সুজন সুপান্থর কবিতা

কবিতাকে কথার মায়ায় বেঁধে রাখতে ভালোবাসেন সুজন সুপান্থ। বাস্তব আর পরাবাস্তব হাত ধরাধরি করে চলে তাঁর কবিতায়। আর পরাবাস্তবতার মোড়কেই তিনি বলে চলেন বাস্তবতাপীড়িত সময়ের কথা। ১৯৮৪ সালে রংপুরে জন্ম নেওয়া এই কবি লেখাপড়া করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এ অবধি তাঁর ৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
সুজন সুপান্থ
ছবি: দীপু মালাকার

মা ও সমুদ্রকারিগর

সন্ধেবেলা পাহাড়ের কাছে গেলেই বাবা সমুদ্রসংক্রান্ত গল্প করত। পাহাড় মানে বাবার বুকের খুব কাছে ধুকপুক ধুকপুক। সেই ধুকপুকে গুটিসুটি হয়ে কান পাতলেই ভেসে আসে পাহাড়ের শব্দ। গল্পের সমুদ্রে স্মৃতির জাহাজ অরুণার দিকে দুলে দুলে চলে। চলতে চলতে একসময় ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায় ঢেউ। দিক ভুলে যায় জাহাজের নাবিক। বোবা হয়ে যায় বাবা।

এ রকম সময় মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্বাক বাবা। মায়ের টলটলে চোখ। মা আমার সমুদ্রকারিগর। রোজ বাবার গল্পে সমুদ্র সারাইয়ের কাজ করে। ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া উত্তাল ঢেউ থেকে ডেকে আনে শান্ত পাখির ডাক। আবারও নিশানা ওড়ায় দিগ্ভ্রান্ত নাবিক।

পাহাড়ের স্নেহ পেরিয়ে বহুদিন পর মায়ের একলা পড়ে থাকা পুরোনো চশমার কাচের দিকে তাকালেই দেখি সেই টলটলে চোখ। ভেতরে বিশাল সমুদ্র। শান্ত শীতল জল। দীর্ঘ যতিচিহ্ন পেরিয়ে দূর সমুদ্রে আবছা একটি জাহাজ বলতে না পারা কথাদের নিয়ে অনির্দিষ্টের দিকে ছুটে যাচ্ছে।

আমি তার ছুটে যাওয়ার দিকে, ধীরে মিশে যাওয়ার দিকে চেয়ে আছি...

জুলাইয়ের স্মৃতি

ঝুম জুলাই পেরিয়ে সবগুলো রাস্তাই কেবল জড়ানো কথার দিকে ছুটে যাচ্ছ। ছেড়ে এসেছি যে বর্ষা, সেখান থেকে কুড়িয়ে রেখেছি শোক, হেসে ওঠা কথার জীবনী। ফেরার কথা ছিল। তবু হেঁটে যাওয়া পথ ধরে দেখি, ঢুকে আছি বহু যত্নে রাখা ডালিমের ভেতর। ঠিক যেভাবে লালের ভেতরে একাকার হয়ে চুপচাপ বেঁচে থাকে ডালিমের দানা। ফিরে আসার সম্ভাবনায় টুপ করে উড়ে এল তেরঙা এক অচিন প্রজাপতি। তাদের শিরশিরানি ডাক ঘিরে আছে নিশ্বাসের মতো।

সম্পর্কের দূরাভাস বুঝতে গিয়ে তার ডানায় মেলে দিচ্ছি পুরোনোর ঝুনঝুন। এমন একটা শব্দ স্মৃতির ভেতর শুধু বেজে যাচ্ছে। বেজে যাচ্ছে, সেই কবে মনে রাখা জুলাই থেকে...

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

কথাদের ডানা

ভোর ফুটলেই দুরূহ হচ্ছে পথ, ভেঙে যাচ্ছে সেতু। তবু ভুলের নামতা নিয়ে বৃষ্টি কেবল এই শেষ ভোরেরই পাঠ। আলো বানানো শিখিয়েছিল যে, তার পথ চলে গেছে চিহ্নহীনতার দিকে। সেদিকেই আজ পুরোনো আয়না নিয়ে দাঁড়িয়েছি। অনিশ্চয়তার ভেতর থেকে গুনে নিচ্ছি হাতের রেখা, বিনিময় করছি মোমের ছায়ার মতো মুছে যাওয়া হাসি ও কান্নার রং।

কথার দূরত্ব থেকে পুরোনো আয়নায় ঠিকঠাক এঁকে নেওয়া সিঁথিপথ বেয়ে ক্রমাগত সে নেমে যাচ্ছে নির্জনতার দিকে, নবধারা জলে। আর জলের ভেতর থেকে ভেসে ওঠা একটি ছায়া মা মা বলে ডেকে আটকাতে চাইছে হারানো মুখরতা।

অথচ দেখো, জুলজুল চোখে সমূহ কাতরতা নিয়ে ভেঙে যাওয়া সেতু পেরিয়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে কথাদের ডানা...

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]