পানিতে আমাদের ওজন কমে যায় কেন?

চট্টগ্রামে বিজ্ঞান উৎসব ছিল। বিকাশ ও বিজ্ঞান চিন্তা স্কুলশিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানসচেতনতা বাড়ানোর জন্য দেশের ছয়টি বিভাগীয় শহরে এই উৎসবের আয়োজন করেছে। উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো বিজ্ঞান প্রকল্প প্রদর্শনী। সেখান থেকে বাছাই করে ভালো ভালো প্রকল্পকে পুরস্কার দেওয়া হয়। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার জন্য পুরস্কারপ্রাপ্তরা ঢাকায় জাতীয় বিজ্ঞান উৎসবে তাদের প্রকল্পগুলো প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে আসবে। সেটা হবে জাতীয় বিজ্ঞান উৎসব। সেরা প্রকল্পগুলো পুরস্কার পাবে।

পুরো আয়োজন শুধু স্কুলশিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। কারণ, বিজ্ঞানসচেতনতার কাজটা গোড়া থেকেই শুরু করা দরকার। কথাটা যে কত বড় সত্য, সেটা সেদিন চট্টগ্রামের অনুষ্ঠানে প্রমাণ পেলাম। আমাদের একটা ভয় ছিল, টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম মহানগর যেখানে ভেসে গেছে, সেখান কি স্কুলশিক্ষার্থীরা শুধু বিজ্ঞানের টানেই উপস্থিত হবে? আর তা ছাড়া তাদের অভিভাবকেরাই-বা কোন ভরসায় এই ছোট ছোট সন্তানকে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে চট্টগ্রামের পিটিআই ইনস্টিটিউটের মাঠে নিয়ে যাবেন?

কিন্তু দেখা গেল, সেই সাতসকালেই স্কুলের শিক্ষার্থীরা এসে গেছে। তাদের অভিভাবকেরা বোধ হয় সন্তানদের উৎসাহের তোড়ে বাধ্য হয়েছেন বিজ্ঞান মেলায় যেতে। অথবা হয়তো এটাই সত্য যে আমাদের দেশে সবার মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি একটি বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে। না হলে এমন বৃষ্টিবাদল উপেক্ষা করে পিটিআই প্রাঙ্গণ সেই সকালে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল কীভাবে? অবশ্য কাকতালীয়ভাবে সেদিন আগে-পরে অঝোরে বৃষ্টি ঝরেছে বটে, কিন্তু উৎসবের সময়টুকু ছিল প্রায় বৃষ্টিমুক্ত। বোধ হয় বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই সেদিন প্রকৃতি তরুণদের প্রতি মিষ্টি হাসি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।

যাহোক, আমরা খুব অবাক হয়েছি, ক্লাস থ্রি-ফোরের শিক্ষার্থীরা এমন নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে, যা সত্যিই আন্তর্জাতিক মানের। ভূমিকম্প হলে রক্ষা পাব কীভাবে, সেটা সেখানে দেখানো হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়েও কয়েকটি প্রজেক্ট ছিল। আরেকটি প্রজেক্টে দেখানো হয়েছে, আমরা যে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করার সময় হেঁটে শক্তি খরচ করি, সেই শক্তিকে কীভাবে বিদ্যুৎ-শক্তিতে রূপান্তরিত করে বাতি জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা যায়। এ যেন এক ভোজবাজি। আমরা হাঁটব আর ওদিকে হাঁটার শক্তি বিদ্যুৎ-শক্তি হিসেবে আরেক মেশিনে জমা হবে। সেই শক্তি দিয়ে আবার আমরা অন্য কাজ করতে পারব। এটা যদি লাভজনক প্রকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে হয়তো একদিন ওই তিন কিশোর, আজকের স্কুলশিক্ষার্থী, বড় হয়ে নোবেল জয় করবে!

