একদিন 'প্লাস্টিক ম্যান' হব রে!

একগাদা প্লাস্টিক খেয়ে মরেছে এক তিমি। ইয়া বড় এক স্পার্ম তিমি। না, প্লাস্টিক ভক্ষণেই যে তার মৃত্যু ঘটেছে—এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এটা বিশেষজ্ঞ আর পরিবেশবাদীদের ধারণা মাত্র। ৩১ ফুট দীঘল ওই তিমির পেট থেকে ১১৫টি প্লাস্টিকের কাপ আর ২৫টি ব্যাগ বেরিয়েছে। 

নির্বংশপ্রায় নাদান প্রাণীগুলোর পাশে দাঁড়ানো ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড তো বলছে, চারটি প্লাস্টিকের বোতলও বেরিয়েছে তিমিটার পেট থেকে। ওটা দড়িই খেয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন কেজি ওজনের। সব মিলিয়ে কেজি ছয়েক প্লাস্টিক খেয়েছে তিমিটা। তারপর যখন বিশাল বপুটা ফুটুস, ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি প্রদেশের ওয়াকাতোবি ন্যাশনাল পার্কসংলগ্ন সাগরজলে ভাসছিল। গেল সোমবারের ঘটনা।
প্লাস্টিক যে কতটা ভয়াবহ কুখাদ্য, সে আমি জানি। বেশ কয়েক বছর আগে আমার সহধর্মিণী একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করত। একদিন অফিস থেকে সে একটা ধাড়ি খরগোশ নিয়ে হাজির। বলল, ‘অফিসের ওই পিয়নটা শখ করে কিনেছিল। এখন আর পুষতে পারছে না। খরচে পোষায় না। তাই নিয়ে এলাম।’
আমার শিশুপুত্র আর তার মা মিলে অল্প দিনেই রোগাটে খরগোশটাকে বেশ হৃষ্টপুষ্ট বানিয়ে ফেলল। কিন্তু তার ভয়ানক বদঅভ্যাস। ঘরের ভেতর ঘুর ঘুর করে আর যা পায় ওতেই দাঁত চালায়। শিগগিরই ছেলের কিছু খেলনার সর্বনাশ ঘটাল সে। কয়েক জোড়া চপ্পলকে অচল করে দিল। অনেক সতর্ক থেকেও এই ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত রাখা গেল না। একদিন এক প্ল্যাস্টিকের কনটেইনারের কিয়দংশ খেয়ে ফেলল। তারপর তার খাওয়াদাওয়া বন্ধ। পরদিন দেখা গেল সে শক্ত হয়ে মরে পড়ে আছে। প্লাস্টিক খেয়ে তিমিটাও ওই খরগোশের মতো গেছে আর কি।
হ্যাঁ, প্রশ্ন উঠতে পারে, এক তিমির মৃত্যু নিয়ে এত হাপিত্যেশ কেন? একটা তিমি তো মাত্র, তা আবার আরেক দেশের সাগরে মরেছে! যিনি পলিব্যাগ বা প্লাস্টিকের থলে ভরে বাজার-সদাই করেন, তাঁর অবশ্য কিঞ্চিৎ চিন্তা হতে পারে—ওরাও পেয়ে গেছে প্লাস্টিকের খোঁজ! সস্তা বালতি–বদনা কেনা এবার লাটে উঠবে! অন্যদিকে প্লাস্টিকের উৎপাদকেরা ক্যালকুলেটর নিয়ে বসে যেতে পারেন। হিসাব কষতে পারেন, তিমির খাদ্যতালিকায় প্লাস্টিক যোগ হওয়ায় উৎপাদন কতটা বাড়ানো যেতে পারে।
কেবল আমার মতো দু–চারটে নাদানের মাথায় হাজারো ফালতু চিন্তার মতো এ প্রশ্নটা পাক খেতে পারে—এত কিছু থাকতে তিমিটা প্লাস্টিকের জিনিস খেল কেন? নিতান্ত সস্তা আর সহজলভ্য বলে?
আসলে প্লাস্টিক ছাড়া আমাদের জীবনে আছেটা কী? ঘরে–বাইরে সবখানেই সহজলভ্য জিনিস বলতে তো ওই প্লাস্টিক। বাজারে সস্তার মুরগি বলতে যে ব্রয়লার চিকেন বোঝায়, ওটা ‘প্লাস্টিক’ বলে নাম কিনেছে। নগরের রাস্তায় খ্যাপাটে মুড়ির টিনের পাশে ছোট সাইজের প্রাইভেট কার উদয় হলে হেলপার কর্কশ গলায় চালককে বলেন, ‘ওস্তাদ, বাঁয়ে পেলাস্টিক, খিয়াল রাইখেন!’
যেকোনো পণ্য নিরাপদে স্থানান্তরের সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ বাহন প্লাস্টিকের কনটেইনার বা আধার। অন্তত এটা ভাঙবে না। আর দামেও তো সস্তা। কিন্তু প্লাস্টিক পানির দরে মিললেও এর স্থান তো পানিতে নয়। এ আদি–অকৃত্রিম ঠাঁই মাটির ধরায়। এখন এ প্রশ্ন তো তিরের মতো গোঁত্তা খাওয়া স্বাভাবিক—সাগরে এত্ত এত্ত প্লাস্টিক তিমিটা পেল কোথায়?
উত্তরটাকে এক শব্দে আনলে যা দাঁড়ায়, তা হলো—নিকেশ! প্রয়োজন ফুরিয়েছে তো নিকেশ করে দাও।
ভাঙা কুলার উত্তম স্থান আস্তাকুঁড়। পলিথিন–প্লাস্টিকের জায়গা মেলে আবর্জনার ভাগাড়ে। ঘুরেফিরে সেঁধোয় মাটির বুকে। কিন্তু প্লাস্টিকের অনন্ত আয়ু। ৫০০ বছরেও অক্ষত–অটল। এটি অমর প্রাণ নিয়ে পড়ে থাকে বটে, কিন্তু পরিবেশের সারা গায়ে শুধু চিমটি কাটে। সে জ্বালা নীরবে সয়ে ফ্যাকাসে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সে। আমরা দেখি, জানি, বুঝি। কিন্তু গা করি না। অবলীলায় পলিথিন–প্লাস্টিকের ব্যাগে শপিং সারি, আর সেই ব্যাগে আবর্জনা ভরে অবলীলায় ছুড়ে ফেলি। কোথায় যাচ্ছে, কী বিপত্তি ঘটছে, কে খেয়াল রাখে? নগদ আপৎ তো নিকেশ হলো!
ইন্দোনেশিয়ার মানুষগুলোর ভাবনা মনে হয় একটু উন্নত। তারা হয়তো ভাবে যে সর্বংসহা মা মাটিকে আর কত কষ্ট দেব! আর কত প্লাস্টিকের জঞ্জাল বুকে ধারণ করবে মাটি? সাগরের বিশাল গর্ভ যখন উদোম হয়ে আছে, ওখানে নিকেশের কাজটা হোক না। আর সাগর তো সর্বগ্রাসী। ‘সিন্ধু’ কবিতায় একদা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘এত জল বুকে তব, তবু নাহি তৃষার অবধি! এত নদী উপনদী তব পদে করে আত্মদান, বুভুক্ষু! তবু কি তব ভরিল না প্রাণ?’
নজরুলের এ কবিতার খোঁজ তারা পেয়েছে কি না, জানি না। তবে এ ধরনের মনোভাব নিয়েই হয়তো তারা কাপ–পিরিচসহ প্লাস্টিকের নানা জিনিস সাগরে ফেলে। প্লাস্টিকের কাপে চা খাও, কফি খাও—আর কাপ–পিরিচ ছুড়ে ফেলো সাগরে। খা বেটা, কত ক্ষুধা তোর! সাগরে জঞ্জাল ফেলায় অবশ্য চীনাদের টপকাতে পারেনি কেউ। এরপরই রয়েছে ইন্দোনেশীয়রা। বছরে প্রায় ১ দশমিক ২৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন জঞ্জাল সাগরে ফেলে তারা। এখন গভীর সাগরের প্রাণী স্পার্ম তিমি যদি ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এসে একগাদা কাপ–পিরিচ দেখে ভাবে যে এ হয়তো চিনিসাজের মতো সুমিষ্ট কোনো খাবার, তাকে দোষ দেওয়া যায়? বেচারা কি আর জানত এতেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হবে?
এখন তিমিটা তো মরল। আমরা কী করব, তা–ই ভাবছি। এটা তো জলের মতো পরিষ্কার যে প্লাস্টিকের উৎপাদন যত বাড়বে, এর ব্যবহারও বাড়বে। পাস্টিক বর্জ্যে ধ্বংস হতে থাকবে পরিবেশ, বারোটার কাঁটা টিক টিক করবে জীববৈচিত্র্যের ঘরে। আর আমার মতো খুদে মানবেরা চেঁচিয়ে মরলেও এ ধ্বংস রোধে যে কোনো কাজ হবে—এর নিশ্চয়তা খুব কম। এত দিনেও যখন হলো না!
এর চেয়ে বরং আমরা কাল্পনিক সুপার হিরো ‘প্লাস্টিক ম্যানের’ কথা ভাবতে পারি। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে কমিক শিল্পী জ্যাক কোল এই অসাধারণ চরিত্রটি কমিকের জগতে নিয়ে এসে হইচই ফেলে দেন। পরে প্লাস্টিক ম্যান নিয়ে কার্টুন সিরিজ আর মুভিও তৈরি হয়। প্লাস্টিক ম্যান এমন এক সুপার হিরো, যে তার শরীরটাকে প্রয়োজনমতো যেকোনো আকার দিতে পারে। চট করে গোল একখান বল হয়ে যেমন গড়াতে পারে, তেমনি ঝট করে একটা গাড়ি হয়ে ছুটতে পারে শাঁ করে।
প্লাস্টিক যখন আমরা ছাড়তে পারছিই না, ভবিষ্যতে এর সঙ্গে মিলেমিশে প্লাস্টিক ম্যান হলে কেমন হয়? প্লাস্টিকের প্রভাবে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে? আরে, ছ্যাঃ। এসব কথা কে শোনে? প্লাস্টিক–পলিথিনের প্রভাবে গাছপালা থাকবে না, সবুজ বিলীন হবে? হোক, আমরা তখন তামাটে ন্যাড়া জমিতে প্লাস্টিক ম্যান হয়ে ইচ্ছামতন দাপিয়ে বেড়াব। গোটা প্রকৃতিই তখন দর্শক বনে আমাদের এই মজার খেলা দেখবে।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: লেখক, সাংবাদিক
[email protected]