স্মৃতিতে রাহাত খান

সম্প্রতি মারা গেছেন কথাসাহিত্যিক রাহাত খান। তাঁকে শ্রদ্ধা

আশি বছর বয়সের মৃত্যুকে অকালমৃত্যু বলা যাবে না। এরপরও রাহাত খানের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদটি আমাকে একান্ত আপনজনকে হারানোর বেদনা ও শূন্যতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত করেছে। অনেকেই জানেন, আমার দুঃসাহসী লেখকজীবন শুরুর অভিযানে রাহাত খানের ইতিবাচক ভূমিকা পালনের গল্পটা। জীবদ্দশায় তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা করে একটা ছোট লেখা লিখেছিলাম। সেই সম্পর্ক-স্মৃতির তাৎপর্য নতুন করে বুঝতে হলে নিজের ব্যর্থ লেখকজীবনের কিছু তথ্য ও ঘটনা উল্লেখ করা অপরিহার্য।

১৯৭২-এর আগস্টে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের রাজধানী ঢাকায় চলে আসি। উদ্দেশ্য স্বাবলম্বী ও বড় লেখক হওয়া।

বাল্যকাল থেকে পিতা আমাকে শহরে রেখে স্কুল-কলেজে পড়াচ্ছিলেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কি সরকারি অফিসার মার্কা মানুষ করার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু আমার কাছে কবি-লেখক কিংবা দেশপ্রেমিক রাজনীতিক হওয়াটাই সহজ রাজপথ হয়ে উঠেছিল। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নিষ্প্রয়োজন ঘোষণা করায় আমাকে স্বাবলম্বী ও স্বাধীন হওয়ার পথ খুঁজতে বলে সম্পর্ক ছেদ করলেন পিতা। এরপর পিছু ফেরার সব পথ রুদ্ধ করে ঢাকায় না এসে উপায় ছিল না আমার।

ঢাকায় টিকে থাকার পথ খুঁজতে গিয়ে দিন কয়েকের মধ্যে পকেট প্রায় খালি হয়ে আসে। সাহায্য ও আশ্রয় পাওয়ার মতো স্বজন-বন্ধু নেই একজনও। বিনে পয়সায় ঘুমানোর জন্য কমলাপুর স্টেশন, বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও বিস্তর ফুটপাত আছে বটে, কিন্তু হোটেলের খাবার দেখে ও গন্ধ শুঁকে তো পেট ভরবে না। এ রকম অবস্থায় একদিন ফুটপাতের সংবাদপত্রের দোকানে দাঁড়িয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকাটি খুলে চমকে উঠি। রাহাত খানের গল্পের সঙ্গে তাঁর ছবিও ছেপেছে। কৈশোরে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ পড়তে গিয়ে রাহাত খান নামটি পরিচিত ও প্রিয় হয়ে উঠেছিল। তার ওপর রেডিওর অনুষ্ঠানে রাহাত খানের কণ্ঠ শুনেছি, পত্রপত্রিকায় গল্পও পড়েছি। বিচিত্রায় ছাপা গল্পের শেষে লেখক পরিচিতিতে ছিল সহকারী সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক

ওই দিনই চলে গেলাম ইত্তেফাক ভবনে। দারোয়ান-পিয়নকে তাঁর নাম–পদবি বলতে দেখিয়ে দিল অফিস কক্ষ। কাঁধের ব্যাগসহ বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখা হলো আসল মানুষটির সঙ্গে।

খুব জোরালো কণ্ঠে নিজেকে একজন হবু লেখক দাবি করে ঢাকায় আগমনের উদ্দেশ্য ও চলতি ভাসমান অবস্থার কথা বললাম। অবাক হয়ে জানতে চান, বাড়ি কোথায়, কী লিখি, কে পাঠিয়েছে ইত্যাদি। সত্য কথা বললাম। রাহাত খান আমাকে পাগল-ছাগল ভাবলেন না। দরদি কণ্ঠে বললেন, স্ট্রাগল করো। পথ একটা পেয়ে যাবে। আমিও দেখব তোমার জন্য কী করা যায়। এরপর প্যাডের নিউজ প্রিন্টে বাসার ঠিকানা ৩৪৫ সেগুন বাগিচা লিখে বললেন, খিদে পেলে আপাতত দিনে আমার বাসায় গিয়ে খেয়ো।

