আত্মহত্যাকারীর যত 'অপরাধ'

তাইফুর রহমান প্রতীক। সংগৃহীত
তাইফুর রহমান প্রতীক। সংগৃহীত

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাইফুর রহমান প্রতীক কয়েক দিন আগে আত্মহত্যা করেছেন।

পরিবারের অভিযোগ, স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ছাত্রটি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষকদের তীব্র অসহযোগিতার মুখে পড়েন। তাঁকে খুব অল্প নম্বর দেওয়া হয়। কোনো শিক্ষক তাঁর সুপারভাইজার হতে অস্বীকৃতি জানান। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে শেষ পর্যন্ত বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্যও বিভাগীয় শিক্ষকের যে রেফারেন্স প্রয়োজন, সেখানেও দেখা দেয় অনিশ্চয়তা।

পরিবার আগে থেকেই তাঁর মানসিকভাবে ভেঙে পড়া নিয়ে চিন্তা করছিল এবং নানাভাবে সাহস দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব ব্যর্থ হয়েছে। আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদের মধ্যে এখন নানা তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। এত ‘অল্পে’ ভেঙে পড়া উচিত কি না থেকে শুরু করে ওকে ‘কীভাবে বড় করা হয়েছে’ কিংবা শিক্ষকদের আদৌ কতটুকু ‘দায়’ রয়েছে—এ রকম নানা বিতর্ক হচ্ছে।

প্রতীক কি রাগের মাথায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নাকি এটা তাঁর সবকিছু থেকে গুটিয়ে গিয়ে হেরে যাওয়া—এসব বিষয়ে নানান মত থাকলেও এটা সন্দেহাতীত যে তিনি আর নেই।

বেঁচে থাকার জন্য কোনো কারণ কিংবা অনুপ্রেরণা তাঁর জন্য আর অবশিষ্ট ছিল না।

হতে পারে এটা তাঁর নীরব প্রতিবাদ কিংবা সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সমর্পণ অথবা চূড়ান্ত নিস্পৃহতা। আত্মহত্যার ঠিক আগের মুহূর্তে তাঁর মনে কী কাজ করেছিল, তা ফয়সালা হওয়ার উপায় নেই। কিন্তু কোন কোন বিষয় অথবা উপাদান শেষ পর্যন্ত এমন এক পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়, কিংবা সেই পরিণতিকে ‘বেছে’ নিতে বাধ্য করে, তা ভাবার বিষয়।

কারণ, প্রতিবছর তাঁরই মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হচ্ছেন। পরিবার আর রাষ্ট্র তাঁদের জন্য অবদান রাখছে। যোগ্য মানুষ, যোগ্য নাগরিক, পরিবারের ভার কাঁধে নেওয়া মানুষ হয়ে তাঁরা একদিন বেরোবেন। এমন একজনের মৃত্যু শুধু তাঁর নিজেরই মৃত্যু নয়, অন্তত একটি পরিবারকে আমৃত্যু এই ভার বহন করতে হয়। তার পরেই আসে রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ। একটা মৃত্যু কেবল একজনকেই হত্যা করে না, দৃশ্যমানতার বাইরে মৃত্যুবরণ করে আরও অনেকে, অনেক কিছু।

তাঁর মতোই স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা কিংবা প্রবল প্রাণশক্তি নিয়ে প্রতিবছর অনেক তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছেন। জোচ্চুরি করে মার মার কাট কাট সাফল্যের অচেনা গলি দিয়ে ওপরে ওঠার রাস্তা এরকম অনেকেরই জানা নেই, তাঁরা চানও না এমন ভাবের ঘরে ফাঁকি দেওয়া সাফল্য। কিন্তু তারপরও কি লেখাপড়া করে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা তাঁরা করতে পারবেন? তাঁদের সামনে কী আছে?

প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালেই সেখানে সাতজন আত্মহত্যা করেন। ২০১৭ সালে আত্মহত্যা করেন তিন জন। আত্মহত্যার হার যে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাতে টনক নড়ছে কি কারও? অথচ প্রশাসন নির্বিকার। ৩৮ হাজার শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় পরামর্শদাতা মাত্র ১ জন। প্রতীকের বিশ্ববিদ্যালয়েও সবেধন নীলমণি ওই একজনই। অথচ ভবন বানানো উন্নয়নে খরচ হচ্ছে শত কোটি টাকা। এ উন্নয়নের যুগে ভবনের দাম আছে, মানুষের নেই।

