চামড়াশিল্পে ধর্মঘট হয় না কেন?

মালিকদের ন্যূনতম সমর্থন পেলে শ্রমিকেরা যে কতটা শিল্পবান্ধব ভূমিকা রাখেন, তার অনন্য নজির চামড়াশিল্প
মালিকদের ন্যূনতম সমর্থন পেলে শ্রমিকেরা যে কতটা শিল্পবান্ধব ভূমিকা রাখেন, তার অনন্য নজির চামড়াশিল্প

পূর্ব বাংলায় চামড়াশিল্পের যাত্রা ১৯৪০-এর দশকে। আট দশকের পথচলা শেষে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে এই শিল্প এখন স্থানান্তরিত হচ্ছে সাভারের হেমায়েতপুরে। পোশাকশিল্পনগরী আশুলিয়া থেকে হেমায়েতপুর বেশি দূরে নয়। কিন্তু আশুলিয়া যখন শ্রমিকদের অসন্তোষে অশান্ত হয়, হেমায়েতপুর তখনো শান্তই থাকে।

হাজারীবাগে থাকতেও চামড়াশিল্প ছিল অনেকাংশে অসন্তোষমুক্ত। জাতীয় হরতাল-ধর্মঘটেও ট্যানারিগুলোতে কাজ হতো। এই শিল্পের শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ‘রহস্য’ নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের শিল্প খাতের ব্যতিক্রমী এক সম্পদ। মালিকদের ন্যূনতম সমর্থন পেলে শ্রমিকেরা যে কতটা শিল্পবান্ধব ভূমিকা রাখেন, তার অনন্য নজির এই চামড়াশিল্প। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, বাংলাদেশের শ্রমজীবীদের শিল্পবান্ধব এই ঐতিহ্যের কথা আলোচিত হয় কম। 

১৮০/এ হাজারীবাগ ও একজন আবুল কালাম আজাদ

চামড়ার কাজ খুব আবর্জনাময়। এ রকম একটি খাতে শ্রমিকদের স্বার্থে সংগঠন করতে গিয়েছিলেন ঢাকার রায়েরবাজার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন কায়সার। বামপন্থী আদর্শ থেকেই সেই উদ্যোগ। কালের পরিক্রমায় এই শিল্পের প্রধান শ্রমিক সংগঠন এখন ‘ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’। তারাই এই খাতের ‘সিবিএ’। ১৯৭৭ সাল থেকে ট্যানারি ইউনিয়নের কার্যালয় ১৮০/এ হাজারীবাগে। তারও আগে ১৯৬৫ সালে এই ইউনিয়নের নিবন্ধন।

বর্তমানে হেমায়েতপুরে আরেকটি কার্যালয় খোলা হলেও হাজারীবাগের পুরোনো একতলা বাড়িতেই চামড়া-শ্রমিকদের আসা–যাওয়া বেশি। কারখানা হেমায়েতপুরে স্থানান্তরিত হওয়ার পরও শ্রমিকেরা অধিকাংশই হাজারীবাগ থেকে আসা-যাওয়া করে চাকরি টিকিয়ে রাখছেন। সেই সূত্রেই প্রায় দুই প্রজন্ম হলো চামড়া খাতের শ্রমিকদের সুখ-দুঃখের সাথি এবং একই সঙ্গে এ অঞ্চলে শ্রমিক রাজনীতির উজ্জ্বল এক অংশীদার ১৮০/এ হাজারীবাগ। আশুলিয়ার পোশাকশ্রমিকদের মতো নিজেদের কার্যালয়ে যেতে এখানকার শ্রমিকদের গ্রেপ্তারের ভয়ে জড়সড় থাকতে হয় না। হামলাও হয় না এখানে।

৪২ বছর ধরে এই অফিসেই ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন শ্রমিক সংগঠক আবুল কালাম আজাদ। তারও তিন বছর আগে ‘ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়ন’-এর কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের শ্রমিক রাজনীতির জ্যেষ্ঠ প্রজন্মের সফল এক চরিত্র তিনি। প্রয়াত শ্রমিকনেতা মো. নুরুল ইসলামের হাত ধরে চামড়াশ্রমিকদের জগতে তাঁর আসা। নুরুল ইসলাম রাজনীতিতে এসেছিলেন লেখক শহীদুল্লা কায়সারের উৎসাহে। প্রগতিশীল রাজনীতির ঐতিহাসিক সেই পরম্পরা এখন গল্পের মতোই শোনায়। বিশেষ করে যখন আবুল কালাম আজাদ জানান, ট্রেড ইউনিয়ন কাজের শর্ত হিসেবেই বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে একপর্যায়ে হাজারীবাগে জামিলা ট্যানারিতে কাজে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের শ্রমিক রাজনীতির ইতিহাসে বহুল আলোচিত এক শ্রমিক সংগঠক হলেন প্রয়াত তাজুল ইসলাম। আবুল কালাম আজাদ ও তাজুল ইসলাম চাঁদপুরের মতলব জে বি হাইস্কুলে একসঙ্গে পড়তেন। সেই সূত্রেই দুজনের একসঙ্গে বাম রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া। সেই সূত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রেড ইউনিয়নের জগতে প্রবেশ। তাজুল ইসলাম আদমজীতে, আবুল কালাম আজাদ হাজারীবাগে। সর্বশেষ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন আবুল কালাম। বহুদিন অবশ্য কোনো দলের সঙ্গে নেই আর। তবে সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও ছেড়ে যাননি চামড়া খাতের মজুরি শ্রমিকদের। 

জ্বালাও-পোড়াও ছাড়াই ১৯টি ‘চুক্তি’

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অংশীদারত্ব সামান্য। কিন্তু বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত এটা। সরকার ২০২১ সাল নাগাদ এই খাতে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলার করতে চায়। প্রায় ১৫০টি কারখানা রয়েছে বর্তমানে। শ্রমিক সংখ্যায় কারখানাভেদে রকমফের আছে। সব মিলিয়ে শ্রমিক হবে ১৫-২০ হাজার। ঈদুল আজহার মৌসুমে এই সংখ্যা বাড়ে।

অনুসন্ধানে দেখা গেল, সিবিএ হিসেবে ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে চাঁদা পায় আট হাজার শ্রমিকের। তবে সব ধরনের শ্রমিকের স্বার্থই সিবিএ দেখে, দেখতে হয়। প্রতি দুই বছর পরপর এই ইউনিয়ন শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে একটা ‘চার্টার অব ডিমান্ড’ দেয় মালিকদের দুটি সংগঠন ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস্ অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনকে। এই দাবিদাওয়ার ভিত্তিতেই দর–কষাকষি শেষে চুক্তি হয়। সিবিএ কার্যালয়ে এ রকম ১৯টি চুক্তির নথি পাওয়া গেল। এ রকম চুক্তি করতে গিয়ে কখনোই চামড়া খাতে বড় ধরনের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন, ধর্মঘট করতে হয়নি। শ্রমিক ও মালিক উভয়ে ছাড় দিয়ে সমঝোতার পরিবেশ ধরে রেখেছে।

গার্মেন্টসসহ অনেক খাতের জন্য চামড়াশিল্পের এই ট্রেড ইউনিয়ন সংস্কৃতি রীতিমতো ঈর্ষণীয়। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এর রহস্য কী? পোশাক খাতসহ অন্য শিল্পে এই মডেল অনুসৃত হয় না কেন?

আবুল কালাম আজাদের ভাষায়, ‘আমরা শ্রমিক সংগঠন করতে এসে এই খাতের গোপন কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়াইনি। সিবিএকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়নি। শিল্পস্বার্থকে সম্মান করা হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে শ্রমিকদের জন্যও সম্মান দাবি করা হয়েছে। দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে ছাড় দেওয়া হয়নি—তবে আক্রমণাত্মক মনোভাবও নেওয়া হয়নি। কাজকর্ম বন্ধ করে ধর্মঘট করেননি শ্রমিকেরা। দেশের স্বার্থ মনে রাখা হয়েছে।’

