
দিনকালের কাঠখড়
সেলিনা হোসেন
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০১৫
১৯২ পৃষ্ঠা
দাম: ৩৬০ টাকা।
সিল্কের নীল শাড়ি, নীল ব্লাউজ আর বড় নীল টিপ পরে কোপেনহেগেনের বেলা সেন্টারে গিয়েছিল সে। অথচ মেয়েটির নিজের গল্পটা তার ম্যাচিং করা পোশাক আর টিপের মতো নয়। ভীষণ বেদনাসংকুল পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। নিজের গল্প নয়, জলবায়ু সম্মেলনে দেশের ক্ষতির গল্প শুনিয়ে কিছু ক্ষতিপূরণ আনতে গিয়েছিল শরবানু। সেই নিষ্ফলা গল্পগুলো প্রায় সবারই জানা—কীভাবে উন্নত দেশগুলো পৃথিবীকে উত্তপ্ত করছে, সেই উত্তাপের বিষে কেমন করে নীল হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলো, ইত্যাদি। এসব কাহিনির বিষণ্ন ডালপালা ছড়িয়ে দিনকালের কাঠখড় উপন্যাসে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বয়ান করেছেন একটি সবুজের গল্প। সুন্দরবন নামের সবুজাভ অরণ্যকে ঘিরে যে এমন এক বিষণ্ন গল্প বলা যেতে পারে, তা আর কে ভেবেছে!
সবুজ বনের বৃত্তান্ত তথা মাওয়ালি, কাঠুরে ও এ অঞ্চলের অন্য বাসিন্দাদের গল্প বলতে বলতে সমগ্র বাংলাদেশকে যে এভাবে নিপুণ ক্যানভাসে এঁকে ফেলা যায়—উপন্যাসটি না পড়লে তা হয়তো বোঝা যেত না।
না, এ উপন্যাসে কেবল সুন্দরবনের অধিবাসী নয়, আছে জীববৈচিত্র্যের প্রসঙ্গও। শুধু কী জীববৈচিত্র্য—বৃক্ষ, পুষ্প, বিহঙ্গ ছাড়াও এখানে আছে বিচিত্র-নামা ‘মানুষ’—মেয়ে মানুষ, যারা বাঘ-বিধবা হয়; পুরুষ মানুষ, মধু আহরণ করতে গিয়ে যারা বাঘের পেটে যায়; সবাইকেই প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় বাঘ, বনদস্যুর আর ঝড়ের সঙ্গে। উপন্যাসে এসব কথা আছে সবিস্তারে, ঘটনা ও কাহিনির মোড়কে।
এবার উপন্যাসের খানিকটা তুলে ধরা যাক: শরবানুর স্বামী হাসমত আলী বাঘের মুখ থেকে ফিরেছিল। তবে বাঁচেনি। মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে শরবানুকে সে বলেছিল, ‘তোর জন্য আমি মরতে চাই না। আমি মরে গেলে লোকে তোকে বিধবা বলবে, বউ। আমি চাই তুই আমার আগে মরে যাবি। যখন তোর আর আমার বয়স আশি বছর হবে, তখন।’
আইলার আঘাতে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছিল শরবানু। তাকে বাঁচিয়ে পাঠানো হয়েছিল কোপেনহেগেনে, জলবায়ু সম্মেলনে। ঘরও তুলে দেওয়া হয়েছিল তার জন্য। কিন্তু নিত্যদিনের ক্ষুধার সঙ্গে শরবানুর যে যুদ্ধ, তা থামানো যায়নি।
এত দুঃখ-বেদনার পরও তার চাওয়া খুব সামান্য। আইলায় বিধ্বস্ত মৃতপ্রায় শরবানুকে উদ্ধার করা সাংবাদিক শারমিনের কাছে তার সামান্যই আকুতি। সে চেয়েছিল, ‘আপনাকে জীবনের সব কথা বলেছি আপা, আমাকে ভুলবেন না কিন্তু।’ হ্যাঁ, শারমিন তাকে ভুলতে পারেনি। বিএসএফের গুলিতে সীমান্তের কাঁটাতারে যখন শরবানুর কন্যা ফুলানি ঝুলে থাকে, তখন তাঁকে ভুলতে পারে না শারমিন।
বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী সাতক্ষীরা ও সুন্দরবনের মানুষজন তথা শরবানুর জীবনকাহিনি জানার পর লেখকের বর্ণনামতে, ‘অন্য মানুষ’ হয়ে যায় শারমিন। এ উপন্যাস পড়তে গিয়ে হয়তো ‘অন্য মানুষ’ হয়ে যাবেন পাঠকেরাও। ভেতরে তোলপাড় উঠবে।
ইরাবতী ডলফিন, ছড়িয়ে পড়া তেল থেকে শুরু করে সুন্দরবনের সব গল্পই উঠে এসেছে এতে। দুঃখী নারীর উপাখ্যানের অন্তরালে বলা হয়েছে বাংলাদেশের গল্পও। সাংবাদিক শারমিনের প্রেম, কোপেনহেগেনে পরিচয় হওয়া শরবানুর ‘ইন্টারপ্রেটরের’ সঙ্গে বিয়ে, ভারতের মেয়ে প্রান্তিকার শরণার্থী প্রেমিকের গল্প—সব মিলেমিশে বর্ণিল হয়ে উঠেছে উপন্যাসটিতে।
করমজলে হরগোজা কাঁটার বেগুনি ফুলের শোভা মুগ্ধ করেছিল শারমিনকে। তবে শরবানু আর সুন্দরবন ঘিরে তার বিমূঢ়ভাব কাটে না। বারংবার সুন্দরবনের সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণী ‘মানুষ’-এর জীবনই বিহ্বল করে তাকে।
সেলিনা হোসেনের কলমে শরবানুর ভেতর দিয়ে সেই ‘মানুষ’ই পাঠকের সামনে উঠে আসে রক্তমাংসসমেত। তবে সুন্দর এই উপন্যাসে ছোট্ট একটি অসংগতি যেন দাগ ফেলে গেছে—আখ্যানটির চরিত্ররা খুলনা, সাতক্ষীরা ও সুন্দরবনের স্থানিকতায় বেড়ে উঠলেও এ অঞ্চলের ভাষায় কথা বলে না। সবকিছুর পরও দিনকালের কাঠখড় পড়তে পড়তে পাওয়া যাবে অন্য এক জীবনের খোঁজ, যেখানে আনন্দাশ্রুর পাশে আছে দুঃখময় লোনাজীবন।