অঞ্চলের আর সব ক্যানভাসার থেকে সে আলাদা। সে যখন বলে, ‘জসীমকে ছোবল দিল সর্পরাজ কালনাগ। কী হবে এখন শাবানার? তার কান্না জড়ানো দিন, আর বিরহের রাত শেষে ফিরে কি পাবে হারানো স্বামী জসীমকে? জানতে হলে দেখুন “সর্পরাজের ছোবল”। সম্পূর্ণ রঙিন সামাজিক ছবি। চলছে সৈয়দপুর শহরের যমুনা হলে। দেখুন দলে দলে, পরিবারে।’

ভাই–বোনের সারা দিনে সাক্ষাৎ হয় সেই সন্ধ্যায়। মকবুল যখন ঘরে ফেরে, বোন ভাইকে চোখে দেখতে পায়। আর ভাই তার মতো করে বুঝে নেয় যে বোন আছে। কথা হয় কম। কথা বলার মতো নতুন ঘটনাও কম। বোন শুধু মাঝেমধ্যে বলে, ‘ভাই, তুই ক্যামন করে সময় পড়তে পারস? তুই তো দেখস না।’


মকবুল বলে, ‘খোদার হিসাব পরিষ্কার বুবু, সবাইকে কিছু না কিছু দেখার ক্ষমতা দিছে। তোমরা দেখো দুনিয়া, আমি দেখি সময়।’
এরপর আর কথা বাড়ে না। মাঝেমধ্যে রাতের ভাঁজ গভীর হতে থাকলে, পাতলা ঘুমের ফাঁকে বোন মকবুলের টুকরো ভেসে আসা কান্নার আওয়াজ শোনে। টানা সুরের কান্না নয়, গুমরে গুমরে কাঁদে মকবুল। টুকরো টুকরো সুরে। বোন ভাবে, মরে যাওয়া বাপ-মায়ের জন্য কাঁদে মকবুল।


মকবুল আসলে কাঁদে শাহেলার জন্য। ঘুম না হওয়া রাতে ওর শাহেলার কথা মনে হয়। কালিন্দার শাহেলা। যার হাসির ঝিরঝির আওয়াজ যেন বাঁশির সুর। মকবুল তাকে চিনে নিত। শাহেলার কাছে মকবুল গ্রামের আর সবার মতন—অন্ধ মকবুল, ক্যানভাসার মকবুল, সেই মকবুল যে ঘড়ি না দেখে সময় বলে দিতে পারে। শাহেলার এখন কোন গ্রামে বাড়ি কে জানে? কোন সংসারে বাস? শাহেলা যখন দুপুর রোদে, ডালে ফোড়ন দিতে দিতে ফেলে আসা কালিন্দার কথা ভাবে, তখন নিশ্চয়ই তার মকবুলের কথা মনে পড়ে না। মকবুল ভোলে না শাহেলার কথা। রাতের গভীর ভাঁজের নিস্তব্ধতার অন্ধত্ব ভেঙে দিয়ে মকবুল ডুকরে ডুকরে কাঁদে। মাঝেমধ্যে।
মকবুলের প্রতিদিন যেন সন্দেশের নিখুঁত ছাঁচ। প্রতিটি দিন প্রায় একই রকম। কালিন্দা গ্রামের প্রতিটি দিনের মতো। ঝড়–বৃষ্টি, রোদ-খরার দিনগুলোও কেমন জানা, মাপা। জন্ম-মৃত্যুর দিনগুলোর ধরনও চেনা। তাই বৈচিত্র্য খুব সচরাচর দেখা দেয় না এখানে। যদিনা মেলা বসে বছরে একবার। আর মাঝেমধ্যে বিদেশিদের ভিড় জমে, নানা রকম মাপজোক আর গবেষণার কাজ করতে আসে তারা। দু-এক দিন থাকে। গ্রামজুড়ে তখন যেন উৎসব, আলোচনা। অন্য পৃথিবীর ভিন্ন ভাষায় কথা বলা সাদা-হলুদ-কালো মানুষ দেখার ভিড় জমে। এমনকি পোলাপানরা তাদের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে ছেড়ে সাদা মানুষদের পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়। এমন বিদেশিরা এলে কিংবা মেলা বসলে মকবুল পোলাপানের দঙ্গল থেকে একটু ছুটি পায়।


এই শীতে এসেছে একদল বিদেশি ডাক্তার। এসেছে মূলত সৈয়দপুর শহরে। শহরে আর আশপাশের গ্রামে ঘুরে ঘুরে দাতব্য চিকিৎসা দিচ্ছে এই বড়দিনের ছুটিতে। বরফঢাকা শীত ছেড়ে এই দেশের রোদ মাখানো ধুলা ও কুয়াশার শীত দিব্যি উপভোগ করছে। আর গায়ে কোনো ওম কাপড় না জড়িয়ে কেমন করে একদল সাদা রঙের লোক ঘুরে বেড়ায়, তা দেখার জন্য ভিড় করছে গ্রামের পোলাপানের দল।

