সিম্বলস অ্যান্ড সাইনস

ভ্লাদিমির নবোকভ (১৮৯৯-১৯৭৭) একজন রুশ সাহিত্যিক। প্রথম জীবনের লেখাগুলো তিনি রাশিয়াতে বসেই লেখেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইউরোপে চলে যান এবং ইউরোপ থেকে আমেরিকায় পাড়ি দেন। সেখানে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। ‘সিম্বলস অ্যান্ড সাইনস’ গল্পটি তিনি ইংরেজিতেই লেখেন। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৫ মে ১৯৪৮ সালে ‘নিউইউর্কার’–এ ‘সিম্বলস অ্যান্ড সাইনস’ নামে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নবোকভ নিজেই গল্পের শিরোনাম পরিবর্তন করে ‘সাইনস অ্যান্ড সিম্বলস’ রাখেন। কারণ, প্রথম যখন গল্প লেখেন, তখন এটির নাম ‘সাইনস অ্যান্ড সিম্বলস’ই ছিল। গল্পটি ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন ফারুক আব্দুল্লাহ।

মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ এক তরুণের জন্মদিনে কী উপহার নিয়ে যেতে হয়, গত চার বছরে এ নিয়ে চতুর্থবার তারা এই সমস্যাজনক প্রশ্নটার মুখোমুখি হলেন। তরুণটির কোনো চাহিদা নেই। মানুষের তৈরি সবকিছু তার কাছে হয় শয়তানের চাকের মতো মনে হয়, যার মধ্যে সে ঘৃণ্য জীবন্ত কিছুর নড়াচড়া দেখে—যেটা কেবল সে-ই দেখতে পায়, নয়তো তার নিজের তৈরি করা বিমূর্ত জগতে এই সব স্থূল আরামের জিনিসপত্রের কোনো ব্যবহার দেখে না। তাকে চটাতে পারে কিংবা ভীত করতে পারে, এমন অনেক জিনিসপত্র জন্মদিনের উপহার হিসেবে তারা বাতিল করেছেন (যেমন যন্ত্রপাতি টাইপ জিনিসপত্র, একদমই নিষিদ্ধ), সুতরাং তরুণটির মা-বাবা নিরীহ মামুলি একটা ঝুড়ির মধ্যে দশটা দশ রকমের ফলের সুস্বাদু জেলির ছোট ছোট জার নিলেন।
জন্মের সময় তার মা-বাবা সন্তানহীন দম্পতি হিসেবে খুব দীর্ঘ সময় পার করেছিলেন। আর তার জন্মানোর পর কেটে গেছে আরও অনেক বছর, তারা এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। ভদ্রমহিলা নিজের রুক্ষ ধূসর চুল অযত্নে বেঁধেছেন, সস্তা কালো কাপড় পরেছেন। তার বয়সী অন্য মহিলাদের মতো না একদমই (যেমন পাশের বাড়ির প্রতিবেশী মিসেস সল, যার গোটা মুখ গোলাপি, ফিকে হতে থাকা লালে রাঙানো আর হ্যাটে গোঁজা গুচ্ছ গুচ্ছ ব্রুকসাইড ফুল), তিনি বসন্তের খুঁত খোঁজা আলোতে তার ফ্যাকাশে নিরাভরণ মুখ নিয়ে প্রকাশিত হন। তার স্বামী তাদের পুরোনো শহরে মোটামুটি সফল ব্যবসায়ী ছিলেন, বর্তমানে নিউইয়র্কে তার ভাই—চল্লিশ বছর বয়সী খাঁটি আমেরিকান আইজ্যাকের মুখাপেক্ষী হয়ে আছেন। তাদের সঙ্গে আইজ্যাকের কালেভদ্রে দেখা হতো আর তারা তাকে প্রিন্স বলে ডাকত।

সেই শুক্রবার, তাদের সন্তানের জন্মদিন, সেদিন সবকিছু ভুলভাল ঘটছিল। সাবওয়ে ট্রেনটা তার জীবনীশক্তি হারিয়ে দুই স্টেশনের মাঝে থেমে ছিল। আর পনেরো মিনিট তারা তাদের বুকের ধুকপুক ও খবরের কাগজের খচমচ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না। যে বাসটা তাদের ধরার কথা, সেটা আসতে দেরি করায় অনেকক্ষণ রাস্তার এক কোনায় অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল, যখন সেটা এল, তখন ওটা ছিল হাইস্কুলের ফিচকে ছাত্রছাত্রীতে ভরা। তারা যখন স্যানেটরিয়ামের যাওয়ার বাদামি পথটাতে হাঁটছিল, সে সময়েই শুরু হয়েছিল বৃষ্টি। স্যানেটরিয়ামে তারা আরও খানিকটা অপেক্ষা করল, আর তার ছেলে যেমন পা টেনে টেনে হাঁটে, তেমন করেই, যেভাবে সে আসে (অন্ধকার মুখ, দ্বিধাগ্রস্ত, অযত্নে কামানো গাল, আর ব্রণে ক্ষতবিক্ষত), একজন নার্স, যাকে তারা আগেও দেখেছেন—মুখচেনা এবং তাদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে কেউ এল, আর তাদের সন্তান আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে—এই খবরটা খুব প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করার পরও তারা নার্সের উপস্থিতিকে তেমন গা করলেন না। সে ঠিক আছে, কিন্তু তার মা-বাবার উপস্থিতি এই মুহূর্তে তাকে বিরক্ত করতে পারে—মানে আজকের দেখা। জায়গাটা এমন শোচনীয়ভাবে কম জনবলের, আর জিনিসপত্র হারিয়ে যাওয়া কিংবা একজনেরটা অন্যজনের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সহজ সম্ভাবনার কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে ছেলের জন্য আনা জন্মদিনের উপহারটা তারা স্যানেটরিয়ামের অফিসে না রেখে পরেরবার যখন আসবেন, আবারও ওটা নিয়ে আসবেন।

বিল্ডিংটার বাইরে ছাতা খোলা হলে তার হাত ধরবেন বলে স্বামীর ছাতা খোলার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। তার স্বামী গলা খাঁকারি দিয়ে গলা ঠিক করছেন—বিষণ্ন থাকলে যা তিনি সচরাচর করে থাকেন। তারা রাস্তা পার হয়ে অন্য দিকের বাস স্টপেজের ছাউনিতে পৌঁছানোর পর তার স্বামী ছাতাটা বন্ধ করেছিলেন। কিছু দূরেই একটা আন্দোলিত আর পানি চুইয়ে পড়া গাছের নিচে, শুকনা, এখনো অপরিপক্ব একটা পাখি অসহায়ভাবে খাবার নিয়ে কসরত করছিল।

সাবওয়ে স্টেশনে যাওয়ার দীর্ঘ পথে তিনি আর তার স্বামী একটা কথাও বললেন না নিজেদের মধ্যে। প্রতিবার ছাতার হ্যান্ডেল ধরে ঝাঁকানোর সময়ই তিনি স্বামীর হাতের দিকে তাকিয়েছেন, বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া হাতের বাদামি দাগ পড়া শিরা আর ঝুলে যাওয়া চামড়া প্রতিবারই তার চোখে ধরা পড়েছে। ভদ্রমহিলা কান্নার দমক আটকে রাখছেন। তিনি অন্য দিকে মন দিতে চাইছিলেন এবং যাত্রীদের মধ্যে একটি মেয়ে—যার চুল কালো আর নখগুলো অপরিচ্ছন্ন লাল—মেয়েটার দিকে তাকাতে গিয়ে নিজের ভেতর হালকা ধাক্কা অনুভব করলেন, কিছুটা সহানুভূতি আর অনেকখানি বিস্ময় নিয়ে দেখলেন, মেয়েটি একজন বয়স্ক মহিলার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছেন। আচ্ছা মহিলাটি জানি কার মতো দেখতে? ওহ, অনেকটা রেবেকা বরিসভোনার মতো দেখতে, যার মেয়ের বিয়ে হয়েছে মিন্সকে, এক বছর আগে, সলভেইচিকসদের একজনের সঙ্গে।
তাদের পুত্র শেষবার যখন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, ডাক্তারদের ভাষায়, সেটা নাকি অভিনবত্বের মাস্টারপিস। সে সফলই হতো হয়তো, যদি না ঈর্ষান্বিত আরেক রোগী, যে কিনা ভেবেছিল তরুণটি ওড়া শিখছে, যাহোক, সে তাকে সময়মতো থামাতে পেরেছিল। অথচ সে যাচ্ছিল নিজের দুনিয়ায় একটা গর্ত খুঁড়ে সেই দুনিয়া থেকে পালাতে।

তার এই মানসিক বিভ্রমের ধরনের ওপর বিস্তারিত গবেষণাপত্র একটা বিজ্ঞান সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিল। সেই পেপারটা স্যানেটরিয়ামের ডাক্তাররা তাকে পড়তে দিয়েছেন, অথচ এর অনেক আগেই তিনি আর তার স্বামী দুজনেই ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছিলেন। ‘রেফারেনশিয়াল ম্যানিয়া’—প্রবন্ধটি সমস্যার নাম রেখেছিল এটি। খুবই বিরল এই মানসিক সমস্যায় রোগীরা কল্পনা করেন তার আশপাশে যা ঘটে, সেগুলো তার ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্বের বিমূর্ত রেফারেন্স। সে এই ষড়যন্ত্রে বাস্তব মানুষের কোনো ভূমিকা দেখে না, যেহেতু সে অন্য মানুষদের চেয়ে নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে করে। সে যেখানেই যাক, প্রকৃতি তাকে ছায়া দেয়, মেঘেরা নিজস্ব সংকেতের মাধ্যমে তার বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করে। তার ভেতরের চিন্তা মূলত আলোচিত হয় সন্ধ্যায়, ইশারা আর ইঙ্গিতময় বর্ণমালায়, অন্ধকারে অঙ্গভঙ্গিরত গাছের সঙ্গে। নুড়ি অথবা দাগ কিংবা বিভিন্ন আকারে, অদ্ভুত কিছু উপায়ে—এমন কোনো বার্তা, যেটা তাকে বুঝতেই হবে। সবকিছুই তার কাছে সাইফার মেসেজ—সবকিছুর উপলক্ষ সে নিজেই। তার চারপাশে গুপ্তচর। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার কেবলই পর্যবেক্ষক, যেমন কাচপৃষ্ঠ, নিথর জলাশয়; কিংবা অন্য কিছু, যেমন দোকানে জানালার কাছে ঝুলে থাকা কোট হচ্ছে সংস্কারগ্রস্ত পর্যবেক্ষক, অন্তরে পাষাণ, আবার অন্যান্য (বহমান পানির ধারা, ঝড়), এসব হচ্ছে বদ্ধ উন্মাদ রকমের হিস্টিরিয়াগ্রস্ত। তরুণের ব্যাপারে তাদের মতামত বিকৃত, আর তার কাজকর্মকে তারা হাস্যকরভাবে গুলিয়ে ফেলে। নিজেকে তার নিজেরই পাহারা দিতে হবে আর তার জীবনের প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা পর্যায়কে একান্তভাবে নিবেদিত রাখতে হবে চলমান বার্তার মর্ম উদ্ধারে। তার প্রতিটি নিশ্বাসের হিসাব গুনে রাখা হচ্ছে, নথিবন্দী থাকছে। এ যদি কেবল তার আশপাশের ব্যাপারগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকত—কিন্তু হায়, সেটা হয়নি! বরং দূরত্বের কারণেই বুনো কলঙ্কের স্রোত আকারে বাড়তে থাকে, মুখরা হয়। তার রক্তকণিকার, দশ লাখ গুণ বড় হতে থাকে, আছড়ে পড়ে বিশাল পৃষ্ঠে, আবার আরও দূরে থাকা পর্বতের সমস্ত ওজন আর উচ্চতা একীভূত হয়—গ্রানাইট আর দেবদারুর হাহাকারে, তার অস্তিত্বমানতার চূড়ান্ত সত্য হিসেবে।

ওনারা যখন সাবওয়ের কদর্য বাতাস আর কোলাহল থেকে বের হলেন, দিনের তলানির আলো-অন্ধকার মিশে যাচ্ছিল স্ট্রিট লাইটের সঙ্গে। ভদ্রমহিলা রাতের খাবারের জন্য মাছ কিনতে চাইছিলেন, যে জন্য তিনি নিজের হাতে থাকা জেলির ঝুড়িটা স্বামীর হাতে দিয়ে তাকে বাড়িতে চলে যেতে বলেছিলেন। কথামতো ওনার স্বামী, তিনি তাদের ভাড়া নেওয়া বাড়ির তৃতীয় তলা পর্যন্ত উঠলেন এবং তারপর তার মনে পড়ল যে দিনে সকালেই স্ত্রীকে নিজের চাবিটা দিয়েছিলেন।

তিনি চুপচাপ সিঁড়িতে বসলেন আর প্রায় দশ মিনিট পর যখন তার স্ত্রী সিঁড়িতে পা টেনে শব্দ করে ফিরলেন, তিনি নিঃশব্দে দাঁড়ালেন, তার স্ত্রী জোর করে একটু হাসার মতো করলেন আর গম্ভীরভাবে নিজের এমন বোকামির মাথা নাড়লেন, কিছুটা আত্মধিক্কারের মতো। তারা দুজনই দুই রুমের এই ফ্ল্যাটবাড়িটির ভেতর ঢুকলেন, ভদ্রমহিলার স্বামী সরাসরি আয়নার কাছে চলে গেলেন, তার মুখের একদিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি ঢুকিয়ে চাপ দিলেন, খুব বিদঘুটেভাবে মুখ বিকৃত হয়েছিল যেনবা মুখোশ পরা কেউ, বের করে আনলেন তার সদ্য কেনা মাত্রাতিরিক্ত রকমের অস্বস্তিকর আলগা দাঁতগুলো। তার স্ত্রী যতক্ষণে খাবার টেবিল সাজাচ্ছিলেন, তখনো তিনি রাশান ভাষার সংবাদপত্র পড়ছিলেন। উনি ফ্যাকাশে ঝোল খাচ্ছিলেন, যা খেতে দাঁতের দরকার হয় না। তার স্ত্রী তার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছিলেন, তিনিও তাই চুপ ছিলেন।

যখন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি ঘুমাতে গেলেন, ওনার স্ত্রী লিভিং রুমে থাকলেন তার এক প্যাকেট মলিন তাস আর তার পুরোনো ছবির অ্যালবাম নিয়ে। অপ্রশস্ত উঠানে, অন্ধকারে, যেখানে ছাই ফেলার ধাতব ঝুড়িতে বৃষ্টি টুংটাং শব্দ করত, জানালাগুলো নির্দোষ রকমের হালকা, আর সেই সব জানালার একটাতে কালো ট্রাউজার পরা একজন, যার হাত দুটো মাথার পেছনে এমনভাবে জড়িয়ে রাখা, যাতে কনুই দুটো উঁচু হয়েছিল, সে হয়তো তাকে একটা অগোছালো বিছানায় অলস শুয়ে থাকতে দেখতে পারছে। তিনি পর্দাটা নামিয়ে দিলেন আর অ্যালবামটা খুলে দেখতে শুরু করছিলেন।
শিশু বয়সে সে অন্য শিশুদের তুলনায় বেশি বিস্মিত হতো। লেইপজেগে তাদের বাসায় কাজ করত যে মেয়েটি আর তার ভোঁতা মুখের বাগদত্তা, যে অ্যালবামের ভাঁজের সবটা জুড়ে আছে। তিনি পৃষ্ঠা ওলটালেন, মিন্সক, বিপ্লব, লেইপজেগ, বার্লিন, আবার লেইপজেগ, ঢালুর মধ্যে থাকা বাড়িটা, বাজেভাবে দৃষ্টিসীমানার বাইরে।

ছেলেটার বয়স যখন চার—এই তো এখানে, পার্কের, লাজুক আর কপাল কুঁচকে দূরের একটা চঞ্চল কাঠবিড়ালিকে দেখছে। আর এই তো আন্ট রোজা, সদা ব্যস্ত, তির্যক আর বুনো দৃষ্টির একজন বৃদ্ধা। যিনি ভয়ে কম্পমান আর দুঃসংবাদময় এক জগতে বাস করতেন—দেউলিয়াত্ব, ট্রেন দুর্ঘটনা, আর ক্যানসার ইত্যাদি খবর তিনি বয়ে বেড়াতেন, যত দিন না জার্মানরা এসে তার চিন্তার বিষয় যে মানুষেরা, তাদেরসহ তাকে মেরে ফেলল।

তার ছেলে ছয় বছর বয়সে, এটা সেই সময়, যখন সে অদ্ভুত পাখিদের ছবি আঁকত, যাদের হাত-পা থাকত মানুষের আর বড় মানুষদের মতো তারও ছিল ইনসমনিয়া।
তার কাজিন, যে এখন বিখ্যাত দাবা খেলোয়াড়। এই তো আবার তার ছেলেটার ছবি, আট বছরের কাছাকাছি, তখন থেকেই কঠিন হওয়া শুরু করেছে তাকে বুঝতে পারা। প্যাসেজের ওয়াল পেপারে সে ভয় পেত, বইয়ের কিছু কিছু ছবিতে ভয় পেতে লাগল—যেগুলো হয়তো খুবই শান্ত ল্যান্ডস্কেপ, যেখানে কোনো ছোট টিলা কিংবা পাহাড়ের পাশে পাথর অথবা পুরোনো ঠেলাগাড়ির চাকা, যেটা পাতাহীন গাছের কোনো ডালে ঝুলে আছে।

তাদের পুত্র শেষবার যখন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, ডাক্তারদের ভাষায়, সেটা নাকি অভিনবত্বের মাস্টারপিস। সে সফলই হতো হয়তো, যদি না ঈর্ষান্বিত আরেক রোগী, যে কিনা ভেবেছিল তরুণটি ওড়া শিখছে, যাহোক, সে তাকে সময়মতো থামাতে পেরেছিল। অথচ সে যাচ্ছিল নিজের দুনিয়ায় একটা গর্ত খুঁড়ে সেই দুনিয়া থেকে পালাতে।

এখানে যখন ওর দশ বছর—যে বছর তারা ইউরোপ ছেড়েছেন, ইউরোপ থেকে আমেরিকায় আসার পথে পদে পদে গ্লানি, কৃপা আর অসম্মানকর সমস্যার কথা তিনি ভোলেননি, আর সেই বিশেষ স্কুলের কথা, আমেরিকায় আসার পর যেখানে তাকে ভর্তি করানো হয়েছিল, সেই সব কুৎসিত, বিদ্বেষী আর পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের সঙ্গে তার ছেলে একই স্কুলে পড়ত। আর তারপর তার জীবনে সেই ব্যাপারটা এসেছিল, নিউমোনিয়ায় দীর্ঘ ভোগান্তির পর যখন সে সেরে ওঠার পথে, তার ছোট ছোট ভয়গুলো, যেগুলোকে মেধাবী মনের স্বাভাবিক খেয়াল হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য জেদ করতেন তার মা-বাবা, সেগুলো আরও জটিল হতে থাকল, আর হ্যাঁ, অবশ্যই মেধাবী সে, অসংখ্য পরস্পর সদা পরিবর্তিত সম্পর্কের মধ্যে তার নিজের তৈরি মায়াবী বাস্তবতার যে যৌক্তিক সমন্বয়, যেগুলো সাধারণ মানবমনের জন্য অগম্য ছিল।

এগুলো সব, বরং আরও অনেক কিছু, তিনি মেনে নিয়েছিলেন, যেহেতু বেঁচে থাকা মানেই এক আনন্দের পর আরেকটা আনন্দকে ছাড়া—যদিও তার ক্ষেত্রে আনন্দের জন্য তো নয়ই, খুবই ক্ষীণ—অবস্থার উন্নতির সম্ভাবনার প্রত্যাশায়। তার ভেতর গভীর ও জীবন্ত দুঃখের একটা স্রোত বয়ে গিয়েছিল, এদিক কিংবা ওদিক তাকে আর তার স্বামীকে সহ্য করতেই হবে; একটা অদৃশ্য দানব তাদের সন্তানকে অচিন্তনীয় কায়দায় আঘাত করে যাচ্ছে, আর কোমলতাভর্তি দুনিয়ায়; কোমলতার ভাগ্য, হয় ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিংবা অপচয় হওয়া কিংবা উন্মাদ হওয়া; উপেক্ষিত শিশুরা লুকিয়ে আছে পৃথিবীর খাদের কিনারে; জন সুন্দর আগাছা; যে কি না সুন্দর আগাছার মতো কৃষকের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে জানে না।

তখন মধ্যরাত, যখন লিভিং রুম থেকে ভদ্রমহিলা স্বামীর বিলাপ শুনতে পেলেন, আর তার স্বামী তখন টলছিলেন, তার নাইটগাউনের ওপর পুরোনো একটা ওভারকোট চাপিয়েছিলেন, যেটার কলার মধ্য এশিয়ার ভেড়ার পশমে তৈরি, যেটা তিনি সাধারণত সুন্দর নীল রঙের বাথরোবের সঙ্গে পরতে পছন্দ করতেন।
‘আমি ঘুমাতে পারতেছি না,’ তিনি চিৎকার করলেন।

‘কেন ঘুমাতে পারছ না,’ ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তো অনেক ক্লান্ত ছিলে।’
‘আমি ঘুমাতে পারছি না। কারণ, আমি মারা যাচ্ছি,’ স্ত্রীকে বললেন তিনি এবং কাউচে শুয়ে পড়লেন।

‘তোমার পেটে সমস্যাটা? তুমি বললে আমি ডাক্তার সলোভকে ফোন দিই?’
‘নাহ, কোনো ডাক্তার না, কোনো ডাক্তার না,’ তিনি বিলাপ করলেন, ‘ডাক্তারদের সঙ্গে থাকা শয়তানের প্রতি! আমাদের যেভাবেই হোক তাকে (তাদের সন্তানকে) ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে, এ ছাড়া আমরাই দায়ী থাকব…দায়ী থাকব।’ তিনি লাফ দিয়ে বসলেন, পা দুটো মেঝেতে, তার মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে নিজের কপালে আঘাত করতে থাকলেন।

‘আচ্ছা,’ তিনি (ভদ্রমহিলা) শান্ত কণ্ঠে বললেন। ‘আমরা কালকে সকালেই তাকে বাসায় আনব।’

‘আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে,’ ভদ্রমহিলার স্বামী বলে বাথরুমে গেলেন।
তিনি কষ্ট করে ঝুঁকলেন, এর মধ্যে তার হাত ফসকে কয়েকটা তাস পড়ে গেছে, হার্টসের জ্যাক, স্পেডের ৯, টেক্কা, তাদের গৃহপরিচারিকা আর তার হাট্টাকোট্টা বাগদত্তা। এর মধ্যে তার স্বামী বেশ জোশ নিয়ে ফিরে এলেন, গলা চড়িয়ে বললেন, ‘আমি সবকিছু ঠিক করে ফেলছি, আমরা ওর থাকার জন্য বেডরুমটা ওকে দেব, আমাদের মধ্যে একজন রাতের একটা অংশ ওর ওখানে থাকব, আর কাউচে অন্যজন—এমন বদল করে থাকব, আমরা সপ্তাহে কমপক্ষে দুবার ডাক্তার যেন দেখে যায়, সেটার ব্যবস্থা করব, প্রিন্স যা-ই বলুক, ওর বলার মতোও তো কিছু নেই, আর ব্যবস্থা হিসেবে এটা সস্তাও।’

টেলিফোন বেজে উঠল, এটা ফোন বাজার সময় নয়, ভদ্রলোক ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলেন, আর একটা পা, যেটা থেকে স্যান্ডেল ছুটে গেছে, সেটা দিয়ে স্যান্ডেলটা খুঁজতে লাগলেন, আর শিশুর মতো, দন্তহীন হাঁ করলেন স্ত্রীর দিকে, যেহেতু তার স্ত্রী তার থেকে ভালো ইংরেজি জানেন, তাই তার স্ত্রীই সাধারণত ফোন ধরেন।
‘আমি কি চার্লির সঙ্গে কথা বলতে চাই,’ একটা নিষ্প্রাণ, ক্ষীণ কণ্ঠ তাকে বলল।
‘আপনি কোনো নম্বর চাচ্ছেন? না, আপনি রং নাম্বারে ফোন করেছেন।’
ভদ্রমহিলা শান্তভাবে ফোনটা রেখে দিলেন, আর বুকে হাত রাখলেন, ‘এটা আমাকে ভয় ধরিয়ে দেয়,’ তিনি বললেন।

তিনি ত্বরিত একটা হাসি হাসলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তেজিত একপক্ষীয় কথোপকথনে ফিরে গেলেন। তাকে (ছেলেকে) তাদের দিন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আনতে হবে। তার নিরাপত্তার জন্য তারা তাদের সমস্ত ছুরি একটা তালা দেওয়া ড্রয়ারে রেখে দিতে হবে, এমনকি তার ভয়াবহ বাজে সময়েও সে অন্য কারও জন্য ঝুঁকির কারণ নয়।
ফোনটি দ্বিতীয়বারের মতো বেজে উঠল।

সেই একই বেসুরা, উদ্বিগ্ন কণ্ঠ চার্লিকে চাইল।
‘আপনার নম্বরটা ভুল, আমি আপনাকে বলতে পারি, আপনার কী ভুল হচ্ছে, আপনি শূন্য না চেপে বর্ণমালার ও চাপ দিচ্ছেন।’ তারপর তিনি ফোন রাখলেন।
তারা তাদের অপ্রত্যাশিত, উৎযাপনমতো মাঝরাত্রির চা পানে বসলেন। ভদ্রমহিলার স্বামী সশব্দে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন; তার মুখ রক্তিম; একটু পরপর তার চায়ের গ্লাস বৃত্তাকার পথে উঁচু করছিলেন, যাতে করে চায়ে দেওয়া চিনি গলতে পারে দ্রুত। তার টাক মাথার পাশের শিরাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আর চিবুকে রুপালি লোম জ্বলজ্বল করছে। জন্মদিনের উপহার টেবিলেই রয়ে গেছে। তার স্ত্রী যখন তাকে আর এক গ্লাস চা ঢেলে দিচ্ছেন, ভদ্রলোক তার চশমাটা পরে উজ্জ্বল হলুদ, সবুজ আর লাল ছোট জারগুলো আবার পরীক্ষা করতে থাকলেন, তার ভেজা কুঁচকানো ঠোঁটে জারের লেবেলগুলো জোরে জোরে পড়তে লাগলেন—অ্যাপ্রিকোট, গ্রেপ, বিচ পাম, কুয়েন্স, তিনি যখন আপেলের জারটা আঁকড়ে ধরতে গেলেন, তখন ফোনটা আবার বেজে উঠল।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]