'পুছে লাল পুছে লাল ইয়া পুছে লাল'

মার্কুলি গ্রামে তালুকদার বিবির গৃহ প্রাঙ্গণে জারি পরিবেশনকারী নারীরা
মার্কুলি গ্রামে তালুকদার বিবির গৃহ প্রাঙ্গণে জারি পরিবেশনকারী নারীরা

সমুদ্রের আবেগের মতো হাওরের বিস্তার আগে দেখিনি। এবার সেই কূলহারা হাওরের টলটলে ও প্রশান্ত জলরাশিকে অতিক্রম করে ছুটে চলেছি তেতৈয়া আর মার্কুলি গ্রামের দিকে। এ অঞ্চল কতটা দুর্গম—সে সম্পর্কে কোনো পূর্বাভিজ্ঞতা ছিল না, ভাগ্যিস সঙ্গে এসে জুটেছিলেন ভাবসাধক সোনাফর শাহ ও ভাবুক-কবি নজরুল রানা। মূলত তাঁদের ইশারায় টুকচানপুর ঘাটে নেমেই সাক্ষাৎ পেলাম স্থানীয় দুই প্রবীণের, মুহূর্তের মধ্যেই তাঁরা আমাদের ঠেলে দিলেন মহররমের ভাবজগতের গভীরে। সহসা তাই হেঁটে এগোলাম তেতৈয়া গ্রামের রফিক মিয়া ও কদর মিয়ার বাড়ির উদ্দেশে। কুশিয়ারা নদীর পাড় ধরে তেতৈয়া গ্রামের পথ।
তেতৈয়া গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে দূর থেকে জারির সুর ভেসে এল কানে। সেই সুর অনুসরণ করে সামনে এগোতেই দেখতে পেলাম সুরের উৎস—যেখান থেকে ভেসে আসছে সুর, সেই বাড়িটি জলের ভেতর জেগে ওঠা দ্বীপের মতো একটি ভূখণ্ডের ওপর ভাসমান। হ্যাঁ, কাদামাখা পথে হেঁটে, বাঁশের দুটি একপেয়ে সাঁকো পাড়ি দিয়ে অতঃপর জারি-সুরের উৎসে পৌঁছাতে সক্ষম হলাম আমরা।
নানা গাছগাছালির ভেতরে এক সাধারণ বাড়ির উঠানের মাঝখানে পাটি বিছিয়ে নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে চলছে মহররমের জারি পরিবেশন। বয়সের ভেদ নেই সে আসরে। শিশু-কিশোর থেকে বয়স্ক—সবাই এক হয়ে দুই হাত বুকে আঘাত করে গেয়ে চলেছেন, ‘আল্লাহ কইও কইও খবর হুসনজির আগে হাজারও সালাম/আল্লাহ কে তোরে আনিয়া তিরবালা লাগাইয়া মারিল ইমাম/আল্লাহ নূরের মুকাম সাজাইয়া দিলাম মদিনা শহর।’—এভাবে বারবার ঘুরে ঘুরে একই চরণ গীত করার মাধ্যমে যেন মহররমের আহাজারি দিকে দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন আসরের মানুষজন। আর এক একটি জারির শেষে অনেকটা জিকিরের মতো তাঁরা বলছেন, ‘আল্লাহু আল্লাহু ইয়া হুসেন ইয়া হুসেন ইয়া হুসেন/লা ইলাহা ইল্লাহ।’

তেতৈয়া গ্রামে কদর মিয়ার বাড়িতে নারীদের জারি-মাতম
তেতৈয়া গ্রামে কদর মিয়ার বাড়িতে নারীদের জারি-মাতম

রফিক মিয়ার বাড়ির উঠানের একপাশে বাঁশ, সোলা, নানা রঙের কাগজ, পাটের আঁশ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি দুলদুল ঘোড়া দেখা গেল। রফিক নিজেই তৈরি করেছেন ঘোড়াটি। দুলদুলটি রাখা হয়েছে পাঞ্জাতনের মুকামের (মোকাম) সামনে। এই মুকাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে রফিক মিয়া বললেন চমকপ্রদ এক গল্প: ১২ বছর