'এখনো ভাষা খুঁজে চলেছি' : জয় গোস্বামী

কিছুদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চট্টগ্রামে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী। সে সময় প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন নিজের লেখালিখি, কথাসাহিত্য-চর্চাসহ নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমেদ মুনির

জয় গোস্বামী। ছবি: জুয়েল শীল
জয় গোস্বামী। ছবি: জুয়েল শীল

আহমেদ মুনির: চট্টগ্রামে প্রথম এলেন, এখানে আপনার অনেক পাঠক। কেমন লাগছে?
জয় গোস্বামী: একবার ঢাকায় একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাই। যানজটের কারণে অনেক দেরিতে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে দেখি, তখনো প্রচুর দর্শক। তাঁরা আমার কথা শুনবেন বলে বসেছিলেন। এসব আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তবে জনপ্রিয়তা নিয়ে আমি ভাবি না। যাঁরা লেখেন, তাঁরা আমার আত্মীয়পরিজন। কবিতা আমার সংসার। ‘গোসাই বাগান’ নামে কবিতা নিয়ে আমার নানা ভাবনা ২০ বছর ধরে টানা লিখেছি। এরপর লেখা বন্ধ করে দিয়েছি। তবে আবার লিখলে বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে লিখব।
মুনির: ‘আমার দোতারা’ নামে কবিতায় ‘সুর তো ফকির’ এমন পঙ্‌ক্তি রচনা করেছেন আপনি। আপনার কবিতায় সাধারণের মুখের কথা অনায়াসে এসে জুড়ে বসছে অদেখা দৃশ্যকল্পের সঙ্গে। এমন অসাধারণ নির্মাণ কি সহজাত না চেষ্টাকৃত?
জয়: ভাই, তুমি যেমনটি ভাবছ তেমনটি আমি কখনো ভাবিনি। আমি সত্যি তেমন কিছু করিনি। আমার এখনো ভীষণ হতাশ লাগে। আমার তো মনে হয় যা ভাবি, যা প্রকাশ করতে চাই, লেখায় তা আসে না। আমি এখনো নিজের ভাষা খুঁজে চলেছি।
মুনির: এটা কি আপনার বিনয়? নাকি বিনয়ের আড়ালে সমালোচনা এড়ানোর বর্মবিশেষ?
জয়: একষট্টি বছর বয়সে বিনয় করার বা বানিয়ে বলার অবকাশ নেই। লিখতে লিখতে এখনো এত অনিশ্চয়তা ভর করে, আমি জানি না লেখা কোথায় গিয়ে শেষ হবে। আমার নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনের কবিতা নির্বাচনের ভারও আরেকজনের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। নিজের ওপর রাখিনি।
মুনির: কবিরা অবিনয়ী, অহংকারী হন—এমন অভিযোগ অনেকের। আপনি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তা ছাড়া এত দীর্ঘ সময় সৃজনশীল কাজ করছেন, নিজের মতামত প্রকাশে ‘অডাসিটি’ দেখান না কেন?

জয়: কেউ যদি বলেন, আমি কবিতা বুঝেছি, অথবা এটাই কবিতার ধরন, এভাবে লিখতে হবে, তবে সেটা বলার তাঁর অধিকার আছে। আমি সে রকম কেন বলব? আমি সত্যিই কম জানি। আমি কি স্টিফেন হকিংয়ের সব সূত্রের অর্থ জানি? বিটোফেনের সব সিম্ফনি রচনার কৌশল সম্পর্কে বলতে পারব? আমি যা জানি সেটাই বলব। আমার অডাসিটি নেই। আমি অন্যের কবিতার রসাস্বাদনের চেষ্টা করি। কিন্তু যাঁরা আত্মবিশ্বাসী, তাঁরাও সঠিক। তাঁরা তাঁদের মতো করে ভাবেন।

মুনির: আপনাকে প্রভাবিত করেছেন—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া এমন দুজন কবির কথা বলুন।

জয়: সে রকম করে বলতে গেলে আমার বিশেষ কোনো একজন প্রিয় কবি নেই। আমার চোখের সমস্যা। পড়তে পারি কম। কিন্তু যখন পড়তে পারতাম, তখন প্রচুর পড়েছি। প্রত্যেক কবির ভালো কবিতাগুলো গ্রহণ করেছি। আর যেসব ভালো মনে হয়নি, সেসব গ্রহণ করিনি। কিন্তু কবিতার বিচার করতে যাইনি। আমার ৩৭টা বই আছে। এক বাক্যে কী করে বলা যায় আমি কেমন? যেমন অনেকেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শেষের দিকের রচনাগুলো নিয়ে বলেছেন, ‘শক্তির এসব কিছু হচ্ছে না। এখানে নতুন কী আছে?’ আমি এভাবে বলি না। এভাবে ভাবিও না।

মুনির: আপনার কবিতায় বিপন্নতা আর বিস্ময় হাত ধরাধরি করে চলে। ‘সৎকারগাঁথা’ কবিতাটি তার ভালো উদাহরণ...

জয়: আমার জীবনটাই যে এমন। তরুণ বয়সে অভাবে কেটেছে। ট্রামে-বাসে চড়তে হতো। তখন আমার অনেক কবিতা কলমে রচিত হয়নি। এগুলো মাথার ভেতরে রচিত হয়েছে। উন্মাদের পাঠক্রম, সূর্যপোড়া ছাইমৌতাত মহেশ্বর কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো আমি লিখেছি মনে মনে। বাসে, ট্রামে আর ট্রেনে চড়তে চড়তে।

মুনির: মনে মনে কবিতা তো লেখাই হয়, একটা লেখা হয়ে গেলে সেটা অনেকে কাগজে লিখে নেন। কিন্তু এভাবে আপনি সর্বোচ্চ কয়টা কবিতা মনে মনে লিখেছেন?

জয়: বললাম না, ওই যে তিনটে বইয়ের সবগুলো কবিতা। ধরো পাঁচ-ছয়টা কবিতা মনে মনে লেখা হয়ে গেল। এরপর সে সব কাগজে লিখছি একসঙ্গে। ‘পাগলি তোমার সঙ্গে’ও মনে মনে লেখা। আর সূর্যপোড়া ছাই বইয়ের কবিতাগুলোতে দেখবে দুই লাইন পরপর স্পেস পড়েছে। ট্রামে চড়তে চড়তে লেখা হয়েছে বলে এমন বিন্যাস দাঁড়িয়েছে। একটু বুঝিয়ে বলি, কলকাতায় ট্রাম কিছুদূর গিয়ে থেমে যায়। তো যতক্ষণ ট্রাম চলত, ততক্ষণ কয়েকটা লাইন ভাবতে পারতাম আমি। ট্রাম যখন ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে যেত, তখন ভাবনায় ছেদ পড়ত। তাই কবিতাগুলোতেও সেই ছেদ, স্পেস চলে এসেছে। আসলে জীবনযাপনের ভেতরেই কবিতা রচনার রহস্য লুকিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে কোনো বড় দর্শন বা ভাবনা নেই। আমার অভিজ্ঞতায় যা ধরা পড়েছে ত-ই আমি লিখেছি।

মুনির: জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, শঙ্খ ঘোষ মিলে বাংলা কবিতার একটা ধারা তৈরি হয়েছে। আপনি কোন বিশেষ ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন?

জয়: বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে বেঁচে থাকা একটা মডেল অনুযায়ী হয়। আসলে তা নয়। জীবনের ভেতরের দিকটা, অন্তরটা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা। শক্তি, বিনয়, আল মাহমুদ প্রত্যেকেই পৃথক। কোনো একটা মডেলে তাঁরা লেখেননি। আসলে এমন কোনো মডেল হয় না কবিতা লেখার ক্ষেত্রে।আর আমার মনে হয়, বাংলা কবিতা পাঁচ হাজার পাঠক ও সমালোচক নিয়ে চলছে। কিন্তু এই গণ্ডির বাইরে রয়েছেন যাঁরা, তাঁরাই আমার কবিতার উপলক্ষ। তাঁদের নিয়েই আমার কবিতার সংসার। বুদ্ধিজীবী বা সাহিত্যের প্রহরীদের অনেক বিচার থাকে, তা তাঁরা করবেনও। কিন্তু আমার কাজ তাঁদের নিয়ে নয়।

মুনির: সে ক্ষেত্রে আপনার কবিতা নির্মাণের বিশেষ কোনো পদ্ধতি আছে কি?

