হররোজ

এই ভরা আষাঢ়ের রাত নয়টায় এমন আকাশ-ফুটো-হওয়া বৃষ্টি আর জোলো বাতাসের শীতেও লোকটা ঘামছে। রাস্তার মোড়ের শেষ দোকানটার আলোয় দেখলাম, বেমানান গোঁফ আর কালি-পড়া চোখের গিয়াস সাহেব দরদর করে ঘামছেন।

অস্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছাতা আর টর্চ ধরা গিয়াস সাহেব বললেন, ‘আমার বাসার দিকটায় কারেন্ট নেই মনে হচ্ছে। বৃষ্টিতে কষ্ট দিলাম...আর একটু রাস্তা কষ্ট করুন শিপলু সাহেব!’

যে গল্প শোনার জন্য এই মফস্বল শহরের স্টেশনে নেমে গিয়াস সাহেবের বাসায় যাচ্ছি, সেটার চাক্ষুষ প্রমাণ পেলে আমার কষ্ট সার্থক।’

ওই তো একতলা বাড়িটা। চারপাশ ফাঁকা। সামনের বাগানে ঝোপ-জঙ্গল।

‘সুমনাকে আমি ভালোবাসতাম না। তার বাবার টাকার জন্যই প্রেমের অভিনয় করে বিয়েটা করা। ব্যবসা দাঁড়া করানোর জন্য টাকার দরকার ছিল...’ বাগানে পা দিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন গিয়াস সাহেব।

নাড়ি ওলটানো একটা বিদঘুটে গন্ধে নাক কোঁচকালাম। শুনছি চুপচাপ।

বাসার বারান্দায় উঠে তালাটা খুলে কাঁপা গলায় গিয়াস সাহেব বললেন, ‘সুমনা আমাকে ভালোবাসত। মনেপ্রাণে। কিন্তু ওর বাবা যখন মারা যাবার সময় আমাকে কোনো টাকা দিয়ে গেলেন না...ব্যবসাটাও ভালো চলছিল না...ঝগড়া করতে গিয়ে একদিন ফুলদানিটা দিয়ে ওর মাথায় মেরে বসলাম...স্পট ডেড।’

ঘরের ভেতরে পা দিতেই তীব্র পচা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল।

‘লাশটা পুঁতে ফেললাম বাগানে। কিন্তু পরের দিন আবার হাজির হলো সুমনা। আবার মেরে ফেললাম ওকে। বাড়ির পেছনে পুঁতলাম। তার পরের দিন আবার এল ও...আবার মারলাম...আবার এল ও...প্রতিদিন আসছে...প্রতিদিন খুন করছি...লাশ রাখার আর জায়গা নেই...’ প্রলাপ বকার মতো বলে চলছেন গিয়াস সাহেব।

ঘরের ভেতরে তৃতীয় একটা ছায়া নড়ে উঠল। ঘুরে দৌড় মেরেছি আমি, পা পিছলে পড়লাম বাগানের একটা নিচু গর্তে। বজ্রপাতের আলোয় দেখলাম, পচা একটা মেয়েলি হাত উঠে এসেছে মাটি ফুঁড়ে।

ওদিকে অন্ধকার বাড়িটায় ফিসফিসিয়ে উঠল একটা নারীকণ্ঠ, ‘গিয়াস, বৃষ্টিতে ঠিকঠাক আসতে পেরেছ তো?’