অরিত্রীর 'হত্যাকারী' কে?

অরিত্রী অধিকারী। ফাইল ছবি
অরিত্রী অধিকারী। ফাইল ছবি

মেয়েটির চেহারা বেশ ফুটফুটে। মাত্রই তার স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে শুরু করেছিল। হয়তো নিজের স্বপ্নের দুনিয়ায় ধীরে ধীরে জীবনের সম্ভাবনাগুলোর ভিত পোক্ত করছিল সে। হয়তো রঙিন স্বপ্নের ফাঁক গলে বাস্তবতার কড়া চেহারাটাও একটু একটু করে দেখছিল অরিত্রী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই আর পরিণতি পেল না। অভিমানী অরিত্রী গলায় লাগাল ফাঁস। কিন্তু কেন আত্মঘাতী হলো স্কুলের গণ্ডি পার না হওয়া মেয়েটি? শুধুই কি অপমান? নাকি এই সমাজে চলমান তীব্র প্রতিযোগিতার বলি হলো অরিত্রী?

প্রশ্নবোধক চিহ্ন কি একটু বেশি হয়ে গেল? আসলে আমাদের এই নাগরিক জীবনে প্রশ্ন ও আশ্চর্যবোধক চিহ্নই বেশি। এই সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যায় আমরা বিস্মিত হই বেশি। কারণ, কোনো কিছুই ঠিক মনঃপূত হয় না। সেই বিস্ময় থেকেই প্রশ্ন তৈরি হয়। আমরা প্রশ্ন তুলে বলি, কেন হচ্ছে এসব? উত্তর খুব একটা মেলে না, সেই চেষ্টাও কম। বরং হাহুতাশ করাতেই আমরা বেশি মনোযোগী। আবার উত্তর মিললেও সমাধানের পথে হাঁটার ইচ্ছা ও সামর্থ্য থাকে না। তখন শুরু হয় ‘বলির পাঁঠা’ খোঁজার পালা। ক্ষত উপশমের উপায় তো লাগবে। তখন সমস্যার মূল খোঁজার বদলে, তাৎক্ষণিক ‘মলম’ ব্যবহার করা হয়। তাতে ক্ষতের জ্বালা কমে বটে, কিন্তু ক্ষত সারে না।

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর (১৫) আত্মহত্যার ঘটনায় এখন সেই ‘ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার’ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষক, অভিভাবক, নাগরিক সমাজ—সবাই এ ঘটনায় মুখ খুলেছে। চলছে বিক্ষোভ, হয়েছে তদন্ত কমিটি। অনেকেই বলছেন—এটি আত্মহত্যা নয়, হত্যা। কিন্তু হত্যাকারী কে? সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষায়তন, নাকি পুরো শিক্ষাব্যবস্থা?

গত সোমবার রাজধানীর শান্তিনগর থেকে অরিত্রীর নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বিকেলে সাড়ে চারটার দিকে ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিৎসকেরা অরিত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের অভিযোগ, স্কুলে নকলের অভিযোগে অপমানের জের ধরে সে আত্মহত্যা করেছে। স্কুলের অধ্যক্ষের পাল্টা দাবি, মেয়েটি মোবাইল ফোনে নকলই নিয়ে এসেছিল।

অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী বলছেন, তাঁর মেয়ের পরীক্ষা চলছিল। রোববার পরীক্ষা চলাকালে শিক্ষক অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান। মোবাইলে নকল করছে—এমন অভিযোগে অরিত্রীকে সোমবার তার বাবা-মাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। স্ত্রী ও অরিত্রীকে নিয়ে স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপালের কক্ষে গিয়েছিলেন দিলীপ অধিকারী। তাঁর অভিযোগ, ভাইস প্রিন্সিপাল তাঁদের ‘অপমান’ করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন, যদিও ক্ষমা চেয়েছেন বারংবার। মেয়ের টিসি (স্কুল থেকে দেওয়া ছাড়পত্র) নিয়ে যেতেও বলা হয়। প্রিন্সিপালের কক্ষে গেলেও একই আচরণ পেতে হয় তাঁকে। আর এটিই সইতে পারেনি অরিত্রীর মন।

আকর্ষণীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নামডাক বেশ। আর কিছুদিন পরই এই স্কুলে ভর্তি হওয়া নিয়ে কোমলমতি শিশুদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হবে। এমন বয়সের শিশুরা সেই যুদ্ধের সেনানী হবে, যারা কিনা ‘লড়াই’ শব্দটির অর্থই ঠিকমতো জানে না। লটারিতে ঠিক হবে তাদের ভাগ্য। নাম না উঠলে এই ভর্তিপ্রক্রিয়া তাদের ‘হতভাগ্য’ বানাবে। স্কুলে ভর্তির পর আবার টিকে থাকা নিয়ে প্রতিযোগিতার শুরু। সেই পাস-ফেলের গল্প।

আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মেধা মাপার মাপকাঠি হলো পরীক্ষার ফলাফল। তাতে যত ওপরের দিকে থাকা যায়, ততই সুবিধা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে, শিক্ষকের কাছে, পরিবারের কাছে—রেজাল্ট কার্ডই এখন মূল্যায়নের উপায়। আর তাতে অন্যকে পেছনে ফলে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতাই মূলমন্ত্র। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ছেলেমেয়ে জিপিএ–৫ পেলেই রক্ষে! অন্যথা মনে থাকে খচখচানি।

বিশ্বায়নের জগতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুরোটাই পুঁজিবাদী। এই ব্যবস্থা আমাদের উপহার দিয়েছে একটি তীব্র প্রতিযোগিতা। যেনতেনভাবে তাতে জয়ী হলেই একজনকে সফল বলে ধরে নেওয়া হবে। ঘোড়দৌড়ে সবার শেষে থাকলেই ধরে নেওয়া হবে ব্যর্থ। আমাদের দেশ ও সমাজেও তা ক্রিয়াশীল। ক্রমশ বিকাশমান পুঁজিবাদের এই দেশে প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে কেজি-নার্সারি থেকেই। সফল হওয়ার প্রতিযোগিতা এটি। ছোট শিশুরা কাঁধে বইয়ের বোঝা নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। বাসায় ফিরেও রেহাই মিলছে না। পুঁচকে শিশুটা হয়তো প্রতিযোগিতার মানেই বোঝে না, কিন্তু বোঝে বাবা-মায়েরা। বাধ্য হয়েই ঘোড়ার জকি হতে হয় শিশুদের। আর পা হড়কালেই মেলে তিরস্কার।

স্কুল-কলেজের পর আসে বিশ্ববিদ্যালয়, শুরু হয় ভালো শিক্ষায়তনে ভর্তি হওয়ার প্রতিযোগিতা। তাতে কোনোভাবে টিকে গেলেও নিস্তার নেই। পরিবারের আশা শতভাগ পূরণ করতে না পারলে শুনতে হয় কটু কথা। পরিবারের জিজ্ঞাস্য থাকে, ‘অন্যরা পারছে, তুমি কেন পারবে না?’ স্নাতক পর্যায়ের ডিগ্রি পাওয়ার প্রতিযোগিতাতেও নাম লেখাতে হয়। সেটি হয়ে গেলে আসে পেটে-ভাতে টিকে থাকার সংগ্রাম। সে ক্ষেত্রেও আছে বাবা-মায়ের নানান যদি-কিন্তু। কেউ চান সন্তানের সরকারি চাকরি, কেউ আবার চান মোটা বেতন। না পারলে সেই একই কথা—‘অন্যরা পারছে, তুমি কেন পারবে না?’