রাহাত খানই প্রথম মানুষ ও লেখক-সাংবাদিক, যিনি আমার লেখক হওয়ার স্বপ্ন ও স্ট্রাগল করার দুঃসাহসকে স্বীকৃতি দেননি শুধু, খিদে পেটে অন্ন জোগানোর আশ্বাসও দিয়েছিলেন। পরদিন তাঁর বাসায় গেলে রাহাত ভাই লীনা ভাবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। চমৎকার হাসিখুশি নারী। ডাইনিং টেবিলে রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে খেতে দিতেন। ব্যাগটি রাহাত ভাইয়ের বাসায় রেখে নিজের পথ খুঁজতে ঢাকার রাস্তায় ঘুরি। ইত্তেফাক অফিসেও রোজ গিয়ে তাঁর টেবিলের সামনে বসে থাকি। তিনি দাদাভাই ও আর কাউকে যেন আমার বিষয়ে কথা বলেন। দিন কয়েক এভাবে কাটার পর রাহাত ভাইয়ের কক্ষের অন্য টেবিলে বসা সহকর্মী আখতার-উল-আলম আমাকে কাছে ডাকেন। তিনিও রংপুরের মানুষ। জানালেন, তাঁর আমলিগোলার বাসায় একটি রুম খালি আছে। আমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়া তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে পড়াতে পারব কি না। আমার যোগ্যতাকে রাহাত ভাই সমর্থন জোগালেন। সেই দিন রাতেই ব্যাগ নিয়ে গেলাম আলম ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বাসায়।

মাস ছয়েক ছিলাম আখতার-উল-আলমের বাসায়। লালবাগ এলাকাতেই গ্রন্থবিতান নামে একটি পাবলিক লাইব্রেরি ছিল। সেই লাইব্রেরিতে সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে পার্টটাইম কাজ পেলাম। টিউশনিও জুটল দুটো। রাতে লাইব্রেরিতে থাকি, বিস্তর পড়ার সুযোগ। এ সময়ে দ্রুত চাকরিপ্রাপ্তির আশায় বাংলা টাইপ-শর্টহ্যান্ড শিখে ফেললাম।

১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ঢোকার পর পায়ের নিচে মাটি আরও শক্ত হয়। অফিসে অনেক বিখ্যাত লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই। কিন্তু রাহাত খান আমাকে হবু লেখক হিসেবে যেমন পাত্তা দিয়েছিলেন, সে রকম সম্পর্ক হয় না কারও সঙ্গে। প্রতিষ্ঠিতদের মধ্যে নিজেকে বড় লেখক প্রমাণ করা কি এত সহজ কাজ? লেখক হতে না পারার লজ্জায় রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে দেখাও করতাম না। তবে ইত্তেফাক-এ তাঁর কলাম ও পত্রপত্রিকায় গল্প-উপন্যাস দেখলেই পড়তাম। কলাম ও গল্প-উপন্যাসে রাহাত খানের গদ্য বেশ স্মার্ট ও আকর্ষণীয় মনে হতো। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ অনিশ্চিত লোকালয়, বহুল আলোচিত গল্প ‘ইমান আলীর মৃত্যু’, বাল্যকালের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা দিলুর গল্প, উপন্যাস অমল ধবল চাকরি এবং ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত কোনো কোনো উপন্যাস পড়ে ভালো লাগে। জীবনকে দেখার নিজস্ব ভঙ্গি ও তীক্ষ্ণ সমাজসচেতনতাও প্রকাশ পেয়েছে অনেকে লেখায়।

১৯৮২ সালে প্রকাশিত আমার প্রথম বই অবিনাশী আয়োজন বের হয়। সেই ’৭২ সালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, প্রথম প্রকাশিত বই দুঃসময়ের দুই শুভার্থী রাহাত ভাই ও আলম ভাইকে উৎসর্গ করব। আমার বই পেয়ে এবং পড়ে রাহাত ভাই কতটা খুশি হয়েছিলেন জানি না। তত দিনে বামপন্থী ঘরানার কিছু লেখক-বুদ্ধিজীবী ও বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গিয়েছিল। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে থাকা অবস্থায় কালেভদ্রে দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে।

বড় লেখক হওয়ার স্বপ্ন-সাধনায় চাকুরে-জীবনে বাধা ও ব্যর্থতা জমেছিল প্রচুর। পরিণত বয়সে তাই স্বাধীন ও সার্বক্ষণিক লেখকজীবন শুরু করার জন্য ২০০১ সালে গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিটা দিলাম ছেড়ে। পেশাদার লেখক হওয়ার নতুন অভিযানের গল্প শোনাতে রাহাত ভাইয়ের অফিসে গিয়েছিলাম একদিন। তরুণ বয়সের মতো পরিণত বয়সে আমার এই দুঃসাহসী সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, আছি আমি তোমার সঙ্গে। লেখালেখি নিয়েও সেদিন অনেক কথা হয়েছিল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অধ্যাপনার চাকরি করেও দীর্ঘ সময় ও পরিকল্পনা নিয়ে মাত্র দুটি উপন্যাস—চিলেকোঠার সেপাই খোয়াবনামা লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করলেন। কিন্তু আমরা তেমন পারছি না কেন? ইত্তেফাক-এ চাকরি করেও মহাদেবদা তাঁর কবিসত্তার লালন ও চর্চায় সারা জীবন একনিষ্ঠ, কিন্তু কথাসাহিত্য নিয়ে রাহাত ভাই সে রকম নিষ্ঠাবান নয় কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আমি নিজের লেখালেখির ওপর নগদ রোজগারের দায় চাপিয়ে তাড়াহুড়া করায় বড় লেখক হওয়ার স্বপ্নসাধনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কথা বললাম। রাহাত ভাইও সেদিন পেশাগত বাধা ও নিজের দুর্বলতার কথা বলে সাহিত্যের জন্য আরও বেশি সময় দেওয়ার কথা বলেছিলেন।

চাকরি ছেড়ে সার্বক্ষণিক লেখক হওয়ার স্বপ্নসাধনা ব্যর্থ হয় বছর দুয়েকের মধ্যে। সংসার চালাতে আবারও চাকরি খুঁজি। কিন্তু ইত্তেফাক-এ রাহাত ভাইয়ের সহকর্মী হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। সে রকম একটা সুযোগ আসে একসময়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ছিল সেটা। ইত্তেফাক-এর অন্যতম কর্ণধার ও সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দেশ ত্যাগ করে আমেরিকায় গেছেন। অন্যদিকে তাঁর অগ্রজ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন। তাঁদের প্রতিনিধি ও ইত্তেফাক কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দুই ভাবির পরিচালনায় তখন ইত্তেফাক চলছে। ছোট ভাবি তথা তাসমিমা হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক অনন্যা পত্রিকায় অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছিলাম। ফলে তাঁর সঙ্গে চেনাজানার সম্পর্ক ছিল। ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় বিভাগে একজন সহকারী সম্পাদক নেওয়া হবে শুনে একটা বায়োডাটা পাঠিয়েছিলাম তাঁর কাছে। একদিন ফোন করে তাসমিমা হোসেন অফিসে ডাকলেন। কথাবার্তা হলো। দুদিনের মধ্যে পেয়ে গেলাম নিয়োগপত্র।

সম্পাদনা বিভাগে তখন সিনিয়রদের মধ্যে রাহাত ভাই, আখতার ভাই ছাড়াও হাবিবুর রহমান মিলন, কবি মহাদেব সাহা, জিয়াউল হক ও আল মুজাহিদী ছিলেন। ছোট ভাবির লোক হিসেবে আমাকে পুরোনো সবাই বেশ গুরুত্ব দিয়ে মেনে নিলেন। দেশত্যাগের পর আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দুর্নীতির মামলার আসামি হওয়ায় সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম ছাপা বন্ধ হয়। ব্যারিস্টার সাহেবের সিদ্ধান্তে রাহাত ভাই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমাদের সম্পর্কটা বেশ মধুর ও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ফাঁক পেলেই মন খুলে কথাবার্তা বলতাম। রাহাত ভাই অকপটে নিজের দুর্বলতা ও নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতেন বন্ধুর মতো। ভালো লাগত তাঁর এই সারল্য।

পরে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতাসীন হলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দেশে ফিরলেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হামলা-মামলা থেকেও মুক্ত হলেন অচিরেই। ইত্তেফাক-এর সম্পাদনাসহ তাঁর হৃত অধিকার ও কতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে বেশি দিন সময় লাগল না। ইত্তেফাক–এর চাকরি থেকে অব্যাহতি পেলেন রাহাত ভাই। এভাবে দীর্ঘ চার দশকের কর্মস্থল ত্যাগে বাধ্য হওয়ায় মনঃকষ্ট পেয়েছিলেন সন্দেহ নেই।

তরুণ বয়সে বড় লেখক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যেমন ঢাকায় এসেছিলাম, সেই স্বপ্ন নিয়ে জন্মভূমি গ্রামে ফিরে যাব এবার। গ্রামের প্রাকৃতিক নিভৃত পরিবেশে থেকে বড় লেখক হওয়ার শেষ চেষ্টা চালাব। শেষ বয়সের এই শেষ অভিযানেও যখন বিঘ্ন ও ব্যর্থতা জমছে, করোনায় আক্রান্ত বিশ্বে মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে গৃহবন্দী থেকে হতাশা বাড়ছে—এই সময়ে হঠাৎ রাহাত ভাইয়ের চিরবিদায়ের খবরটি পেয়ে নিজেকে আরও একা লাগে। সাহস ও সান্ত্বনা পাওয়ার মতো আর কোনো অগ্রজ-বন্ধুকে পাশে দেখি না বলেই হয়তো স্মৃতিতে বারবার জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর সেই সহানুভূতিমাখা কণ্ঠ—স্ট্রাগল করো, পথ একটা পেয়ে যাবে।