আমাদের দেশে কত যে প্রতিভা লুকিয়ে আছে, তার খবর আমরা খুব কমই রাখি। তাদের খুঁজে বের করা আমাদের এক বড় দায়িত্ব। এই কাজই আমরা করছি মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা ও বিকাশের উদ্যোগে দেশব্যাপী এই বিজ্ঞান উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে। উৎসবের একটি বড় অংশ ছিল কুইজ প্রতিযোগিতা। এরপর হলভরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রশ্নোত্তরপর্ব। সেখানে একজন শিশুশিক্ষার্থী প্রশ্ন করে, আমরা কীভাবে সাঁতার কাটি? আমাদের শরীরের ওজন তো পানির চেয়ে ভারী। তাহলে পানিতে নামলে কেন হালকা হয়ে যাই। আর হালকা হই বলেই তো সাঁতার কাটতে পারি!

উত্তর দিচ্ছিলাম আমরা কয়েকজন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক, চুয়েটের অধ্যাপকসহ আরও কয়েকজন। সেই শিশু শিক্ষার্থীর প্রশ্ন আমাদের কাছে বেশ চমকপ্রদ মনে হয়েছে। কারণ, আর্কিমিডিসের সূত্র তার জানার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন করতে পারা কম মেধার পরিচয় নয়। আমাদের পক্ষ থেকে অবশ্য তাকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছি পানিতে ওজন কমে যাওয়ার রহস্য। আর্কিমিডিসের সূত্র অনুযায়ী কোনো বস্তু তরল পদার্থে বা পানিতে আংশিক বা সবটা ডুবে গেলে সে তার নিমজ্জিত অংশের আয়তনের সমান আয়তনের অপসারিত তরলের ওজনের সমান ওজন হারায়। সে কারণেই পানিতে নামলে আমরা একটু হালকা হয়ে যাই। অবশ্য তারপরও ভেসে থাকার জন্য আমাদের বিশেষ কায়দায় হাত-পা নড়াচড়া করতে হয়।

উত্তরের চেয়ে প্রশ্ন করার বিষয়টাই আমাদের বেশি আকর্ষণ করেছে। কারণ, প্রশ্ন করতে পারা হলো জ্ঞান অর্জনের প্রথম কথা। আরেকটা বিষয় হলো, প্রশ্ন করার জন্য চিন্তাভাবনা ও কল্পনা করার সক্ষমতা থাকতে হয়। সে জন্যই বলা হয়, কল্পনা করতে পারা হলো জ্ঞানের চেয়েও শক্তিশালী। কথাটা আমরা অনেকেই খেয়াল করি না। যে স্বপ্ন দেখতে পারে না, তার পক্ষে বড় বিজ্ঞানী হওয়া কঠিন।

এটা কেন? কারণ, স্বপ্ন দেখতে বা কল্পনা করতে ভাষা জানতে হয়। ভাষা ছাড়া আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি না। ধরুন, আপনি স্বপ্ন দেখছেন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গোসল করছেন। একবার ভাবুন তো ভাষা না জানলে আপনি কি একটুও চিন্তা করতে পারতেন? এটা সম্ভব নয়।

তাহলে স্বপ্ন দেখতে ভাষা জানতে হবে। আর ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত করলে আরও বেশি জ্ঞান অর্জন করা যায়। তখন আরও উঁচু স্তরের স্বপ্ন দেখা সম্ভব।

মানুষ ও নিম্নবর্গের প্রাণীর মধ্যে বড় পার্থক্যটা কী, বলতে পারেন? আমার মনে হয় পার্থক্যটা হলো মানুষ কল্পনা, স্বপ্ন, চিন্তাভাবনা মুখের ভাষায় প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু নিম্নবর্গের প্রাণীরা সেটা পারে না। অথচ ওদের শব্দযন্ত্র আছে। মস্তিষ্কও আছে। কিন্তু মানুষের সুবিধা হলো মস্তিষ্কের যে অংশ ভাষা নিয়ে কাজ করে, সেই অংশের সঙ্গে মুখের স্বরযন্ত্রের বিশেষ স্নায়বিক সংযোগ রয়েছে, যা অন্যান্য প্রাণীর নেই। ফলে মানুষ তার চিন্তাভাবনা শব্দযন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে, অন্য প্রাণীরা পারে না।

এই অসাধারণ গুণের জন্যই মানুষ বড় বিজ্ঞানী হতে পারে। এই সম্ভাবনা কমবেশি সব মানুষেরই আছে। আমাদের বিজ্ঞান উৎসব মানুষের এই বিশেষ গুণের বিকাশ সাধন ও মেধার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]