অরিত্রীকে ফাঁসে ফেলল যারা, তাদের বলছি...

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির সামনে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের বিক্ষোভ। ছবি: আশরাফুল আলম
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির সামনে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের বিক্ষোভ। ছবি: আশরাফুল আলম

স্কুল কর্তৃপক্ষ অরিত্রীর হাতে একটা ফাঁস তুলে দিয়েছিল। ফাঁসটা ছিঁড়ে মেয়েটি আর বের হতে পারেনি। বাসায় গিয়ে তাতে মাথা ঢুকিয়ে ঝুলে পড়েছে। ফাঁস নেওয়ার দড়িটা সবাই দেখে, যে দুঃখ-যন্ত্রণায় আটকে পড়ে অরিত্রী হাঁসফাঁস করল, সেই প্রাণঘাতী ফাঁসটাও দেখতে পারতে হবে। বাবা-মা যেমন চোখের সামনে সন্তানের লাঞ্ছনা সইতে পারেন না, সন্তানের জন্যও তেমনই কঠিন বাবা-মায়ের অপমান ভুলে যাওয়া। অরিত্রীর হাতে সেই অপমানের ফাঁসটা তুলে দেওয়া হয়েছিল। কোমলমতি শিশুদের কঠোরমতি প্রশাসনের হাতে ছেড়ে রাখা আর না। যিনি বা যাঁরা শিক্ষা দেবেন, তাঁদের তো আগে মানুষ থাকার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। যে শিক্ষক বা প্রিন্সিপালের মধ্যে মানবিকতা নেই, যিনি শিশুর ভুল-ত্রুটিকে দারোগার চোখ দিয়ে দেখার বাতিকে আক্রান্ত, তাঁর কাছে ছেলেমেয়েদের শিখতে পাঠানো আর আখমাড়াইকলে আখ ঢোকানো সমান কথা। দ্য এডুকেটর শুড বি এডুকেটেড ফার্স্ট। কথাটা লাখো-হাজারবার বলা হলেও টনকহারা শাসকেরা কানে তুলছেন না। পাত্তা দিচ্ছেন অনেক অভিভাবকও। অথচ অনেক শিশুই হাঁসফাঁস করছে...

কিছুদিন আগে অরিত্রীর বয়সী কিশোর-কিশোরীরা দুই সহপাঠীর মৃত্যুতে আঘাত পেয়ে নিরাপদে বাড়ি ফেরার দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। তাদের খালি হাতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল, তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল, হেলমেট বাহিনী তাদের অনেককে রক্তাক্ত করেছিল। তারপর, অপমানে-দুঃখে আত্মহত্যা করেছিল অন্তত একটি তরুণ। আর এখন পরীক্ষার হলে মোবাইল নেওয়ার কথিত অভিযোগে স্কুল থেকে বহিষ্কারের হুমকি এবং মা-বাবাসুদ্ধ মেয়েটিকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়ার লজ্জায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলো মেয়েটি। হিটলারের জার্মানিতে স্কুল-কলেজসহ ঘরে ঘরে মিনি হিটলারের উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। অনেক শিক্ষক-অভিভাবক-প্রশাসক হিটলারি কায়দাকেই সঠিক মনে করা শুরু করেন তখন। জোর-জুলুম এখন আমাদের দেশের সবখানে। এ পরিবেশে আমাদের কোনো কোনো শিক্ষকের মধ্যে হিটলারি মনোভাবের জন্ম হতে দেখছি। যাঁরা বলবেন, না না, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তাঁরা দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে ব্যর্থ। অমানবিক রাষ্ট্রে, সমাজে মানবিকতা আশা করা আর আমড়াগাছে আম ফলানোর বাসনা রাখা একই কথা। আমাদের গভীর–গভীরতর অসুখের কথা জানিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি আত্মহত্যাকারী শিশু-কিশোর থেকে সাবালক মানুষেরা। অসুখটা বড়দের, ছোটরা তার শিকার। আমরা দায় অস্বীকার করে যতই আত্মখালাস নিই না কেন, কোমল প্রাণের আত্মহত্যা তাতে বাড়বে বৈ কমবে না।

বলা হচ্ছে, মেয়েটি দুর্বলচিত্ত ছিল, তাই ‘সামান্য’ বকাঝকা সইতে পারেনি। ‘নকলের’ অভিযোগ কী এমন ফৌজদারি অপরাধ হলো যার জন্য তার সব পরীক্ষা বাতিল করে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিতে হবে? এটা কি নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের মতো কিছু, যার জন্য মনোনয়ন বাতিল হবে? ত্রুটি হয়েছে মেয়ের, বাবা-মাকে কেন অপমান করতে হবে? যে কর্তৃপক্ষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তারা কর্তৃপক্ষ নয়, তারা আসলে নিষ্ঠুরতার পক্ষ। তাদের হাতে কোথাও আমাদের শিশুরা নিরাপদ নয়, না রাজপথে, না বিদ্যালয়ে, না সমাজ বা রাষ্ট্রে।

এই কর্তৃপক্ষ কি মনে করে মা–বাবাদের উচিত বাড়িতে পিটিয়ে, গালি দিয়ে যেভাবে পারে সেভাবে বাচ্চাদের মনটাকে কঠিনচিত্ত বানিয়ে স্কুলে পাঠানো? ওই শিক্ষকেরা কি নিজ নিজ সন্তানদের সঙ্গে সেটাই করেন বা করবেন? দুর্বলচিত্ত কথাটা শিশুদের জন্য খাটে না। তারা আবেগপ্রবণ হবে, অনুভূতিপ্রবণ হবে, এটাই স্বাভাবিকচিত্ত। কঠিনচিত্ত হতে হবে কেন তাদের? কারও মন যদি অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর হয়, বিশেষ যত্ন-আদরে তাকে শিখিয়ে নেওয়াটা তো শিক্ষকদের কাজ। সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া, সবচেয়ে নাজুক ছাত্রছাত্রীদের উপযোগী করে পড়ালে আগে-পিছে সবারই লাভ। অথচ ‘বিখ্যাত’ বিদ্যালয়গুলো কেবলই ‘সুপারবয়’ ‘সুপারগার্ল’ চায়, তাদের দিয়ে করাতে চায় সুপার রেজাল্ট, তারপর সেই রেজাল্ট দেখিয়ে করতে চায় সুপার ব্যবসা। এটাই তো বাস্তবতা, তাই না? তাহলে কী দাঁড়াল? কম মনোযোগী বা বেশি চঞ্চলদের বাদ দাও, যেমন সুপারশপে বাদ পড়ে একটু দাগ লাগা আম বা টমেটো। এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও তার পরীক্ষাপদ্ধতি এই নিয়মেই চলতে থাকবে?

আপাতভাবে মনে হবে, এতে দোষের কী আছে? দোষটা এটাই যে তথাকথিত সুপার-শিকারি স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের দৃষ্টিতে ‘অযোগ্য’দের বাতিল করে ওই শিশু-কিশোরদের ‘অপচয়ের’ খাতায় ফেলে দিচ্ছে। ফ্যাসিবাদী জার্মানির হিটলারি শিক্ষাব্যবস্থায় ঠিক এটাই করা হতো। সেখানে সব শিশু থেকে বেছে বেছে তথাকথিত ‘সুস্বাস্থ্যের অধিকারী’, ‘মেধাবী’ ও ‘নিখুঁত’দের অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। সারা দেশ থেকে থেকে বেছে বেছে তাদের পাঠানো হতো তথাকথিত ‘সেরা’ প্রতিষ্ঠানে। এভাবে ফ্যাসিবাদী বিকৃত আদর্শের কারখানার ছাঁচে ঢেলে তাদের দিয়ে জার্মান জাতিকে দুনিয়ার সেরা জাতি বানানোর ইচ্ছা ছিল হিটলারের। সেরা হওয়ার এই বাসনা শয়তানের মতো, কারণ শয়তানও ফেরেশতা ও মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ভাবত নিজেকে। এই অসুস্থ বাসনা আজ এসেছে সেরা ও স্মার্ট হওয়ার বাজারি চাহিদার ছদ্মবেশে। ভালো রেজাল্ট করিয়ে ভালো চাকরি বা অবস্থানে তোলানোর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা শৈশব ধ্বংস করে দিচ্ছে, হয়রান করে ফেলছে অসংখ্য পরিবারকে। হিটলারি ফ্যাসিবাদ বলত আর্য জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা, আজকে ফ্যাসিবাদ বলছে বাজারি শ্রেষ্ঠত্বের কথা। মোড়ক আলাদা, মনটা এক, কায়দাকানুনও এক।

অভিভাবকদের মধ্যেও এমন মানসিকতার মানুষ আছেন। তাঁরা সন্তানের মন দেখতে চান না। তাদের ভেতরকার সত্যিকার সম্ভাবনার খোঁজ রাখেন না। তাঁরা প্রথমে নিজের হাতে শিশুর কোমল মনটাকে দুমড়েমুচড়ে বাজারের চাহিদামতো গড়তে চান। নিজে না পারলে টিউটর রেখে এবং স্কুলের মাধ্যমে তাদের ‘প্রসেস’ করান। অথচ শিশুরা হলো সম্ভাবনা, বড় হতে হতে আমরা অনেক গুণ হারিয়ে ফেলি। শিশুদের আমাদের কাছে পাঠানো হয়, যাতে তাদের দেখে আমরা সেসব হারানো মানবিক শক্তি ও সৌন্দর্য আবার শিখে নিতে পারি। বিশ্বাস করুন, সত্যিকার সফল ও সার্থক মানুষেরা সবাই এমন কথা যুগের পর যুগ ধরে বলে গেছেন, শিশুদের শেখানোর আগে তাদের কাছ থেকে শেখো। তুমি যা জানো, তা–ই তো শেখাবে, কিন্তু তুমি যা জানো না, তুমি যা হারিয়েছ, তা খোঁজো শিশুর মধ্যে। সেসব সম্ভাবনা সেই আগামীর ডাক ধুকপুক করছে শিশুর বুকে, জ্বলজ্বল করছে তাদের চোখে। শিশুও একজন ব্যক্তি, তার সঙ্গে যা কিছু করা যায় না, তার গায়ে ইচ্ছামতো হাত দেওয়া বা আদরের নামে তাকে বিব্রত করা উচিত না। তাকে সম্মান করে কথা বললে সেও সম্মান দেওয়া-নেওয়া শিখবে। আপনি কখনোই ভাববেন না যে শিশুর ভালোটা আপনিই শুধু জানেন। বাবা-মা হয়ে আমরা হলাম ভবিষ্যতের দিকে শিশুকে এগিয়ে দেওয়ার বাহক মাত্র। এই যাত্রায় আমাদের কাজ শিশুদের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব থেকে যতটা পারা যায় তাদের আগলে রাখা। শিশুরা হলো আপনারই সেরা অংশ, বড় হতে হতে আপনার যেসব গুণ মলিন বা বিনষ্ট হয়েছে, শিশুর মধ্যে এখনো তা তরতাজা। তারা মানবপ্রজাতিরও প্রাণভোমরা। সেই প্রাণভোমরা এভাবে মরে গেলে, এভাবে আত্মহত্যা করলে, এভাবে অবদমিত ও নির্যাতিত হলে আমরাও ধ্বংস হয়ে যাব।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক। প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]