এত সব প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী সাজতে গিয়ে একসময়ের ফুলের কুঁড়িগুলোর কি অবস্থা হয়—তা কেউ ভেবে দেখে না। এমন বিষম চাপের টোকায় তাদের মন কি ভেঙে যেতে পারে না? অবশ্যই পারে। আর তাতেই মৃদু ধাক্কা লাগে এ সমাজে। তখন সবাই আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে বসে যায়। শেষে সমস্যা সৃষ্টির তাৎক্ষণিক কারণ সৃষ্টিকারীকে শাস্তি দেওয়া হয়। আর ‘হন্তারক’ প্রতিযোগী ব্যবস্থা রয়ে যায় নাগালের বাইরে। অরিত্রী অধিকারীর ঘটনাতেও সেটিই হচ্ছে।

আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে শুধুই প্রতিযোগিতা। সৃজনশীলতা বাড়াতে চালু হয়েছে সৃজনশীল ব্যবস্থা। কিন্তু প্রতিযোগিতার দৌড় বন্ধ হয়নি। তাই বন্ধ হয়নি গাইড বইও। কারণ, এটি যে গতিবর্ধক! দৌড়াতে দৌড়াতে যখন কেউ উচ্চশিক্ষায় পা রাখে, তখন তাকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিখুঁত উপকরণ হিসেবে তৈরি হতে হয়। তা না হলে যে ভাত জুটবে না। এভাবেই তথাকথিত ‘সৃজনশীল’ হওয়ার পর ‘উৎপাদক’ হওয়ার শিক্ষা নিতে হয়। পড়তে হয় বাজারের জন্য উপযুক্ত বিষয় নিয়ে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় পান থেকে চুন খসলেই সইতে হয় সমাজের চোখে ‘ব্যর্থ’ হওয়ার জ্বালা।

প্রশ্ন হলো, আমাদের অভিভাবক ও শিক্ষকশ্রেণি কেন কেবলই সাফল্যের পূজারি? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রায় সময়ই বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে শুনতে হয়, ‘আমি যে ভুল করেছি, তুমি সেটি কোরো না।’ অর্থাৎ অভিভাবক-শিক্ষকেরাও একটি প্রতিযোগিতার মধ্যে আছেন। সেই শিক্ষকই সেরা হন, যাঁর সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ সাফল্য পায়। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই সেরা হয়, যেটি ফলাফলের নথিতে সফলের তালিকায় থাকে। তাঁরাই বাবা-মা হিসেবে সফল হন, যাঁদের সন্তানেরা সমাজের দৃষ্টিতে কৃতী। সুতরাং অভিভাবক ও শিক্ষকেরাও একটি প্রতিযোগিতায় শামিল। তাতে তাঁদের সফলতা আসে সন্তান বা শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই। এটিই একটি অসুস্থ ও অমানবিক প্রতিযোগিতার দুষ্টচক্র। যাতে থাকা সন্তানেরা একসময় বাবা-মা হয়ে নিজের অজান্তেই রিলে রেসের ব্যাটনটি তুলে দেন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে।

গেল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীও ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। এই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবরে জানা গেছে, আত্মহত্যার এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, প্রেমঘটিত সম্পর্কের টানাপোড়েন, কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়া, দারিদ্র্য ইত্যাদি বিষয়। ঘুরেফিরে ঘটনা একই। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার গল্প। কারণ, এই বাজারব্যবস্থা মানবিক গুণসম্পন্ন কোনো মানুষ চায় না। চায় উৎপাদনশীল আকর্ষণীয় পণ্য, যেটি উঁচু দরে বিক্রি করা যায়।

তাই আমরাও পণ্য হওয়ার চেষ্টাতেই থাকি। কারখানায় কিছু পণ্য তো নষ্টও হয়। ঠিক তেমনি, পাগলের মতো দৌড়াতে না পেরে, নিখুঁত পণ্য হতে না পেরে, ক্লান্ত হয়ে এই সমাজে ঝরে যায় কিছু তাজা প্রাণ। লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে যাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের তাতে কী আর এসে গেল!

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক