আপস নয়, পরাজয়ই মেনে নিলেন ইয়াহিয়া

িনক্সনও বাঁচাতে পারলেন না ইয়াহিয়া খানকে
িনক্সনও বাঁচাতে পারলেন না ইয়াহিয়া খানকে

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনেকগুলো পক্ষ ছিল। তার মধ্যে প্রধান পক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ এবং তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। দ্বিতীয় পক্ষ দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী। এর মূল হোতা ইয়াহিয়া খান হলেও নেপথ্যে আরও অনেক কুশীলব ছিলেন। ইয়াহিয়া খান সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে অখুশি হলেও সরাসরি ফলাফল বানচাল করতে চাননি।
জানুয়ারিতে তিনি ঢাকায় এলেন, বিজয়ী দলের নেতার সঙ্গে আলোচনা করলেন। কিছু বিষয় অমীমাংসিত থাকলেও উভয় পক্ষ বলল, ‘আলোচনা সফল।’ অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার বিষয়েও তাঁরা একমত হলেন। কিন্তু মধ্য ফেব্রুয়ারিতে পিপিপির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে ইয়াহিয়ার ‘লারকানা বৈঠকের’ পরই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। এ ব্যাপারে ইয়াহিয়াকে প্ররোচিত করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা। পরবর্তী আট মাস কার্যত তিনি ছিলেন তাঁদের হাতের পুতুল।
পাকিস্তানি দলিলপত্র থেকে জানা যায়, ২৫ মার্চের গণহত্যার পর যখন বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে, তখন ইয়াহিয়া খান বিভিন্ন দেশে দূত পাঠিয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ২৫ মার্চের গণহত্যা এতই ভয়াবহ ছিল যে এর পক্ষে কোনো সাফাই কেউ বিশ্বাস করেনি। বিদেশি রাষ্ট্রনেতা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি সবাই বলেছেন, বল প্রয়োগ করে কোনো কাজ হবে না। রাজনৈতিক সমাধানের পথ বের করুন।
পাকিস্তানিরা ভেবেছিল সামরিক অভিযান চালিয়েই দখলকৃত বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবে। সেটি ছিল তাদের চরম বোকামি। দিন যতই যেতে লাগল, ততই অবস্থা নাজুক হতে লাগল। চরমপত্র খ্যাত এম আর আখতার মুকুলের ভাষায়, ‘সবখানে পাকিস্তানিরা ক্যাচকা মার খেতে লাগল।’
আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানি নীতির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা হলে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার বিভিন্ন দেশে দূত পাঠিয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করল। আবার কয়েকটি দেশের জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যমকেও ডেকে আনা হলো। এর ফল হলো উল্টো। জনগণ যাঁদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, তাঁদের জেলে রাখা কিংবা ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত রাখার বিষয়টি গণতান্ত্রিক দেশের প্রতিনিধিরা মানতে পারলেন না। তাঁরা ফের আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধানের তাগিদ দিলেন।
এদিকে পশ্চিমাংশেও জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ বাড়তে থাকে। তবে সেই জনপ্রতিনিধি হলো আংশিক। আওয়ামী লীগের ৮৮টি আসন শূন্য ঘোষণা করে সেখানে উপনির্বাচনের প্রহসন করে কয়েকটি দলের কয়েকজন নেতাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করা হলো। এসব লোক দেখানো নাটকও যখন কোনো কাজে এল না, তখন ইয়াহিয়ার সরকার কলকাতায় বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ইয়াহিয়া খানকে সরাসরি আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুরের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া যাঁকে কয়েক মাস আগে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তাঁর সঙ্গে কী করে বৈঠক করেন? তাই সরাসরি তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করে তাঁর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনাকে শ্রেয় মনে করলেন।
সেটি ছিল আগস্ট-সেপ্টেম্বরের ঘটনা। ইয়াহিয়ার ইঙ্গিত পেয়ে কলকাতায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতা জহিরুল কাইউম মার্কিন কনসাল অফিসে এক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললেন। হাসান জাহির জানান, মুজিবের বিচারের বিষয়টি বিশ্ব সম্প্রদায় হালকাভাবে নেয়নি। আমেরিকানরা পাকিস্তানের কাছে দাবি করে আসছিল এবং এই নিশ্চয়তা চেয়েছিল যে শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। তাদের ধারণা, ইয়াহিয়া নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও মুজিবের জীবন রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া কিংবা তাঁর সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। যদি যুদ্ধ ভিন্নভাবে শেষ হতো এবং ইয়াহিয়া ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে হয়তো তিনি দণ্ড বহালই রাখতেন।
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি কমান্ডারদের এক বৈঠকের কথা উল্লেখ করে ইয়াহিয়ার অত্যন্ত বিশ্বস্ত জেনারেল করিম বলেছেন, সেখানে তিনি (ইয়াহিয়া খান) আওয়ামী লীগারদের আলোচনায় আনার ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে বলে জানিয়েছেন। মেজর জেনারেল গুল হাসান প্রশ্ন তোলেন, ‘আপনি তাঁদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন না কেন? তারা ফিরে আসুক এবং আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করুক।’ কিন্তু এই প্রস্তাব তোলামাত্র অন্য জেনারেলদের কাছ থেকে কঠোর বিরোধিতা এসেছে। তাঁরা বলেছেন, বিষয়টি চূড়ান্তভাবেই শেষ করতে হবে।
এরপর হাসান জহিরের বিশ্লেষণ হলো: পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতৃত্বের সঙ্গে যে রাজনৈতিক বিরোধ দেখা দিয়েছে, তা মেটাতে ইয়াহিয়া খানকে অনেকগুলো অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। মুজিব এখনো সমাধানের প্রধান চাবিকাঠি এবং তিনি কাছেই ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া তাঁকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে নিজেই সমঝোতার পথ অনেকটা বন্ধ করে দিয়েছেন।
হাসান জহির মনে করেন, সামরিক অভিযান গোটা দেশকেই বহিঃশক্তির হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, ইয়াহিয়ার স্থলে কেউ এসে তিক্ততার এবং মুজিবের প্রতি বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে নতুন করে শুরু করতে পারবে কি না? জেনারেল ওমর জানাচ্ছেন এ নিয়ে এক বা দুবার আলোচনা হয়েছে।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক চক্র তাতে রাজি হয়নি। দেশ যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, সে সম্পর্কে তাদের বেশির ভাগ ওয়াকিবহাল নন। ভারতের হস্তক্ষেপকেও কেউ গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। ইয়াহিয়া মুজিবকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করেছেন। সেনাবাহিনীর সবাই তা-ই মনে করতেন। পরিস্থিতির খুবই অবনতি ঘটেছিল, তাই যাঁরা ইয়াহিয়ার বিকল্প খুঁজছিলেন, তারাও আলোচনার কথা চিন্তা করেননি।
হাসান জহিরের মতে, হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের পরিস্থিতি দেশটির নীতিনির্ধারকদের চেয়েও ভালো বুঝতেন। ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী নন বলে তিনি বাংলাদেশের নির্বাসিত নেতাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিলেন। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে জনৈক কাইউম (জহিরুল কাইয়ুম) কলকাতায় মার্কিন দপ্তরে এসে হাজির হন। তিনি এই শর্তে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেন যে, সেখানে মুজিবকে উপস্থিত থাকতে হবে, ছয় দফা মেনে নিতে হবে।
মধ্য আগস্টে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ইয়াহিয়াকে এই যোগাযোগ সম্পর্কে জানালে তিনি কেবল তাঁকে স্বাগতই জানাননি, প্রবাসী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য ফারল্যান্ডের সদিচ্ছা কাজে লাগানোর কথাও বলেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এই বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। যখন কাইউমকে বৈঠক আয়োজনের অনুরোধ করলেন, তখন তিনি অক্ষমতা প্রকাশ করলেন, ভারতীয় গোয়েন্দারা তঁার পিছু লেগেছে এই অজুহাতে।
২১ সেপ্টেম্বর ইয়াহিয়া খান কলকাতা বৈঠক সম্পর্কে ফের ফারল্যান্ডের কাছে খোঁজ নেন। আর যদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে না পাওয়া যায়, তাহলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর কাইউম মার্কিন কনসাল জেনারেলকে সতর্ক করে দেন যে, ভারত সরকার বাংলাদেশ নেতৃত্বকে সব যোগাযোগ দিল্লির সঙ্গে করতে বলেছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে সরাসরি কথা বলতে বলেন। জবাবে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ‘শেখ মুজিবের মুক্তি এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেন।
এরপরও ২৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন কনসাল জেনারেল খোন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেন; যদিও তিনি দৃশ্যত ভারতীয়দের নজরদারিতে ছিলেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ আলোচনায় সবার অংশগ্রহণের কথা বলেন। হেনরি কিসিঞ্জারের মতে, অক্টোবরের শেষ দিকে বাংলাদেশের নেতৃত্বের সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মার্কিন সরকার যদিও পাকিস্তান সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খুবই বিচলিত ছিলেন। একপর্যায়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে বললেন, ‘আপনারা কি আমাকে সাহায্য করতে চান, না আমি গভীর খাদে পড়ে যাই, সেটি দেখতে চান?’ অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই বাস্তবে দেখা যায়নি।
জবাবে ফারল্যান্ড বললেন, নিক্সন খুবই বেকায়দায় আছেন। গণমাধ্যম তাঁর সমালোচনা করছে। এখন নির্বাচনের সময়। ডেমোক্র্যাটরাও এটিকে নির্বাচনী ইস্যু করেছে। এ সত্ত্বেও নিক্সনের পক্ষে যে সহায়তা দেওয়া সম্ভব, সেটি তিনি দ্রুতই দেবেন।
এরপর ফারল্যান্ড ইয়াহিয়া খানকে এই প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেন যে পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হলে সেটি তাঁদের জন্য ভালোই হবে। সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী পাকিস্তান গঠনে তাঁরা আমেরিকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহায়তা পাবেন। তাঁদের পরবর্তী কথোপকথন ছিল এ রকম:
ফারল্যান্ড: আমার একটি অনুরোধ আছে। যদি আপনি যুদ্ধবিরতি মেনে না নেন, আমাদের জানান। আমি আমেরিকানদের এখান থেকে সরিয়ে নেব।
ইয়াহিয়া: কেন?
ফারল্যান্ড: ভারত যদি সত্যি সত্যি আক্রমণ করে, তাহলে পাকিস্তান তাদের জন্য জুতসই জায়গা হবে না।
ইয়াহিয়া: আপনারা ধৈর্য হারাবেন না।
ফারল্যান্ড: বন্ধু হিসেবে বলছি না। আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি আমার দেশের একজন দূত হিসেবে, যদি আপনি যুদ্ধবিরতি মেনে না নেন, তাহলে আমি আমেরিকানদের সরিয়ে নেব। কোনো মানুষের জন্যই পাকিস্তান স্বাস্থ্যকর জায়গা নয়।
ফারল্যান্ড চলে যাওয়ার পরই ইয়াহিয়া খান সুলতান মাহমুদকে ডেকে পাঠিয়ে যুদ্ধবিরতির খসড়া তৈরি করতে বলেন। (শেষ)
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]