সোনালি স্মৃতির ঈদ

পবিত্র রমজানের রোজার শেষে আসা খুশির ঈদ আমাদের ৩০-৪০-৫০–এর দশকের কবি, লেখক ও শিল্পীদের লেখায় উঠে এসেছে নিরুপম ছবির মতো। তাঁদের ফেলে আসা জীবনের ঈদ-আনন্দের বর্ণনা ব্যক্তিগত স্মৃতিমঞ্জরি ছাপিয়ে হয়ে ওঠে সমাজ-সংস্কৃতির বিশ্বস্ত চলচ্ছবিও। এমনই কিছু আত্মজীবনীর পাতা ঘুরে সুদূর অতীতের ঈদকে ফিরে পাই নতুন করে, এখনকার ঈদে।

২.কথাশিল্পী আবু রুশদের (১৯১৯-২০১০) আত্মজীবনী জীবন ক্রমশ থেকে জানা যাচ্ছে ৪০–এর দশকে কলকাতায় ‘ঈদসংখ্যা’ প্রকাশ এবং বিতরণ উপলক্ষে ইফতার পার্টির রীতির কথা:

‘সেই সময় আজাদ কর্তৃপক্ষ ঈদের আগের দিন বেশ সমারোহ করে এক ইফতার পার্টির আয়োজন করত, যাতে প্রধানত লেখকেরাই আমন্ত্রিত হতেন। সেই উপলক্ষে আজাদ–এর ঈদসংখ্যাও লেখকদের মধ্যে বিতরিত হতো।’

এই তথ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আজকের দিনেও ঈদসংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ ঈদসংখ্যা এবং একে কেন্দ্র করে পত্রপত্রিকার ইফতার পার্টির রেওয়াজ।

ঈদের আনন্দের শুরু চাঁদ দেখার পর্ব দিয়ে। আত্মজীবনী কাল নিরবধিতে সোনালি শৈশবে ঈদের চাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার স্মৃতিঘন বিবরণ দিয়েছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (১৯৩৭-২০২০): ‘ঈদটা সত্যি ছিল আনন্দের। প্রথমেই মনে পড়ে ঈদের চাঁদ দেখার প্রতিযোগিতা। সূর্য অস্ত যেতে না যেতেই তৃষিত দৃষ্টি নিয়ে সবাই আকাশের দিকে চেয়ে থাকতাম। মনে হতো, ছাদে উঠে দেখতে পারলে আকাশের একটু কাছে পৌঁছানো যেত এবং তাতে দৃষ্টিসীমার মধ্যে চাঁদের এসে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাড়ির সামনের ফুটপাথ থেকে চাঁদ দেখা না গেলে ভাবতাম, বাড়ির পেছন দিকে রান্নাঘর বা তার কাছ থেকে তাকালে হয়তো চাঁদ দেখা যাবে।’

ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলামের (১৯২৭-২০১৮) নিবেদন ইতি বইতে আছে কলকাতার ঈদ জামাতে প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিবিদ, লেখক আবুল কালাম আজাদের ইমামতির দুর্লভ তথ্য: ‘গড়ের মাঠে তখন ঈদে নামাজ পড়াতেন, ওয়াজ করতেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ। অতীব বিরলই বটে, মওলানা আজাদের এমামতিতে ময়দানে ঈদের নামাজ আদায়ের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। পরে একসময় মুসলিম লীগঅলারা তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিল। কুৎসিত রাজনীতির কী স্থূল গণ্ডমূর্খামি!’

কলকাতার ঈদের নামাজ থেকে আসা যাক ঢাকার ঈদ নামাজে। কবি শামসুর রাহমানের (১৯২৯-২০০৬) কালের ধুলোয় লেখা বইটি ধারণ করে আছে আরমানিটোলার সিতারা মসজিদে ঈদের নামাজের অমলিন স্মৃতি: ‘সৌন্দর্যের দিক থেকে সিতারা মসজিদ ঢাকার মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। আমার ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি এই মসজিদের সঙ্গে জড়িত। এর পাথরের সৌকর্য, ভেতরের ঈষৎ শীতলতা, হৌজের রঙিন মাছের চাঞ্চল্য, আব্বার হাত ধরে জুমা ও ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া কখনো ভোলার নয়।’

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর (১৯৩২-২০১৪) স্মৃতিকথা জীবনে আমার যত আনন্দ বইতে পাই ঈদের নতুন জামা–জুতা নিয়ে চিরকালীন শৈশব-কৈশোরের আবেগের ঘ্রাণ: ‘যেদিন জামা-জুতো কেনা হতো, সেদিন রাতে ঘুম হতো না। বারবার সেগুলো দেখতাম। জুতো ছিল বিরাট আকর্ষণ। সে সময় বাটায় শিশু-কিশোরদের জন্য ‘নটি বয়’ নামে ফিতেওয়ালা জুতো পাওয়া যেত। আমার নজর ছিল সেদিকে। নতুন জুতো বাক্সে ভরে বাসায় নিয়ে আসতাম। বাবা যত্ন করে সেগুলো তুলে রাখতেন। রাতে চুপচুপ সে জুতো-জামা বালিশের তলায় রেখে ঘুমুতাম। ঘুম না আসা পর্যন্ত উল্টেপাল্টে দেখতাম, নতুন জুতোর গন্ধ শুঁকতাম। গন্ধটা ভারি মোহনীয় ছিল। আরেকটা আকর্ষণ ছিল সুগন্ধি আতরের। বাবা নানা রকম আতর পরখ করে একটি মিষ্টি গন্ধের আতর আনতেন।’

ঈদের স্মৃতি মানে ঈদের মজাদার অফুরান খাওয়াদাওয়ার স্মৃতিমধুরিমাও। কথাশিল্পী রিজিয়া রহমান (১৯৩৯-২০১৯) প্রাচীন নগরীতে যাত্রা বইয়ে বাসায় ঈদের বিশেষ রান্নার কথা বলেছেন: ‘আমাদের বাড়িতে গরুর মাংস খাওয়ার রেওয়াজ বেশি ছিল না। ঈদে বা উৎসবে কিংবা অতিথি এলে গরু-খাসির মাংস রান্না হতো।’

নাট্যজন সাঈদ আহমদের (১৯৩১-২০১০) জীবনের সাতরং বইটি ভাস্বর পুরান ঢাকার বাহারি ঈদ খাবারের বর্ণনা ও গন্ধে: ‘নামাজ পড়ে ফিরে এসে সবাই প্রথমে দুধে ভিজিয়ে রাখা সরু করে কাটা খোরমা আর সেমাইয়ের জরদা খেতাম আর কিছুক্ষণ পরই অর্থাৎ ১১টা-১২টায় দুপুরের খাওয়া সেরে ফেলতাম। মসজিদ থেকে ফেরার পথে অনেকে বাড়িতে আসতেন। সবাই একসঙ্গে এক দস্তরখানে বসে সাদা পোলাও, কোর্মা, কালিয়া খেতেন। ঈদের দিন সবাই পরিমাণে এমন রান্না করতেন যে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবাইকে খাওয়ানো সম্ভব হতো। রাত পর্যন্ত চলত মেহমানদারির পালা।’

৩. বাঙালি মুসলমানের ঈদুল ফিতর পূর্ণই হয় না নজরুলের ঈদের গান ছাড়া। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের (১৯০১-১৯৫৯) আমার শিল্পীজীবনের কথা বইয়ের পাতা উল্টে গানটির হয়ে ওঠার ইতিহাস ও স্মৃতিবয়ানেই শেষ করা যাক ঈদস্মৃতির কথকতা:

‘একদিন কাজীদাকে বললাম, ‘‘কাজীদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল—এরা উর্দু কাওয়ালি গায়, এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়। এই ধরনের বাংলায় ইসলামি গান দিলে হয় না? তারপর আপনি তো জানেন কীভাবে কাফের, কুফর ইত্যাদি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাঙ্‌ক্তেয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ! আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’’ এর প্রায় ছয় মাস পর, একদিন দুপুরে বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি অফিস থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ঘরে গিয়েছি। শুনলাম, পাশের ঘরে কাজীদা আছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজীদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজীদা বলে উঠলেন, ‘‘ইন্দু, তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সঙ্গে কাজ আছে।’’ ইন্দুবালা চলে গেলেন। এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললাম দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভেতরই লিখে ফেললেন, ‘‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’’।’

আমরাও বলি, ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ। ঈদ মোবারক।