জয়: একটা কবিতা কীভাবে রচিত হয় বা এসে ধরা দেয়, সেটা আসলে বলে বোঝানো যাবে না। এটা লিখেও তুমি স্পষ্ট করতে পারবে না। কবিতার একটা মন আছে। সেই মনটা যখন ধরা দিতে থাকে ভেতরে, তখন আমি একটু একটু করে তাকে বুঝতে চেষ্টা করি। তাকে পড়তে চেষ্টা করি। কবিতার মনটাকে আমি স্পর্শ করার চেষ্টা করি।

মুনির:হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ বইতে একটা ঘটনা আছে। একটি অন্ধ ছেলের কথা লিখতে গিয়ে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন। এসব ছোটখাটো অভিজ্ঞতা আপনার কবিতায়ও এসেছে।

জয়: হ্যাঁ, ওই যে বললাম আমার জীবনটা ছিন্নভিন্ন বলেই কোথাও ভালোবাসা দেখলে আমি আবেগে আক্রান্ত হই।

মুনির: একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আপনি উপন্যাস লিখতে চাননি। পেশাগত কারণে গদ্য লিখেছেন।

জয়: কিছু ভাব আছে যা কাব্যে প্রকাশিত হয়, কিছু গদ্যে। তাই গদ্য আমাকে লিখতেই হতো। এটা ঠিক যে শুরুটা করতে হয়েছে পেশাগত কারণে। কিন্তু পরে নিজ থেকেই গোসাই বাগানসহ বিভিন্ন লেখা লিখেছি। এসবের মধ্যে জয়ের শঙ্খ, জয়ের শক্তি—এই বইগুলো আছে। যাঁরা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেননি, তাঁদের অনেকেই বিষয়টা তলিয়ে না দেখেই এটাকে দাসত্ব বলেন। কিন্তু আমি বলব, প্রতিষ্ঠানে থাকার কারণে আমাকে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে। তুমি যে শুরুতে ‘আমার দোতারা’ কবিতাটির কথা বললে, সেটাও কিন্তু তথাকথিত একটা ফরমায়েশি লেখা। ড. সুধীর চক্রবর্তী তাঁর ধ্রুবপদ পত্রিকার বাউল সংখ্যার জন্য আমাকে একটা কবিতা দিতে বলেছিলেন। সেই কবিতা খুব তাড়াহুড়ো করে এক রাতের মধ্যেই লিখতে হয়েছিল। তা ছাড়া আমার আরেকটি পাঠকপ্রিয় কবিতা ‘মা নিষাদ’ লিখতে হয়েছিল প্রতিষ্ঠানের তাগাদায়। পোখরানে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে একটা কিছু লিখে দিতে বলা হয়েছিল। তখন এই কবিতা লেখা হয়।

মুনির: শঙ্খ, জয়—এঁরা চলে যাওয়ার পর বাংলা কবিতার একটা অধ্যায় কি শেষ হয়ে যাবে?

(প্রশ্নটা শুনেই ‘একটু বসো’—বলে উঠে গেলেন জয় গোস্বামী। চট্টগ্রামে যে বাসায় তিনি উঠেছিলেন, সেখানে তাঁর শোবার ঘর থেকে হাতে করে নিয়ে এলেন কয়েকটা বই। টেবিলে ছড়িয়ে রাখার পর দেখা গেল আট পৃষ্ঠার ছোট ছোট কবিতার বই।)

জয়: এগুলো সব তরুণদের কবিতার বই। আমি আর আমার স্ত্রী কাবেরী মিলে বের করেছি। আট পৃষ্ঠার এ বইগুলোর প্রচ্ছদ ও লেটারিং আমার করা। তাহলে বুঝতেই পারছ, আমি কেবল তরুণদের সঙ্গে মিশি না, তঁাদের লেখাও পড়ি। এখনকার অনেক তরুণ ভালো লেখেন। আমার বিশ্বাস, তরুণদের হাত ধরেই বাংলা কবিতা আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।