আগে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এক পিরের শরণ নেন রফিক। এ সময় বাড়িতে ইমাম হাসান-ইমাম হোসেনের মুকামও তৈরি করেন তিনি। পাঞ্জাতনের একটি আসন দেন সেই মুকামে। প্রতিবছর মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন এখানে আয়োজিত হয় জারি মার্সিয়া। মুকামের খাদেম হলেন রফিকের স্ত্রী দিলারা বেগম। মহররমের প্রথম ১০ দিন তিনি রোজা রাখেন, ঘুমানোর জন্য কোনো বালিশ ব্যবহার করতে পারেন না, শয্যা নিতে হয় পাটকাঠির ওপর, মহররমের সময় মাছ-মাংসও খেতে পারেন না তিনি, খেতে হয় নিরামিষ, প্রতিদিন পাঞ্জাতনের মুকামে এই নারীই প্রজ্বালন করেন মোমবাতি ও আগরবাতি।
রফিক মিয়ার বাড়ি থেকে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে কদর মিয়ার বাড়ি। সে বাড়িতে আছে আরেকটি মুকাম। কদর মিয়ার স্ত্রী আয়েশা বিবি সেই মুকামের খাদেম। তিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন নিজের মুকামের সামনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, তখন জুম্মার নামাজের বিরতি চলছিল। নামাজ শেষ হতেই গ্রামের বয়স্ক নারীরা একে একে জড়ো হলেন মুকামের সামনে। জারি গেয়ে দুই হাত দিয়ে বুকে আঘাত করে তাঁরা প্রকাশ করলেন কারবালার বেদনা। তবে এ বাড়িতে, দ্বিতীয় এই জারির আসরে দেখলাম, অংশ নিচ্ছেন কেবল নারীরাই। তাঁদের পরিবেশিত একটি জারি এমন: ‘আল্লাহ হায় হায় গো আমরা মুসলিমের নন্দন/আল্লাহ কি গুনা কইরায়াছি আল্লাহ বালকও দুইজন/আল্লাহ বেগোনা হইয়া কান্দে আল্লাহ মুসলিমের নন্দন/...আল্লাহ সারা রাত কাটাইলাম আমরা গাছেরও তলায়/আল্লাহ হাতে ধরি পায়ে পড়ি মাইরো না আমরারে/আল্লাহ মদিনা যাইতাম আমরা নানাজির রওজারে/আল্লাহ হারিসের দাসী ধরে বরিবারে দল/গাছের ছায়ায় দেখে বালকও দুইজন।’ এই জারির শেষাংশেও ‘ইয়া হুসেন ইয়া হুসেন ইয়া হুসেন’ বলে মাতম করতে দেখা যায়।
এ বাড়িতে মহররম উদ্যাপন ও জারি পরিবেশন সম্পর্কে খাদেম আয়েশা বিবি জানান, তাঁর ছেলের ঘরের প্রথম তিন নাতির মৃত্যু হলে তিনি মানত করেন, এরপর জন্ম নিয়ে তাঁর নাতি যদি সুস্থভাবে বেঁচে থাকে, তবে ইমাম হাসান-হোসেনের নামে পাঞ্জাতনের মুকাম দেবেন তিনি। তো, এবার সুস্থভাবে বেঁচে গেল আয়েশা বিবির নাতি। তখন থেকেই তিনি এই মুকাম দেন এবং প্রতিবছর মহররমে একটি দুলদুল তৈরি করে পরিবেশন করেন জারি।
এই এলাকায় মহররমের কৃত্যাচারে নারীদের অংশগ্রহণ বেশ আগ্রহ-জাগানিয়া, এটি আগেই জানতাম; এমনকি তেতৈয়া গ্রামে পরিবেশনাগুলো দেখে বিষয়টি বুঝেছিও বটে। ফলে এ যাত্রায় মার্কুলি গ্রামে গিয়ে দেখতে চাই, সেখানেও মহররমের কৃত্যাচারে নারীর এত প্রাধান্য আছে কি না?
