হৃদয়ের প্রেমের শীর্ষ

বসন্ত যায় যায়। প্রকৃতি থেকে বিদায় নিলেও মনে বসন্তের আনাগোনা রয়েই যাবে। ফুরাবে না প্রেম। এ সংখ্যাটি প্রেমের গল্প ও কবিতার

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

সৈয়দ শামসুল হক
তুমি আজও তুমি
সে কী বিস্ময়! সেই বসন্ত! কী করে ভুলি?
অমাবস্যার রাত নাকি সেটা দীর্ঘ চুলই
পরণকথার কোনো রূপসীর! আজকাল কারও
দেখি না তো চুল দীর্ঘ এতটা—
বিস্ময় সে কী! আর সেই চুলে তারার ফোঁটা—
কত লক্ষ তা? এক লক্ষই হবে—
দাবানল লাগা বনের শিখায়
ওড়ে এক কোটি অগ্নিকণা—
আমি ভুলব না সে উন্মাদনা!
বিস্ময়ে হই এমন বিমূঢ়—
প্রান্তরে থাকি দাঁড়িয়ে মূর্তি—কাঁধের ওপরে মুড়ো
খসে পড়ে যেতে চায় প্রান্তরে—
অগ্নিকণায় চোখের তারাটি পোড়ে।
আজ এভেন্যুয়ে এসে যেই দাঁড়ালাম—
সেদিন যুবক বেলার আমাকে বললাম,
ওরে থাম!
সেই একই ছবি! অগ্নি সে একই!
আজও যে হঠাৎ দেখি—
পরণকথার রূপসী তো নয় তোমাকেই দেখে উঠি
যেন জ্যোৎস্নার মাখন মাখানো হৃদয়ের পাউরুটি!
শুধু প্রতীকের হেরফের আর
বয়স গড়িয়ে যাওয়া—
তুমি আজও তুমি! স্মৃতির খাতায়
পাতা উড়ে যায়—
মুখ পরে মুখ—তোমারই তো মুখ—বসন্ত রাত!—
কত বসন্ত এল আর গেল—বারবার ফিরে পাওয়া।

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

আসাদ চৌধুরী
প্রেমে অপ্রেমে
বাঁশি যখন প্রার্থনা করে
হু হু করে কাঁদে,
তখন কেউ তো আছে
মুখে হাসি আর
মনে তার বিপুল সন্দেহ

স্মৃতি কোনো রং নয়
সুর নিয়ে
খেলা করে শুধু
বাঁশি তুলি নয়
তুলি বাঁশি নয়...
চৈত্রের অন্তিম ক্ষণে
কোনোখানে ব্যতিক্রম নেই

দারা মাহমুদ
রাতভর শপিং মলে

রাতভর শপিং মলে কত কাণ্ডই না ঘটে
প্লাস্টিকের ডামিগুলো যখন
তাদের কারবার শুরু করে—তখন
একধরনের নিঃশব্দ শব্দ হয়
কী ভীষণ জমে ওঠে
ডামির সাথে ডামির ভালোবাসা
এসব প্লাস্টিকের নর-নারীর সঙ্গমে
জন্ম হয় নগর দম্পতির সুখ ও কষ্টের
অনেক কবিতা

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

ফারুক মাহমুদ
যখনই প্রেমের জন্ম
সামান্য শব্দের ভুল। চলে গেছ দূর থেকে আরও বেশি দূরে
ফিরে কি আসবে না আর? গভীর আড়ালগন্ধ, অন্য কিছু নয়
তোমাকে আকাঙ্ক্ষা করি—সে-ও এক স্মৃতিগল্প, চক্ষুঝরাজল
সরল প্রতীক্ষাগুলো কেঁদে ওঠে রোদনের থমকে থাকা সুরে
অবজ্ঞা দেয়ালরেখা। কেউ ভাঙে, কেউ তাতে সমর্পিত হয়
ব্যাজস্তুতি গ্রাহ্য হলে ফণা তোলে ছলনা ও শ্বাপদের ছল

বাতাসের মরা কণ্ঠ। দীর্ঘশ্বাস শুনবে বলে গল্প জেগে নেই
যে-বৃক্ষে ফুটিয়েছিলে কুসুমের সবুজের অতিদীর্ঘ হাসি
ও-পথে জটিল চিহ্ন! যারা ছিল স্বপ্নবন্ত-হারিয়েছে খেই
তবু তুমি চলে এসো! কেউ তো বলতেই পারে—‘আজও ভালোবাসি’
নদীটি নদীর সঙ্গে মেলে যদি—মিশে যায় ছন্দজলে ভেসে
যখনই প্রেমের জন্ম—মৃত্যু এসে ফিরে যায় সনির্বন্ধ হেসে

ময়ুখ চৌধুরী
দরজার কাঠ
টোকা দিলে খুলে যাবে, এ রকম দরজা সে নয়।
কাঠঠোকরা ভালোবেসে টোকা দিয়েছিল

কত লক্ষ শতবার! ঠোঁটে-বুকে রক্তপাত ঘটে গিয়েছিল।
বার্নিশে রয়েছে ঢাকা বৃক্ষজনমের ক্ষয়ক্ষতি।

