রমজানে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে

সমাজের ধনী ও দরিদ্র লোকের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে রোজার ভূমিকা অপরিসীম। বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট ও ক্ষুধা-তৃষ্ণায় পতিত না হলে ক্ষুৎপিপাসার মর্মজ্বালা ও যন্ত্রণা উপলব্ধি করা যায় না। বিত্তশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সব সময় ভালো ভালো খাদ্যদ্রব্য আহার করে থাকেন। তাঁরা ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্বালা তেমন অনুভব করতে পারেন না বিধায় অসহায় গরিব-দুঃখীদের দুঃখ-দুর্দশা বুঝতে পারেন না এবং তাদের সব সময় সাহায্য-সহযোগিতাও করেন না। কিন্তু ধনী লোকেরা যখন রোজা পালন করেন, তখন তাঁরা ক্ষুধা ও তৃষ্ণার যাতনা অনুভব করতে শেখেন।এ সময় তাঁরা স্বভাবতই সমাজের গরিব-দুঃখীদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হন এবং তাদের আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে চরম ক্ষুধা, অভাব ও দারিদ্র্য বিমোচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসেন। বিত্তবান রোজাদার বেশি বেশি দান-খয়রাত, সাদকা, জাকাত ও রোজার ফিতরা দ্বারা গরিব-দুঃখী ও অভাবী নিঃসম্বল ব্যক্তিদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করেন এবং দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কশাঘাত থেকে উদ্ধার করে তাদের মুখে হাসি ফোটান।
মাহে রমজানে গরিব-দুঃখীদের প্রতি সম্পদশালীদের প্রচণ্ড সহানুভূতি জাগে এবং ব্যাপকভাবে দানের হাত সম্প্রসারিত হয়। এমনিভাবে রোজাদার ধনী ব্যক্তি রমজান মাসে জাকাত প্রদান এবং মুক্তহস্তে দান-খয়রাত ও সাদকা আদায় করে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনয়ন করতে পারেন। তাই রমজান মাসে তাঁরা বিভিন্নভাবে গরিব-দুঃখী, অসহায় দুর্গত লোকদের সাহায্য করতে সচেষ্ট থাকেন। ফলে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেকটা দূরীভূত হয় এবং সবাই ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে সিয়াম সাধনা তথা রোজা পালন করেন। মাহে রমজানে ধনী ব্যক্তি বেশি পরিমাণে ধন-সম্পদ জমিয়ে রাখতে পারেন না। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে তাঁদের অর্থসম্পদে গরিব-দুঃখীদের নির্দিষ্ট অংশ প্রাপ্য। কেননা জনজীবনে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ ও সম্পদের ভারসাম্য স্থাপন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের (ধনীর) সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ (সূরা আল-যারিআত, আয়াত-১৯)
রমজান মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক বিস্ময়কর উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। মাহে রমজান শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই রোজাদারদের চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উৎপাদন ও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আমদানি শুরু হয়ে যায়। মাহে রমজান ও ঈদুল ফিতরকে উপলক্ষ করে বেচাকেনার জন্য পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে সব ধরনের ভোগ্যপণ্য ও দ্রব্যসামগ্রীর নতুন নতুন ডিজাইন উদ্ভাবনে অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। ব্যবসায়ীরা অন্যান্য সময়ের চেয়ে প্রবল আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনাসহকারে এগুলো সাধারণ মানুষের নাগালে পৌঁছে দেন। ফলে বাজারে অর্থনৈতিক সমাগমে তাঁরাও প্রচুর লাভবান হন। এমনকি কোনো কোনো অসৎ মুনাফাখোর ব্যবসায়ীর বছরের অন্যান্য সময় আয়-উপার্জন করারও প্রয়োজন হয় না। মাহে রমজানকে কেউ কেউ ব্যবসার মাস বলে গণ্য করেন। হালাল পন্থায় ইমানদারির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করা ইবাদতের শামিল; কিন্তু বাতিল পন্থায় আয় উপার্জন করা হারাম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না, কিন্তু পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসা করা বৈধ।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯)
অথচ সমাজে একশ্রেণীর অসাধু মজুতদার ব্যবসায়ী রমজান মাসের আগমনে রোজাদারদের কেনাকাটার চাহিদা লক্ষ করে বাজারে খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেয়। অধিক হারে মুনাফা লাভের জন্য তারা রোজাদারদের আর্থিক কষ্ট দেয়। এটা ঘোরতর অন্যায়। অন্যান্য মুসলিম দেশে পণ্যসামগ্রীর মূল্যে ভর্তুকি দিয়ে মাহে রমজানে তা হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রি করা হয় এবং সেখানকার নীতিমান ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য থাকে সঠিক মূল্যে রোজাদারের হাতে নির্ভেজাল পণ্যটি সরবরাহ করা, কিন্তু আমাদের দেশের নগরগুলোয় এর উল্টোটি করা হয়। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘পাপী ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দুষ্প্রাপ্যতার সময় গুদামজাত করে না।’ (মুসলিম)
যখন রমজান মাস শুরু হয়, তখনই মুনাফাখোর ও মজুতদার অশুভ চক্রটি তৎপর হয়ে পড়ে। ফলে জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।মাহে রমজানে এসব দুষ্ট চক্রের ফাঁদে পড়ে রোজাদার মানুষকে চরম অর্থনৈতিক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাই মাহে রমজানের সংযম বাজারদরে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন।এ ক্ষেত্রে অধিক মুনাফা অর্জনের নোংরা মানসিকতা পরিহার করে রোজাদারদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের পরিচয় দিয়ে ব্যবসায়ী সমাজের মাহে রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও সহনীয় রাখা উচিত। সেই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং কিছু পণ্যসামগ্রীতে ভর্তুকি ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী মনিটরিং ব্যবস্থা সরকার প্রবর্তন করলে রোজাদারদের দুর্দশা ও কষ্ট লাঘব এবং রোজার অর্থনৈতিক গুরুত্বের ব্যাপারটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে।
সমাজে ধনী–দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য আকাশপাতাল ব্যবধানসম। তবে মাহে রমজানে এই অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি সাধিত হয়। অত্যধিক সওয়াব প্রাপ্তির আশায় রমজান মাসে ধনী ব্যবসায়ী ইমানদার ব্যক্তি এমনকি অতিশয় কৃপণ লোকের মধ্যেও কিছু কিছু দান-খয়রাত ও সাদকার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এতে মাহে রমজান উপলক্ষে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে অর্থ সমাগম বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থাকে ঠিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বলা যায় না। কিন্তু আগের চেয়ে একটু উন্নত অবস্থায় অন্তত রমজান মাসে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কিছুটা হলেও দূরীভূত হয় এবং সবাই মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে বসবাস করেন। এভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে মাহে রমজানের রোজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক।
dr.munimkhan@yahoo.com