চাঁদাবাজির উচ্চফলনশীল বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলব কীভাবে

কয়েকজন সন্ত্রাসী একত্রে কোনো ব্যবসায়ীকে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করার ঘটনা কি ‘মব–কাণ্ড’? কিংবা ধরা যাক, ফ্যাসিবাদী অপকর্মের সহযোগীদের গ্রেপ্তার চেয়ে বিশেষ স্থানে অবস্থান কর্মসূচিও কি তা-ই?

দল বেধে চাঁদাবাজি করতে আসা চাঁদাবাজদের সোজা কথায় চাঁদাবাজ না বলে ‘মব’ বললে তো আসল অপরাধের বিচারের পথ বন্ধ হয়ে যায় শুরুতেই।

একই সঙ্গে মানুষের প্রতিবাদ ও দাবিদাওয়া উত্থাপনের অধিকারকে হরেদরে ‘মব’ আখ্যা দিলে ভাবী গণতান্ত্রিক সমাজের আকাঙ্ক্ষাকেও মেরে ফেলা হয় অঙ্কুরেই।

পতিত ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনা ও তাঁর দোসরেরা ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঢাকা-অভিমুখী যাত্রা (মার্চ)-কে ‘আক্রমণ’ বলে কলঙ্কিত করার চেষ্টা–তদবির করছে। কথায় কথায় সবকিছুকে ‘মব’ বলে কারা যেন সেই বয়ানকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

ফ্যাসিবাদী জামানায় ‘বিকশিত’ চাঁদাবাজির যে সংস্কৃতি রাজনৈতিক কর্মীসহ একটি বড় প্রজন্মকে গ্রাস করেছে, তারই ফল আজকের অঘটন ঘটন—অপরাধের রাজনীতিকরণ এবং রাজনীতির অপরাধীকরণ।

আরও পড়ুন

কেউ কেউ করে চাঁদাবাজি, অন্য পক্ষ সুযোগ পায় সমালোচনার এবং অন্যরা বোঝে না তারা কোনো পাপ করছে কি না। এ বিষয়ে কার্যকর ঐকমত্যে আসার উদ্দেশে এই বিচ্ছিন্ন আলোচনাগুলো সরাসরি দলগুলোর মধ্যে হওয়া দরকার।

কারণ, আপনি যা-ই ভাবুন, এই চাঁদাবাজি অনেকের জন্যই জীবিকা। আওয়ামী আমলে এগুলো হয়েছে অত্যন্ত সুচারুরূপে। পাতিমাস্তান, রাজনৈতিক গডফাদার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, পরিবহন খাত, অলিগার্কি ও ব্যবসায়ী সুবিধাভোগীদের যৌথ কারবারে এবং মার্কেট, সরকারি অফিসের আশপাশ বা এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো জায়গায় অংশীজনের অংশগ্রহণে এগুলো হয়েছে।

সেই চাঁদাবাজির সংস্কৃতি একটি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করছিল ৫ আগস্ট ২০২৪-এর আগপর্যন্ত এবং ১৮ কোটি মানুষের দেশে হাজারো সুবিধাভোগীর কাছে ব্যবস্থাটি ছিল অধিকারের মতোই।

এখন চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত থাকা কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, তখনকার বঞ্চিত আমরা কি বঞ্চিতই থেকে যাব?

আরও পড়ুন

ফ্যাসিবাদী যুগের চাঁদাবাজি ছিল নাহয় একটি নাজায়েজ কর্ম, তাই এখন গণতান্ত্রিক সংস্কারের চেতনায় একটু–আধটু টাকাপয়সা কামালে অসুবিধা কী! এই আলাপ ঠিক তেমন, যেমন বিদেশি শাসনামলে অনৈতিক বিবেচিত ঘুষ স্বাধীন দেশে অনেকখানি ‘স্বাধীনতা’ পায়।

নৈতিকতা, সুশাসন, ধর্মকর্মের বাণী দিয়ে চাঁদাবাজি বিশ্লেষণের বাইরেও অসুবিধা আছে। এটিকে আগের মতো স্বীকৃত পেশা হিসেবে গণ্য করলে চাঁদাবাজদের সংখ্যা খেটে খাওয়া মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে আর তখন সমাজে সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা কত গুণ বেড়ে যাবে, সে ধারণা আমাদের নেই।

আমাদের হয়তো এটাও জানা নেই কীভাবে চাঁদাবাজিকে সমাজ থেকে বিদায় করে দেওয়া যাবে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংস্কার অথবা কোনো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগও নেই সংস্কারের এই ভরা মৌসুমে।

এখনো চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতা এবং অমানবিক খুনখারাবির রিপোর্ট দেখতে পাচ্ছি।

আরও পড়ুন

দুঃখজনকভাবে ‘মব’ এবং চাঁদাবাজি নিয়ে রাজনৈতিক অভিযোগ, বিতর্ক এবং পাল্টাপাল্টি বক্তৃতাবাজি এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যদি না দলগুলো সংযত আচরণ করে, তাহলে সংকট তৈরি হতে পারে।

আগের চেয়ে রাজনৈতিক চাঁদাবাজি কমার পরও এই অবস্থা। যাহোক আওয়ামী চাঁদাবাজদের অনুপস্থিতির সুফল আমরা দেখেছি অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম তুলনামূলক হ্রাস পাওয়ায়।

একটি জানা বিষয় আমাদের আধা রাজনৈতিক সুশীলেরা উল্টো করে উপস্থাপন করেন। সেটি হলো—‘চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসীদের কোনো রাজনৈতিক দল নেই।’ তাহলে দল বিশেষ করে সরকারি দলের পরিচয় বাদ দিয়ে ওই ‘বাবাজিরা’ আসুক তো চাঁদা তুলতে!

রাজনৈতিক দলগুলোও সারা দেশে এই চাঁদাপ্রত্যাশী এক বিরাট বহর নিয়ে হিমশিম খায়।

চাঁদাবাজি এমন একটি সামাজিক রোগ, যার উৎপত্তি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের এক বিষবৃক্ষে, যেখানে এক আদম সন্তান তার ভাই বা বোনকে জুলুম করতে একটুও দ্বিধা করে না। এই রোগ সারানোর চিকিৎসা কে করবেন, কীভাবে করবেন?

বোদ্ধারা মনে করেন, বেকারত্ব দূর এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হলে চাঁদাবাজি দূর হবে।

তবে শর্ত থাকে যে চাঁদাবাজদের সমর্থন না দেওয়ার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও দলগুলোর শক্ত সাংগঠনিক অবস্থান ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো প্রায় অসম্ভব।

মোটামুটিভাবে তিনটি কারণে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে তাদের সেই অবস্থান নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

এক. রেজিমেন্টেড পার্টি বাদে সব দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষমতা ব্যবহার ও আর্থিক প্রত্যাশা মেটানোর কোনো বৈধ বা প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন না থাকা।

দুই. রাজনৈতিক দলের নিয়মিত এবং নির্বাচনী প্রচারাভিযানের অর্থায়নের কোনো স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক উৎসের অনুপস্থিতি

এবং তিন. সাধারণভাবে রাজনীতিবিদ ও তাঁদের পরিবারের জীবনযাপনের জন্য দৃশ্যমান আয়ের অভাব—নির্দিষ্ট করে বললে তাঁদের নিজস্ব পেশা না থাকা বা আয়রোজগারের ব্যবস্থা না থাকা।

একজন রাজনীতিককে যদি তাঁর সংসার ও দল চালাতে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চাঁদা তুলতে হয়, তখন চাঁদাবাজি একধরনের রাজনৈতিক বৈধতা পায় এবং সমাজে চাঁদাবাজির অর্থনীতি গড়ে ওঠে।

চাঁদাবাজি স্টাইলে দল বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্য অর্থ উত্তোলন তাদের দাতাদের কাছেও জিম্মি করে ফেলে। হাসিনার অলিগার্কির সঙ্গে তাঁর, দল ও রাজনৈতিক সরকারের দেওয়া–নেওয়ার সম্পর্ক তাদের সবাইকেই নিকৃষ্ট দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করে। ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ক্রাউডফান্ডিং বা গণমানুষের অর্থায়ন দল ও রাজনীতিকদের পুরোনো সমস্যার সমাধান দিতে ও ভালো মানুষকে রাজনীতিতে টানতে পারে।

যেহেতু দল চালাতে ও নির্বাচন পরিচালনা করতে টাকা দরকার হবেই, তাই এ অঞ্চলে রাজনীতির এই ‘চিরায়ত’ সমস্যাটির আন্তরিক সমাধান খুঁজতে হলে তা করতে হবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে।

সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে সংস্কারের প্যাকেজে এবং সেই প্রক্রিয়ায় তাদের বিশ্বাস থাকতে হবে।

চাঁদাবাজি স্টাইলে দল বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্য অর্থ উত্তোলন তাদের দাতাদের কাছেও জিম্মি করে ফেলে।

হাসিনার অলিগার্কির সঙ্গে তাঁর, দল ও রাজনৈতিক সরকারের দেওয়া–নেওয়ার সম্পর্ক তাদের সবাইকেই নিকৃষ্ট দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করে।

ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ক্রাউডফান্ডিং বা গণমানুষের অর্থায়ন দল ও রাজনীতিকদের পুরোনো সমস্যার সমাধান দিতে ও ভালো মানুষকে রাজনীতিতে টানতে পারে।

জনপ্রতিনিধি এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের জন্য বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি এবং রাজনৈতিক কর্মী এবং সংশ্লিষ্টদের ট্যাক্স ফাইল জমা দেওয়া, অন্য নাগরিকদের মতোই বাধ্যতামূলক করলে চাঁদাবাজির মতো অবৈধ অর্থ অর্জনের উৎসাহে ভাটা পড়তে পারে।

ঢাকার বিভিন্ন এলাকার হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় হয় নিয়মিত। কয়েক বছর আগে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটির হকারদের কাছ থেকে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় করা হয়। এর পুরোটাই চলে যাচ্ছে চাঁদাবাজ ও অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকদের পকেটে।

হকারদের দেওয়া চাঁদার টাকাকে আনুষ্ঠানিক রাজস্বে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে কর্তৃপক্ষ। হকারদের পরিচয়পত্র ও লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের একটি ব্যবস্থার আওতায় আনা যায়।

হকারদের সঠিক সংখ্যাই কোনো কর্তৃপক্ষ জানে না। এদের নিয়ে সার্বিক পরিকল্পনা দরকার। হকারদের আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হলে চাঁদাবাজির বিষয়টির একটি স্থায়ী সমাধান হতে পারে৷

দেশের আর্থিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে যদি দুর্নীতি, কালোবাজারি, ঘুষ, ‘কমিশন–বাণিজ্য’, কালোটাকা আয় ও রক্ষা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধের অবাধ সুযোগ রাখা হয়; যদি সরকার চালানো এবং ভিন্নমত প্রকাশে নিয়োজিত রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের বৈধ ও সম্মানজনক আয়ের উৎস না থাকে, তাহলে তাঁরাসহ সমাজের যেকোনো ক্ষমতাবান গোষ্ঠী কার্যত পরগাছার মতোই আচরণ করতে থাকবে।

  • খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক।

মতামত লেখকের নিজস্ব