‘আপনারা শ্রমিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক চরিত্র নিতে দেননি, মালিকদের কাছে প্রিয় থাকার জন্যই কি এ রকম কৌশল?’—প্রশ্ন করতেই চার দশকের সিবিএ সভাপতি বললেন, ‘এ দেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দল এবং তাদের শ্রমিক সংগঠন আছে। আমাদের সংগঠন কোনো দলে নেই। এই দুর্বলতা মাথায় রেখেই আমরা সক্রিয় ছিলাম। বহু সিবিএ হাইজ্যাক হয়েছে। হয়তো ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকার কারণেই আমাদের উৎখাত করা যায়নি। আমরা যদি শুধু মালিকদের স্বার্থই দেখতাম, তাহলে শ্রমিকেরা নিশ্চয়ই আমাদের ছেড়ে চলে যেতেন। শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করেই ইউনিয়ন কার্যালয়ে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে দশকের পর দশক। শ্রমিক সংগঠকদের মধ্যে বহু দলের সমর্থক আছেন, কিন্তু ইউনিয়নে শুধু কথা হয় শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে।’

মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের এই সুদিনে অবশ্য সম্প্রতি খানিকটা চিড় ধরেছে। সিবিএ কর্মকর্তারা মনে করছেন, হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে স্থানান্তরের পর তাঁদের অবজ্ঞা ও কোণঠাসা করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে মালিক সমাজের একাংশের মধ্যে। সর্বশেষ ‘দ্বিপক্ষীয় চুক্তি’র পরও শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে পুরোনো মালিক-শ্রমিক সম্পর্কে কিছুটা ফাটল ধরেছে ইতিমধ্যে। অবশ্য তা এখনো অতীত ঐতিহ্য ছেড়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি এবং মজুরি বৃদ্ধির অঙ্গীকারও কার্যকর হয়েছে। 

চামড়া খাতে সুস্থ শিল্পসম্পর্কের কর্তৃত্ব মালিকদেরও

আবুল কালাম আজাদ স্বীকার করেছেন, শুধু তাঁদের নমনীয়তা নয়, চামড়া খাতের মালিকদের পরিণত দৃষ্টিভঙ্গিও এই খাতের শ্রমিক-মালিক সম্পর্ককে অনন্যতা দিয়েছিল। এ খাতের শিল্পসম্পর্কের কর্তৃত্ব তাই মালিক-শ্রমিক উভয়ের। তাঁর ভাষায়, ‘অহিদুল হায়দার চৌধুরী, মনসুর আহমেদ, মোস্তফা মিয়া প্রমুখ মালিক নেতারা মূল্যবান মনে করতেন শ্রমিকদের। ফলে শ্রমিক সংগঠনকে হুমকি মনে করা হতো না। শ্রমিক সংগঠকদের ধ্বংস করা বা কিনে ফেলার মনোভাবও ছিল না।’ এমনও দেখা যায়নি, ট্যানারি মালিকেরা আবুল কালাম আজাদ বা অন্য নেতাদের জেলে পাঠাতে উদ্যোগী হয়েছেন।

তবে আলাপ শেষে বিদায়ের আগে ৪৫ বছর শ্রমিক রাজনীতিতে কাটিয়ে দেওয়া এই সংগঠক আক্ষেপ করে জানালেন, পুরোনো মালিকেরা যে নতুন প্রজন্মের হাতে কারখানা দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের দ্বারা শিল্পসম্পর্ক ঝুঁকিতে পড়ছে। চামড়া খাতের পুরোনো মূল্যবোধের সামনে নতুন পরীক্ষার উপলক্ষ তৈরি হয়েছে। বিলিয়ন ডলারের শিল্প খাত হওয়া সত্ত্বেও হেমায়েতপুরে বাসাবাড়ি, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুবিধাহীন পরিবেশে শ্রমিক পরিবারগুলোকে বিপদে ফেলা হয়েছে। প্রতারিত হওয়ার বোধ দানা বাঁধছে তাঁদের মধ্যে।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক