সেই শরৎ, এই শরৎ

শরৎ এসেছে। তবে এই করোনাকালে শহুরে নাগরিক মানুষ কি পেয়েছেন প্রকৃত শরতের পরশ? শরৎ যে সত্যিই এসে পড়েছে, এটা এখন ঘরে বসে বেশ বোঝা যায় ফেসবুকের কল্যাণে, ফেসবুকের নিউজফিডে পরিচিত কেউ হয়তো কাশফুল পরিবেষ্টিত হয়ে হেসে ওঠেন। তবে কি নাগরিক শরৎও এখন বাক্সবন্দী?

অন্য বহু কারণ বাদ দিয়ে অনেক সময়ে নিজের জন্মের সার্থকতার জন্য কেবল একটি কারণকেই বাহবা দিতে ইচ্ছে করে, যা হলো, এমন একটি অঞ্চলে জন্মেছি এবং বেড়ে উঠেছি, যেখানে ছয়-ছয়টি ঋতু জানান দিয়ে আসে আর যায়; হাজার ব্যস্ততাতেও তাদের আগমন, উপস্থিতি কিংবা তিরোধান কিছুতেই এড়ানো যায় না। এই ভাবনাটা আরও বেশি করে মনে এল যখন কাজের প্রয়োজনে পৃথিবীর এমন কোথাও দিনের পর দিন থাকতে হয়েছে বা হচ্ছে, যেখানে বলতে গেলে ঋতু পরিবর্তন বলে কিছু নেই। সারা বছর এক আবহাওয়া, হোক না সে আরামদায়ক বসন্ত! অজায়গায় বসে বসে ভাবি, এখানে জন্মালে কী হতো রবীন্দ্রনাথের ষড়ঋতুর গানের, আদৌ লেখা হতো কি? ঋতুর পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এই যে আজীবন নিজের মধ্যে মানসিক তথা শারীরিক পরিবর্তন দেখেছি, কখনো বসন্তের রঙে রেঙে উঠেছি, কখনো শীতে কুঁকড়ে স্থবির হয়ে পড়েছি, কখনো গ্রীষ্মের ঘামে ভিজে-নেয়ে আবার আকস্মিক বর্ষায় শীতল হয়েছি, শরতের স্নিগ্ধ আভা সারা শরীরে আবিরের মতো লেগে থেকেছে, এসব কী করে হতো এই অঞ্চলে না জন্মালে!
বেড়ে ওঠার পেছনে প্রতিবছরে প্রতি ঋতুর ফেলে যাওয়া চিহ্নের অবদান অনস্বীকার্য। এক ঋতুর বৈশিষ্ট্যের ওপর কখনো অন্যের ছাপ পড়ে গেলেও প্রতিটিকে বিশেষভাবে আলাদাও করতে পেরেছি, যেমন করেছি শরতকে।