টোকা দিলে খুলে যাবে, এ রকম দরজা সে নয়।

তোমার নিজস্ব ক্ষতস্থান
জামা খুলে দেখাও তাহারে।
কেননা সে দেখেছিল আরণ্যক সভ্যতার ডালে
বিবাহবিহীন ডিমে পাখিদের দাম্পত্য জীবন।

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

জাফর আহমদ রাশেদ
দু-একটি মৃত্যু
কোনো কোনো মৃত্যু দু-একটি অতিরিক্ত
পাতা ঝরিয়ে দেয়,
অযত্ন কেঁদে যাওয়ার মতো—
কোনো কোনো দিন তুমিও সঙ্গী হয়ে থাকো
ঝরাপাতাদের;
ঘাসের তিনটি ডগা ছুঁয়ে
শুয়ে থেকে
লোকদের নিয়মিত ব্যস্ততা দেখো
আর দু-একজন তরুণ-তরুণীর
অযথা নিঃস্ব নিঃসঙ্গতা—

আলতাফ হোসেন
যাওয়া-আসা
বড় বড় শহরগুলো কী করে কী করে দেখা হয়ে গেলে
আমার খুব ঘুম পায় অথচ ঘুমাতে
পারি না
কেউ একজন আমাদের শহরের, বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে
আসুন’
উড়ে উড়ে চলে যাই
দু-বছর বা তার বেশি সময় পর উনি বলেন, ‘কই এলেন না’
বলি, ‘নিশ্চয় যাব’
যাওয়া-আসার ব্যাপারটা সত্যি কেমন অগোচরেই
ঘটে যেতে থাকে
বিলকুল

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

কামরুজ্জামান কামু
ও কোকিল, ডাকো ক্যান
ওকি নীল ওকি লাল
এ কেমন বেসামাল
ফোটে ফুল আমি তাই
হে বসন্তকে চাই
চলো যাই মধুপুর
ওগো রেলগাড়ি ধায়
মম প্রেম মম প্রেম
বলো প্রেম কে না চায়
কোকিলের মতো এক
পাখি অই ডাকে সেই 

অকারণ সুরে তার
বিকেলেই বিকেলেই

সে তোমার কে তোমার
ও কোকিল, ডাকো ক্যান?
ফুলে ফুল ছোঁয়াতেই
কেন লাল হলো গাল?

বেসামাল বেসামাল
ফুলে লাল দুনিয়ার
পাশে আজ দুজনের
খুলি হাল তুলি পাল

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

তারিক টুকু
যোগাযোগ
বুঝিনি সবুজ ডানা, তার মেলে ধরা রাত্রিখানি
কীভাবে অব্যক্ত হয়ে আছে তোমার ভেতর, চুপে!
সে রাহুর দিকে গড়িয়ে গেল না কেন ভাবি।
শেকড়ের দিকে মাথানত লতারা, তারাও কি
বেগুনি নক্ষত্র গর্ভে ধ্যানমগ্নতার প্রতিচ্ছবি গড়ে তুলছে!
আর আমরা, পৃথিবীর দুই কূলে থেকে
একই গানের সুরে দুরকম শান্তি নিয়ে ফিরি

আহমেদ মুনির
পরস্পর
আমাদের দেখা হয়নি কোথাও। না ঘুমে, না জাগরণে। না উল্লাসে, না ভয়ে। ঘরে বা ট্রেনের কামরায়। তবু সামনে ওই দাঁতরাঙার ঝোপ, উঁইঢিবি। তার চারপাশে আমাদের স্মৃতিকণা, মুহূর্তবিন্দু জমা হয়ে আছে।
আমাদের দেখা হবে না কখনো। না রাস্তায়, না রেস্তোরাঁয়। আকাশে বা পাতালে। হাসপাতালে। দেখা হবে না আমাদের। তবু নীরবতা একটা রুদ্রপলাশ হয়ে ফুটে আছে। তার পাপড়ি ঢেকে দিচ্ছে সমস্ত শরীর।

রাসেল আহমেদ
প্ররোচনা
মাথার ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে যে সেতু ঝিনাইদহের দিকে—তার নিচে শুয়ে শুয়ে কাছিমের বিতণ্ডা শুনি। কেউ একজন প্রশ্ন করে, দুই চোখ আলাদা, তবু তারা একসঙ্গে কেন কাঁদে...আমি বরং প্রতিপ্রশ্ন করি তাকে, বিখ্যাত সেই খরগোশের ঘুমের ভেতরে তুমিই কি ছুটে এসেছিলে—তুমিই কি আটক রেখেছিলে তাকে অনন্তকাল মৃত্যুর ফেরেশতার সামনে উড়ে আসা অনুজ্জ্বল জলপাই পাতায়?

আনন্দ উৎসারের আগে জেনে নিতে পারো এই তুমুল সত্য—তোমাদের যে কেউ—যার বেদনার ভারে মেঘ থেকে মর্ত্যে নেমে এসেছিল নমরুদের একজোড়া প্ররোচিত পাখি, আমি সেই বিশেষ ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট বিষাদ।