রক্তের ক্যানসার নিয়ে ভুল ধারণা বেশি

সুরজীৎ সরকার

ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া বা সিএমএল রক্তের বিশেষ এক ধরনের ক্যানসার। মানুষের বংশগতির বাহক ক্রোমোসোমের ৯ ও ২২ নম্বরের মধ্যে বিনিময়জনিত পরিবর্তনের কারণে এই রোগের উৎপত্তি।

আজ বুধবার বিশ্ব সিএমএল সচেতনতা দিবস। পৃথিবীতে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ নতুন করে এই রোগে আক্রান্ত হন। তবে চিকিৎসায় আধুনিক ওষুধ ব্যবহারের কারণে রোগটি এখন রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এ দিবসে রক্তের ক্যানসার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

ক্যানসার কোনো একক অসুখের নাম নয়। এটা রোগের একটা গ্রুপের নাম। শরীরের যেকোনো স্থানে, যেখানেই কোষ আছে সেখানেই ক্যানসার হতে পারে। জিনগত পরিবর্তনের কারণে কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধিই ক্যানসার। ২০১৮ সালে পৃথিবীতে ক্যানসারের কারণে প্রায় ৯৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে ২০২০ সালে ক্যানসারে ১ লাখ ৯ হাজার মানুষ মারা গেছেন।

ক্যানসারগুলোকে হেমাটোলজিক্যাল ও নন-হেমাটোলজিক্যাল; এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যদিও আরও অনেক ভাবেই ভাগ করা যায়। হেমাটোলজিক্যাল বা রক্তের ক্যানসার বলতে আমরা বুঝি রক্তের কোষ থেকে যেসব ক্যানসার উৎপন্ন হয়।

রক্তের ক্যানসার কেন হয় তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে অনুমান করা হয় নানা ধরনের সংক্রমণ, রাসায়নিক ও কীটনাশকের সংস্পর্শে আসা, বিকিরণ এবং ধূমপানের মতো কিছু বিষয়ের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা থাকতেও পারে। দেশে এ নিয়ে বড় আঙ্গিকে গবেষণা হয়নি বললেই চলে।

রক্তের ক্যানসার নিয়ে মানুষের ভ্রান্ত ধারণাই বেশি। বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, ক্যানসার মানেই মৃত্যু। কাজেই চিকিৎসায় অর্থ আর শ্রম ব্যয় করে কী লাভ। এতে রোগী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অথচ জানলে অবাক হবেন এমন রক্তের ক্যানসার আছে, যা প্রায় শতভাগ ভালো হয়। রোগীর বয়স যত কম, সেরে ওঠার হার তত বেড়ে যায়।

রক্তের ক্যানসারের চিকিৎসায় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। তবে উন্নত বিশ্বের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। আমাদের রোগ চিকিৎসার সক্ষমতা আছে, সঠিকভাবে নির্ণয় করার সক্ষমতা কম।

চিকিৎসকদের মধ্যে যাঁরা ক্যানসার চিকিৎসা করেন তাঁরা অনকোলজিস্ট। আর যাঁরা শুধু রক্তের ক্যানসারের চিকিৎসা করেন তাঁরা হেমাটোলজিস্ট। দেশে কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হেমাটোলজিস্ট চিকিৎসাব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছেন। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় সংখ্যা এখনো নিতান্তই নগণ্য।

দেশে দক্ষ হেমাটোপ্যাথলজিস্টের খুবই অভাব। এ ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেকটাই পার্শ্ববর্তী দেশের ওপর নির্ভরশীল। যদিও এগুলো নিয়ে এখন উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে। দক্ষ নার্স ও দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অভাবও প্রকট।

ব্লাড ক্যানসার চিকিৎসায় শিরাপথে কেমোথেরাপি দিতে উন্নত বিশ্বে কেমোপোর্ট ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশেও দু-একজন কাজটি করছেন, কিন্তু তা যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। সার্বিকভাবে রক্তের ক্যানসারের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। এ জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। এই সুবিধা বিভাগীয় শহরে ও গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরে সম্প্রসারিত করতে হবে।

কেন্দ্রীয়ভাবে ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ হিসেবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেমাটোলজি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তা চিকিৎসা ও গবেষণায় বড় ভূমিকা রাখতে পারত।

রক্তের ক্যানসারের ওষুধ তখন আমদানি করতে হতো। দাম ছিল আকাশছোঁয়া। এখন বেশির ভাগ ওষুধ দেশে তৈরি হয়, দামও কমেছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ওষুধ এখনো দেশে তৈরি হয় না। দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

  • বিভাগীয় প্রধান, হেমাটোলজি বিভাগ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।