কিন্তু মার্কুলির পথ খুব সহজ নয়, কুশিয়ারা নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হয় একটানা প্রায় দুই ঘণ্টা, গ্রামের ভেতরের রাস্তা ধরে পার হতে হয় গোটা দশেক একপেয়ে বাঁশের সাঁকো, কোথাও কোথাও জলবিচ্ছিন্ন পথের বাধা অতিক্রম করতে ছোট নৌকার ব্যবহারও আছে।
এসব অতিক্রম করে মার্কুলি যখন পৌঁছালাম, মনে হলো, এ গ্রামের প্রতিটি বাড়ি যেন এক একটি ছোট্ট দ্বীপ। কেননা, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাতায়াতের মাধ্যম হলো ছোট নৌকা অথবা একপেয়ে বাঁশের সাঁকো। তবে লক্ষ করলাম, এখানকার শিশুরা খুব সাহসী এবং প্রায় সবাই-ই নৌকা চালাতে সক্ষম।
মার্কুলিতে গিয়ে প্রথমেই দেখলাম, বিভিন্ন বাড়িতে বানিয়ে রাখা হয়েছে এক বা একাধিক দুলদুল ঘোড়া। কথায় কথায় জানা গেল, জারি গাইতে গাইতে সেগুলো নিয়ে রাতের মধ্যেই পৌঁছে দেওয়া হবে মুকামে। মানতের দুলদুল ঘোড়া সাধারণত গৃহস্বামীরা নিজেরাই তৈরি করেন—মার্কুলির দক্ষিণ পাড়ের কাজল ও সহিদুল মিয়ার কাছ থেকে জানা গেল এমন তথ্য।
সব দেখেশুনে যে সময় আমরা মার্কুলি গ্রামের পাঞ্জাতনের মুকামে পৌঁছেছি, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। মুকামের খাদেম তালুকদার বিবি ও তাঁর মেয়ে ভাগ্য বিবির নেতৃত্বে সেখানে চলছে জারির মাতম, ‘আল্লাহ হায়দারে হায়দারে হায়দারে ইমান/নবীজির পিয়ারার নাতি ফাতেমার পরান/হায়রে নাতি জীবের ধন কে নিল কাড়িয়া...।’
রাতভর জারি ও মাতম চলে এই মুকামে। এই জারি কখনো পরিবেশন করেন শুধুই নারীরা, কখনো পুরুষেরা। তবে এখানে নারীদের প্রাধান্যই চোখে পড়ে বেশি।
জানা গেল, মার্কুলি গ্রামে মহররমের জারি-মাতমের পুনর্জাগরণ চলছে এখন। এর ইতিহাস সম্পর্কে ভাবসাধক আবদুল আওয়াল মিয়ার ভাষ্য, ‘এই গ্রামে একটা যুবক পার্টি আছে। এই যে কালকে রাতে যেসব লোক জারি গাইছে, এরা যুবক পার্টি, বুচ্ছেন? এরার আগ্রহ থিকা আইছে মুরব্বির আগ্রহটা। মুরব্বিরা বইলছে, আগের আমলে আমরার মুরব্বিরা করত, কিন্তু আমরার তো আর সেই শরীলটা রইছে না, আর সেই বয়সও রইছে না, আমরা করতাম পারতাম না। তুমরা যদি পারো ধইরে রাকো, যদি না পারো ধইরে রাইক্কো না, এইডা তুমরার ইচ্ছা। ইয়ং বয়সের ছেলেরা কইছে, আমরা আপনারার যেইটা করুছুন, সেইডা ধইরে রাখতাম। তখন তারা যেভাবেই হোক দুক্ক-কষ্ট কইরা শিকছে, শিক্কে এভাবে এখন করছে, এখন মুরব্বিরাও যুবকদের সাথে যোগ হইছে। কাল রাতে যেই রকম দেখছেন, ঠিক এমন করে আগের আমলের মুরব্বিরা করত। যেমন আমার আব্বার আগের আমলে—দাদার আমলে এইভাবে কইরে গেছে। ওই যে ঠ্যাঙ্গা শাহ ফকিরের কথা শুনছেন না? উনি আমার আপন চাচা। সারা গ্রামের হাদী আছলা ঠ্যাঙ্গা শাহ ফকির। উনি উর্দু জারি কইত, নারগি (নাগরি) জারি কইত, ফারসি জারি কইত, হিন্দি জারি কইত, বাংলা জারি কইত—উনি পাঁচ পদের জারি জানতেন। উনার ছেলে কালকে একটা উর্দু জারি গাইছে, ওই যে—‘‘পুছে লাল পুছে লাল ইয়া পুছে লাল কাকে বলে/ডংকা বাজাও হে ইয়া নবী ফেরুয়ার রণ কুছালে। গেছে গারি হাম্বা ময়না হামারা। হায় হায়দার।’’ এগুলো কিছু কিছু কথা আছে উর্দু, নারগি, কিছু কিছু কথা আছে বাংলায়—উর্দু-নারগি মিশাইয়া ঠ্যাঙ্গা শাহ ফকিরে জারি বলত। উনি দুনিয়া ত্যাগ কইরা যাওয়ার পরে দু-একজন আছে, উনার এক ছেলে আছে, এক নাতি লাগে সম্পর্কে, তারা এইভাবে জিনিসটা ধইরা রাখছে, আমি নিজেও কই এগুলা, বুচ্ছেননি।’
আবদুল আওয়াল মিয়ার এই কথাগুলো বাংলাদেশের একটি দুর্গম প্রান্তিক অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি-প্রেম, ভাষা ও ভাব চর্চার ঐতিহ্যিক পরম্পরা সম্পর্কে নানা তথ্য দেয় আমাদের। অতএব, প্রণাম জানাই আওয়াল ভাইকে, আর তা শুধু এই অধমকে আতিথেয়তা দেওয়ার জন্য নয়, বরং সিদ্ধির আসরে বসেও অসাধারণভাবে সৃজনশীল জ্ঞানের সহজ পাঠটি আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য।
একই সঙ্গে কৃতজ্ঞতা তেতৈয়া-মার্কুলি গ্রামের সেই নারীদের, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও যাঁরা ধরে রেখেছেন কৃত্য-সংস্কৃতির অকৃত্রিম ঐতিহ্য। সুনামগঞ্জের এ অঞ্চলে এসে আমরা দেখলাম এক অন্য রূপ: পুরুষের চেয়ে নারীরাই বরং অধিক মমতায় সমাজে গ্রথিত রেখেছেন মহররমের আবেগ—যখন জারিসহযোগে বাঁশ ও কাগজের তৈরি দুলদুল ঘোড়া নিয়ে নানা বয়সী পুরুষেরা এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে বিহার করেন, তখনো তো দেখি নারীরাই দুলদুলের সামনের পা দুটি ধুয়ে দেন, এমনকি ভ্রাম্যমাণ ভক্তদের জন্য খিচুড়িভাতের সিরনি বা চাল, ডাল, তরকারি প্রভৃতি উপহার দেন; আবার কখনো-বা কোনো নারী আকস্মিকভাবে জল ছিটিয়ে দেন জারির ভ্রাম্যমাণ পরিবেশনকারীর শরীরে। আর সহসা তাতে যেন কারবালার জলতৃষ্ণা পূর্ণতা পেয়ে যায় বাংলাদেশের গ্রামীণজীবনের মহররমের ভেতরে। এভাবেই ইতিহাস, সময় ও ভূখণ্ডের ভেদরেখা লুপ্ত হয়ে সংস্কৃতি সহজ মিশ্রণ ঘটে, যেভাবে ঘটেছে তেতৈয়া ও মার্কুলি গ্রামে।