এই গ্রাম সেই গ্রাম ঘুরে চারজনকে খুঁজে নিয়েছে ডাক্তারের দল। এদের কারও অপারেশন প্রয়োজন, কারও সমস্যা গুরুতর। ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে বিনা পয়সায় চিকিৎসা হবে এদের। দুদিন ধরে কালিন্দা গ্রামের স্কুলমাঠে রোগী দেখছে ডাক্তার। কেউ কানের ডাক্তার, কেউ গলার, কেউ হৃৎপিণ্ডের। লোকের ঢল নেমেছে স্কুলমাঠে। এত রোগ, এত রোগী গ্রামে—তারা নিজেরাই তো জানত না! চোখের ডাক্তারের কাছে গ্রামের মানুষেরা নিয়ে এল মকবুলকে। এই গ্রামে এখন একজনই অন্ধ মানুষ। গ্রামের মানুষদের চোখের মামুলি চিকিৎসা শেষে চিকিৎসকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল মকবুলকে নিয়ে। নানা রকম পরীক্ষা করল তারা তার চোখে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গেল চার-পাঁচ দিনে মকবুলের অনেক সময় কাটে ডাক্তারের দলের সঙ্গে। জন্মান্ধ মকবুল বিদেশি দলের আগ্রহের মূল বিষয় হয়ে গেল।


আর এদিকে, গ্রামের পোলাপান আর বাকি মানুষদের আগ্রহ তত দিনে বিদেশিদের দল থেকে ম্লান হয়ে যাচ্ছে প্রায়। কারণ, সোনায় সোহাগা হয়ে গ্রামে এসেছে রওশন সার্কাসের দল। এই প্রতিদিনের একই রকম গড়িয়ে যাওয়া দিনের মধ্যে ফুর্তি যখন আসে, দল বেঁধে আসে। বিদেশি দলের পেছন পেছন ঘোরার ফুর্তির ফাঁকে, দ্য গ্রেট রওশন সার্কাস দল চলে এসেছে। সৈয়দপুরের আশপাশে খেলা দেখাতে দেখাতে তারা এবার কালিন্দায় এসেছে। আকর্ষণের সুতো তাই বিদেশি দল থেকে সরে দ্য গ্রেট রওশন সার্কাসে আটকে গেল।
দিনের বেলা গ্রামে ঘুরে ঘুরে দ্য গ্রেট রওশন সার্কাসের সন্ধ্যার ঝুনঝুনি আর রংবেরঙের আয়োজনের ক্যানভাসিং করে মকবুল। সার্কাসের ক্যানভাসিংয়ের কাজ সেরে বিদেশি ডাক্তারদের কাছে যায় চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। গত কদিন এমন করেই কাটছে। সন্ধ্যা-রাতজুড়ে সার্কাসের রংবাহারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওঠে একঘেয়ে দিনে অভ্যস্ত গ্রামবাসী। সার্কাসের শিউলিমালা যখন চারটি কাচের বোতলের ওপর ক্ষীণ কাঠের এক পাটাতন বিছিয়ে ভার সামলে দিব্যি দুই হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন তাকে পাখির মতো লাগে। চারটি থেকে আটটা, তারপর ষোলোটা বোতলের পর কাঠের পাটাতন যোগ করে করে, ওই ওপরে যখন হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, শিউলিমালা তখন যেন বিন্দু বিন্দু তাপে জেগে ওঠা পর্বতমালা। কেউ সার্কাসের রঙে ভেসে যায় সমুদ্রের ভ্রমে, কেউ ভাবে দূরের পাহাড় ছুঁল, কেউ দেখে রং, কারও মনে পুলক জাগায় সার্কাসের ঢং।


মকবুল শুধু এ সময়ে ঘরে থাকে। বোন সার্কাসে যাওয়ার আগে বলে, ‘ও ভাই, সবাই যায়, তুইও চল।’
মকবুল হাসে। এ কথার বিপরীতে হাসিই যথেষ্ট।


সার্কাস শেষে গীতপালা হয়, সেই পালার সুর পালক হয়ে কালিন্দার ধুলোকণামাখা কুয়াশার মতো, নারকেলপাতার বাতাস হয়ে হয়ে মকবুলের জানালায় ফিরে আসে। মকবুল জানালায় দাঁড়িয়ে শোনে সে গীত—
কেউটে হবা?
চড়ুই পাখি?
সোনারঙা মাটি?
এ জনম না চিনলে মানুষ
কেমনে হবা খাঁটি?
এমন করেই অল্প কয়েকটা দিন আর রাত এমন রঙিন ঘটনার জোড়াতালিতে কেটে যায়। তবে এসব এমন দিন বহু দিন আসেনি কালিন্দায়। এদিকে বিদেশি ডাক্তারের দল জানায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা আশাবাদী, জন্মান্ধ মকবুলের দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চোখের চিকিৎসা হলে ডান চোখের অন্ধত্ব ঘুঁচতে পারে। কিন্তু বাঁ চোখের চিকিৎসা আর সম্ভব নয়। বিদেশি দল মকবুলকে জানায়, তারা মকবুলকে কালিন্দা থেকে নিয়ে যাবে ঢাকায়, তারপর বিদেশ। বিনা পয়সায় চিকিৎসা শেষে মকবুল চোখওয়ালা মানুষ হয়ে ফিরে আসবে। গ্রামের চেয়ারম্যান, আর স্কুলের হেডমাস্টার এ খবর জানায় গ্রামবাসীকে। এ যেন যমুনা হলের সিনেমার মতো ঘটনা। মকবুল কি তবে এ সিনেমার নায়ক? জসীমের মতো? কালিন্দা গ্রামের মানুষ মকবুলের আশপাশের মানুষ হতে পেরে গুরুত্বপূর্ণ বোধ করে। যেন প্রত্যেকে সিনেমার প্রয়োজনীয় পার্শ্বচরিত্র। কালিন্দা গ্রামে একসঙ্গে মনে রাখার মতো এত ঘটনা আগে তো কখনো ঘটেনি।

অন্ধ হয়ে থাকার চেয়ে তো কানা হওয়া ঢের ভালো। এক চোখে দেখতে তো পাবে—এই ভেবে সবচেয়ে আনন্দ হলো মকবুলের বোনের। পাশের বাড়ির জমিলাবু জানিয়েছে, ভাইয়ের এক চোখের আলো ফিরলে একটা ভালো মেয়ে খুঁজে বিয়েও দেওয়া যাবে। এমন সহজ পরিচিত জীবন হবে তার অন্ধ ভাইয়ের, বোন কি স্বপ্নেও ভেবেছিল? ভাইকে যখন এসব আশার কথা বলে বোন, মকবুল হাসে। ভাইবোন মিলে হাসতে থাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজগর আলী বলেন, ‘কিরে মকবুল, আমি তোরে বলছিলাম না, তুই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা? দেখ, পুরা গ্রাম এখন তোর পেছনে ঘোরে।’ হেডমাস্টার স্যার হাসে। হাসে মকবুলও। দুজন মিলে হাসতে থাকে।


সিনেমার শেষ হওয়ার আগের মুহূর্তগুলো কেমন যেন উত্তেজনার। আর যদিনা সেই গল্প আমাদের একঘেয়ে জীবনের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। আর আমরা সবাই জীবনের চেয়েও বড় সেই অচেনা জীবনের অংশ হয়ে উঠি। এত রঙিন নকশায় বাঁধা ঘটনার পরে কালিন্দার মানুষ শেষ দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করে।


সার্কাস দল রঙিন সাজবাক্স গুছিয়ে গ্রাম থেকে ফেরার প্রস্তুতি নেয়। বিদেশি দলও তাদের বাক্স বন্ধ করে ফেরার জন্য, সঙ্গে নিয়ে যাবে মকবুলকে। একসময়ের বাক্সবিহীন মকবুলও নতুন কেনা টিনের বাক্সে গুছিয়ে নেয় টুকটাক সব। চোখওয়ালা মানুষ হওয়ার জন্য তার এ যাত্রা।


বাক্স বন্ধ করে চলে গিয়েছিল বিদেশি ডাক্তারের দল, সার্কাসের দল। চলে যায় মকবুলও। তবে চলে যাওয়ার দিন সকালে মকবুলকে খুঁজে পায়নি বিদেশি ডাক্তারের দল। মকবুল নেই, নেই তার টিনের বাক্স। কালিন্দায় কেউ খুঁজে পায়নি তাকে। তাই মকবুলকে ছাড়াই ফিরে গিয়েছিল বিদেশি দল।


লোকমুখে শোনা যায়, অন্ধ মকবুল এখন দ্য গ্রেট রওশন সার্কাসে খেলা দেখায়, সময়ের হিসাব বলে দেওয়ার সেই খেলা। খেলা দেখায় গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে। বাউল কিংবা পথিক হয়ে?
কালিন্দা গ্রামে সে আর কখনো ফেরেনি।


অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]