সারা বছর গানের স্কুলে যাওয়া-আসা করে, সমবেত সংগীতে গলা মিলিয়ে গেলেও, কৈশোরের চঞ্চলতার মধ্যে একদিন হঠাৎ করেই লক্ষ করলাম ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই,লুকোচুরি খেলা—/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তা যেন আলাদা কোনো আবেদন নিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বাড়ি থেকে বেরোতেই হয়তো যে আকাশ দেখেছি, তার সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে বহু বছর আগে কবির চোখে দেখা কোনো আকাশ। বরাবরের ধূসর রঙের জায়গায় সাদা আর নীল—কেবল দুটো রঙে ভরে উঠে একটা আকাশ মানুষের মনের অবস্থা আমূল বদলে দিতে পারে। বুঝে উঠতেই উপলব্ধিটা বিস্ময়কর লাগল। ছাদে দাঁড়িয়ে দেখা এই মাত্র কদিন আগের ধূসর মেঘে ঢেকে থাকা, সারাক্ষণ তর্জনে-গর্জনে ভীতিকর হয়ে ওঠা আকাশটার বদলে তার স্নিগ্ধ চেহারা মন ভরিয়ে দিল। তখনকার দিনে কখনো কোনো ঢলে যাওয়া বিকেলে হয়তো ছাদের রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেটে গেছে শরতের অসংখ্য মুহূর্ত। মাথার ওপর অর্ধবৃত্তাকার আকাশের একদিক থেকে আরেক দিকে একটি নির্দিষ্ট মেঘপুঞ্জের ধীরগতিতে, কখনোবা দ্রুত চলে যাওয়া দেখতে দেখতে নিজেকে প্রায়ই হেলে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করতাম। এই এক সাদা মেঘের এত নকশা, এই এক সাদা মেঘ দিয়েই কল্পনায় সাজানো যায় জীবজন্তু, মানুষ, এমনকি আস্ত শহর! সবচেয়ে ভালো লাগত মফস্বল শহরের রাস্তা ধরে চলে যাওয়ার সময় একতলা-দোতলা বাড়িগুলোর দেয়াল আর ছাদের পেছনে মেঘের সারি দেখতাম। চিরকালের পাহাড়প্রিয় আমি, নিজের অজান্তে কল্পনা করে নিতাম অসংখ্য পাহাড়ের সারি, তুষারে ঢাকা। আমার কৈশোরের শহর, দিনাজপুরে হয়তো বহুবার মায়াভরা চোখে তাকিয়েছিলাম রামসাগরের দিকে। দিঘি খুঁড়ে মাটিগুলো স্তূপ করে রাখা ছিল দিঘির চারদিকে। সেই স্তূপের দিকে তাকিয়ে একের পর এক পাহাড়ের একটা দীর্ঘ সারির ধারণা মনে জন্ম নিত। আর একই রকম এক সারি পাহাড়ের চূড়ায় মেঘরূপী তুষারের উপস্থিতি কল্পনা করা সিনেমা কিংবা ফটোগ্রাফির কল্যাণে হয়তো অসম্ভব ছিল না। ভরা শরতে দিনের পর দিন তুষারে ঘেরা পাহাড়ের সারি দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরার ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। আজও হঠাৎ মেঘের দিকে তাকালে কৈশোরের সেসব মুহূর্ত আমাকে পুলকিত করে। তবে এ তো বলতে গেলে শরৎ নিয়ে কল্পনার রাজ্য আমার, বস্তুত শরতের বাস্তবতা ছিল আরও ব্যাপক।

‘নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ঘরে থাকুন’—এই যদি হয় বাস্তব সত্য, দ্বিধান্বিত মন বারবার বলে ওঠে, নাগরিক জীবন থেকে ছিটকে বেরিয়ে খানিক দূরে খোলা আবহাওয়ায় গিয়ে একদিন শরৎ গায়ে মেখে আসা, কাশফুলের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে কৈশোরকে কাছে থেকে দেখে আসা কি আমার নিতান্ত প্রয়োজন নয়?

বর্ষাকালে মুষলধারে বৃষ্টি হতো আমার সেই স্মৃতিময় শহরে। তারপর যেদিন শেষ এক চোট বৃষ্টি হয়ে আকাশটা ঝকঝকে হয়ে উঠত, শরতের আভাস পেয়ে যেতাম। আমাদের খেলার মাঠের চারদিকে, রাস্তার দুধারে ঘাসের ভেতর থেকেই মাথা ফুঁড়ে উঠত লম্বা কাশফুল। ধীরে ধীরে চারদিকে যেন ছড়িয়ে পড়ত সাদা সমুদ্র, সামান্য ঢেউ লাগলেই সেই সমুদ্রে অগুনতি ঢেউ আর ফেনা। ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যেত লম্বা সময়। ধূসর-সাদা কাশবনে চড়া সূর্যের আলো মনকে তেনই চকচকে পরিষ্কার করে দিত। কাশবনের দিকে তাকিয়ে দিন পার করার মতো একটা সময়েই ঢাকের আওয়াজ শুরু হতো। দিন-রাত এদিক-ওদিক থেকে ঢাক আর মন্দিরার শব্দে তখন ভোর হতো, রাত গড়াত। প্রায় সমানসংখ্যক হিন্দু-মুসলিমের বাস ছিল যে শহরে, সেখানে আমাদের জীবনে পুজোর উপস্থিতি ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা। যার উৎসব সে যেমন তৈরি হতো, যার উৎসব নয়, সে-ও যেন একইভাবে তৈরি হতো আনন্দ ভাগাভাগির জন্য। পাড়ায় পাড়ায় মণ্ডপ সাজানোর কাজ শুরু হতো। মাঠে যেদিন প্যান্ডেলের জন্য প্রথম বাঁশটা পোঁতা হতো, সেদিন থেকেই সেখানে শুরু হতো পাড়ার বড় ভাইদের আড্ডা। ধীরে ধীরে বাকিরাও সেই জটলার আশপাশে নিজেদের আড্ডার জায়গা করে নিত। কিছু একটা তৈরি হচ্ছে, সেই সৃষ্টিকর্ম দেখার আগ্রহ কিংবা একটা মিলনমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ—দুটোই আমাদের টানত। সেখানে কিছু পরে পরে একটিই আলোচনা ঘুরেফিরে প্রধান হয়ে উঠত, যা হলো, ওমুক পাড়ার মণ্ডপ বা দেবীমূর্তির সাজগোজ কতটা চোখধাঁধানো হচ্ছে, কার প্যান্ডেল কতটা আকর্ষণীয় হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলা ছিল বলেই হয়তো সেই শহরে বরাবরই টেলিভিশন দেখার ক্ষেত্রে কলকাতার দূরদর্শন চ্যানেলের জনপ্রিয়তা ছিল বিটিভিকে ছাড়িয়ে। সেখানে কলকাতার বিভিন্ন এলাকার মণ্ডপের ছবি আর প্রতিযোগিতা দেখে আয়োজকেরা আরও উৎসাহ পেতেন বৈকি। আমার কাছে অবশ্য এক মণ্ডপের সঙ্গে অন্য মণ্ডপের পার্থক্য কিংবা তাদের তুলনার চেয়ে তাদের আয়োজন করা গানের অনুষ্ঠান কিংবা বিরতিহীন ঢাকের আওয়াজ অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হতো। রাত-বিরাতে কখনো মনে হতো ঢোলের লাঠিটা যেন খেপে গেছে, লয় বাড়তে বাড়তে হয়ে উঠেছে জমজমাট আর রাতের নিস্তব্ধতায় শব্দ বাড়তে বাড়তে চড়ে গেছে সপ্তমে। নিদ্রায় আর জাগরণে ক্রমাগত ঢাকের আওয়াজ শুনতে শুনতে শোনাটাই আমার নেশা হয়ে যেত, যেন সেই তালে অঙ্ক করছি, সেই তালেই চেয়ারে বসে দুলে দুলে পড়ছি। সত্যি কথা বলতে কি, এই যে বসে এ কথাটা লিখছি, এই এখনো চোখ বন্ধ করে কান পাতলে একটানা ঝিঁঝির ডাকের মতো ঢাকের আওয়াজ কানে আসছে!

এসব শরতের স্মৃতি এখন অন্য কোনো জনমের মনে হয়। এখন এ শহর, সে শহর, সবখানে আকাশ ঢেকে দিয়েছে উঁচু ইমারত। বাসস্থানের জানালায় বা বারান্দায় বসে অর্ধবৃত্তাকার নীল-সাদা আকাশ দেখা এখন কল্পনামাত্র। বেশির ভাগ বাড়িতে মানুষ ছাদে ওঠারও অনুমতি পায় না। পেলেও ব্যস্ত জীবন তাকে ছাদে সময় কাটানোর বিলাসিতার অনুমতি দেয় না। এই হলো আমাদের শহরের বর্তমান পরিস্থিতি। মানুষের বাসস্থানের সমাধান প্রকৃতির পরিবর্তন মনে ঠাঁই দেওয়ার চেয়ে হয়তো অর্থনৈতিক এমনকি সামাজিকভাবেও বেশি জরুরি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সমাধান হতেই মানুষের বিনোদনের বোধটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শরতের মনভোলানো বাতাস ভুলেও যদি কোনো কোনাকাঞ্চি দিয়ে তার গায়ে ছোঁয়া দিয়ে যায়, তবে আবেগে সে ভাসবেই। তখন অনুভূতিতে অতীতের শরৎ এসে ধাক্কা খেতে বাধ্য। যেমন আমার কথা যদি বলি, এক ফালি সাদা মেঘ ভেসে বেড়ানো আকাশ দেখলে চমকে উঠি, মনে হয়, এ কী আমার কৈশোরের শহর, দিনাজপুরের আকাশ? গুমোট গরম কমে সন্ধ্যায় ভিন্ন গন্ধের বাতাস গায়ে লাগতেই বিভ্রান্ত হই, এই বাতাসটা কি জাহাঙ্গীরনগর থেকে আসছে?
বাস্তবে শরৎ এখন তাই কল্পনাবন্দী, অনেকটা খোয়াবি পোলাওয়ের মতো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই পোলাও খাওয়ানোতে অগ্রগণ্য। শরৎ যে সত্যিই এসে পড়েছে, ঘরে বসেও জানা যায় যখন নীলচে শাড়িতে কাউকে কাশফুল পরিবেষ্টিত হয়ে হাসতে দেখবেন। শহরতলির কোনাকাঞ্চিতে যখন সারা বছরের পদদলিত স্থানে কিছু কাশফুল লম্বা হয়ে উঠে দাঁড়াবে, কারও না কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। শহুরে শরৎ উদযাপন তাই কাশফুলের সান্নিধ্য এবং তা কেবল ছবি তুলে বন্ধুদের দেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। চারুকলায় গাছের নিচে যে শরতের উৎসবের কিঞ্চিৎ আয়োজন হতো, তা-ও কেউ এবার মুখে আনেনি করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে।

আশ্চর্য হলেও সত্য যে করোনাকালে যখন পৃথিবী স্তব্ধপ্রায়, তখনো দিন গড়ায় আর ঋতু পরিবর্তনের পথ ধরে শরৎও এসে পড়ে। এখন পত্রিকায় ফ্যাশন ডিজাইনের পাতায় হাসিমুখ মডেলের নিত্যনতুন পোশাক পরিহিত ছবির নিচে লেখা থাকে, ‘এ রকম পোশাকে ছাদে বা বাড়ির পার্কিংয়ে যেতে পারেন।’ বিষয়টি মাথার মধ্যে কেন যেন দীর্ঘদিনের তরে জায়গা করে নিয়েছে। আজ এই তো সীমা চলাচলের, জীবনের! শরতের গন্ধ পাওয়া নীরব সন্ধ্যায় সুর মিলিয়ে নিজেকে মনে মনে বলি, ছাদে বা পার্কিংয়ে গিয়ে শরতের রেণু গায়ে মেখে আসতে পারেন!

‘নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ঘরে থাকুন’—এই যদি হয় বাস্তব সত্য, দ্বিধান্বিত মন বারবার বলে ওঠে, নাগরিক জীবন থেকে ছিটকে বেরিয়ে খানিক দূরে খোলা আবহাওয়ায় গিয়ে একদিন শরৎ গায়ে মেখে আসা, কাশফুলের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে কৈশোরকে কাছে থেকে দেখে আসা কি আমার নিতান্ত প্রয়োজন নয়?

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]