গত বছর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক কলামে আলতাফ পারভেজ বলেন, সারা বিশ্বে আত্মহত্যা সংঘটনকারীদের মধ্যে বয়স্কদের সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাদেশে এ সংখ্যায় তরুণেরাই বেশি। একই কলামে খুলনার সৈকত রঞ্জন মণ্ডলের কথা বলেন তিনি। সৈকত একাধিক বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন। সুইসাইড নোটে এই হতাশার কথা তিনি লিখেছিলেন।

‘জীবনের এই স্বাদ, সুপক্ব যবের ঘ্রাণ’ এই ‘বিপুলা পৃথিবী’ কী কারণে এত বহন-অযোগ্য হয়ে উঠছে আমাদের তরুণদের? বেঁচে থাকার, নতুন দিনের ছবি আঁকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে? আগামী, যার দিকে তাকিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, সংগ্রাম করতে চায়, মুখে হাসি ফুটে ওঠে যে প্রেরণায়, তার আর কিছু অবশিষ্ট নেই তার কাছে?

হতে পারে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, এক বছরে গড়ে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ৩ লাখ, যেখানে প্রয়োজন ছিল ১৩ লাখের। বিবিএস আরও জানাচ্ছে, বেকারদের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই তরুণ। শুধু তা–ই নয়, যত বেশি শিক্ষিত, তত বেশি বেকার থাকার আশঙ্কা।

সেই সঙ্গে বাড়ছে ভগ্নমন মানুষের সংখ্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বছর দুয়েক আগের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৬৪ লাখ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে।

আত্মহত্যা যাঁরা করছেন, তাঁদের কথা আমরা জানতে পারছি। আর যাঁরা বেঁচে থাকছেন? কয়েক দিন আগেই, পরিচিত সদ্য–ত্রিশের এক যুবক, একসময়ের প্রবল উদ্দীপ্ত খেলোয়াড়, মেধাবী সতীর্থ বলছেন, কোনো স্বপ্ন আর অবশিষ্ট নেই। যত বড় স্বপ্ন, পরিবার, সমাজ, দেশ নিয়ে, ঠিক ততটাই ব্যর্থতা, ঠিক তত বড় তার পচনের গন্ধ।

এই তিমিরে লাশের গন্ধ এখন নানাভাবে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের তর্ক-বিতর্ক এই ‘শক্ত’ অথবা ‘দুর্বল,’ ‘পেলব’ তরুণদের বেড়ে ওঠার বাহাসে নিহিত থাকলেও ভুললে চলবে না, কোমল কিংবা সবল, বিচিত্র—সব কিসিম নিয়েই দেশ। সংবেদনশীল বাচ্চাটিকে মা ছুড়ে ফেলে দেয় না। কেবল দোষারোপ করার চেয়ে বরং সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে। কারণ, শুধু তার ‘দোষ’ থাকাটাই বাস্তব অবস্থার ভয়াবহতাকে বদলে দেয় না। শক্ত মনের মানুষেরাও কি বিপন্ন বোধ করে না?

এ দেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগই এখন তরুণ, (ইউএনডিপির ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনগোষ্ঠীর ৪৯ শতাংশের বয়স ২১–এর নিচে)। এই সিংহভাগ মানুষকে নিয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কী করতে যাচ্ছে?

প্রতীকের মৃত্যুর এক দিন আগে, প্রথম আলোয় ফারুক ওয়াসিফ প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে নিয়ে লেখেন, পরাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম শ্রেণিতে পাস করার পরও যখন তাঁর নিয়োগ হলো না, তিনি এক অভিনব প্রতিবাদ করলেন। সিগারেট বিক্রির টিন গলায় ঝুলিয়ে সারা ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ালেন, সেখানে লেখা, ‘মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, এমএ, প্রথম শ্রেণি’। লেখক আরও লিখেছেন, তখনো এ দেশে লজ্জার মৃত্যু হয়নি। হাবিবুর রহমানের শিক্ষকেরা লজ্জা পেয়েছিলেন।

তার প্রায় ৭০ বছর পেরিয়ে, স্বাধীন দেশে, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও লজ্জা আর অধোবদনের জ্বালা নিয়ে আশ৶য় নেওয়ার মতো কোনো বুক আজ আর অবশিষ্ট নেই। প্রতিবাদের যেকোনো ভাষার চেয়ে মৃত্যুই আজ সুলভ হয়ে গেছে।

কিন্তু কেন? সেই উত্তর কি আছে আমাদের কাছে?

নুসরৎ নওরিন: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]

আরও পড়ুন: