গায়ে আগুন দিয়ে কেন চলে গেলেন একাকী মেয়েটি?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রাজশাহীর শাহমখদুম থানা থেকে বেরিয়ে নিজের গায়ে আগুন দেওয়া মেয়েটি এখন কবরে। পুলিশ প্রথম থেকেই বেশ তৎপর ছিল। আগুনে পোড়া মেয়েটির দেহ প্রথমে তারা রাজশাহী হাসপাতালে, পরে ঢাকায় পাঠিয়েছে। সাধারণত পুলিশ এসব কাজ ধীরেসুস্থে করে। একেবারে চটপট ঝকঝক ছিল তাদের তৎপরতা। এ জন্য তাদের শতকোটি ধন্যবাদ। কিন্তু থানা থেকে বেরিয়ে এসে কেরোসিন-দেশলাই সংগ্রহ করে কেন ছাত্রীটি আবার থানার সামনে গিয়ে গায়ে আগুন দিলেন, তার কোনো কূলকিনারা পাওয়া গেল না এখনো। এটাই কি ছিল মেয়েটির শেষ প্রতিবাদ?

গত শুক্রবার সকালে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়ার পর রাজশাহীর শাহমখদুম থানায় গিয়ে হাজির হন মেয়েটি। তাঁর অভিযোগ ছিল স্বামী-শ্বশুরের বিরুদ্ধে। কিন্তু পুলিশের কথায় ভরসা না পেয়ে তিনি বেরিয়ে গিয়ে থানার কাছেই প্রকাশ্য রাস্তায় নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন। তাঁকে প্রথমে রাজশাহীতে, পরে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। ৪৫ শতাংশ পোড়া নিয়ে ভুগে তিন দিনের মাথায় মেয়েটি মারা যান। পুলিশই তাঁকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে।

মেয়েটির মৃত্যু-পরবর্তী পুলিশি তৎপরতা কিছু একটার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ত্বরিত তৎপরতায় তারা খুঁজে বের করেছে তাঁর জন্মদাতা পিতাকে। পালক বাবা জেলে থাকায় পুলিশের বড় প্রয়োজন আসল বাবাকে। নিজেকে পুড়িয়ে দেওয়া মেয়েটি যখন দুধের শিশু, তখন তাঁর মা হঠাৎ মারা গেলে তাঁকে পালক নেয় অন্য এক পরিবার। সেই পরিবারেই বড় হয় সে।

মেয়েটির লাশ দাফনের পর পুলিশ জন্মদাতা পিতাকে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় সাজিয়ে-গুছিয়ে পাঠিয়ে দেয় শাহমখদুম থানায়। সেখানে নিরীহ গরিব পিতা মেয়েটির শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীকে আসামি করে মামলা করেছেন। তাহলে কি পুলিশ তাদের কোনো অগ্রহণযোগ্য আচরণ থেকে মানুষের নজর সরানোর জন্য তাড়াহুড়া করেছে? মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি কি বিষয়টা খতিয়ে দেখবে? জীবন্ত মেয়েটির পাশে না দাঁড়িয়ে শাহমখদুম থানা তাদের কোনো গাফিলতি ঢাকতে কি মৃত মেয়েটির পিতাকে পাশে রাখতে চাইছে?

মেয়েটির মনে অনেক অভিমান থাকতে পারে। মায়ের কোল না পাওয়া মেয়েটি হয়তো অন্যান্য পালক সন্তানের মতো কূলের সন্ধানে আকুল ছিলেন। সামাজিক-পারিবারিক অবহেলায় তাঁর মনটা তেতে ছিল কিন্তু পুলিশের কোন আচরণ তাঁকে এমন একটা চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করল? তিনিতো একটা ন্যায্য বিচারের জন্য সহায়তা পাওয়ার আশায় সেখানে গিয়েছিলেন। সেটা তিনি পাননি।

তবে এখন মেয়েটি কারও পথ আগলে আর দাঁড়াবেন না। তদন্ত কমিটিকেও আর দোষীকে খুঁজতে হবে না, থানার পুলিশের আচরণ সঠিক ছিল কি না, তা নিয়েও কাউকে আর ভাবতে হবে না। সবাই নাজাত পেল। পুলিশের ইচ্ছায় মামলা হলো শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে।

এটা তো গেল একটি অপমৃত্যুর ফৌজদারি কার্যকারণের বিষয়। মেয়েটির ঘটনা চোখের সামনে কিন্তু মনের আড়ালে থাকা লাখ লাখ অসহায় পালক সন্তানের কথা ভাবাল। তাদের অধিকার হরণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেল। পালিত কন্যা হওয়ায় তিনি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন না বিধায় স্বামী-শ্বশুরের গঞ্জনা থেকেই সমস্যার শুরু। আগে তাদের সেই অধিকার ছিল। কিন্তু ক্ষমতা কুক্ষিগত করে স্বৈরশাসক এরশাদ ১৯৮২ সালে দত্তক আইন রহিত করেন। বঙ্গবন্ধুর চালু করা এই আইনে সম্পত্তির অধিকারসহ পালতে নেওয়া সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো সব ন্যায্য আচরণের হকদার করা হয়েছিল। এরশাদের অজুহাত ছিল, এই আইনের জন্য ধর্মান্তর আর শিশু পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। আইনি কাঠামো ভেঙে দিলেও সন্তান পালক নেওয়ার বিষয়টি থেমে থাকেনি। দায়িত্বশূন্য এক সাংঘাতিক জটিলতার মধ্য দিয়ে সেটা চলছে।

আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি তখন দেখেছিলেন, মূলত সম্পত্তির অধিকার প্রশ্নেই সমস্যার জটিলতা শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘পালক নেওয়া মা-বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের আত্মীয়রা এসে যদি সম্পত্তি থেকে ওই সন্তানকে বঞ্চিত করে, তাহলে কিন্তু আইনত তার কিছুই করার থাকে না। এটা একটি বিরাট সমস্যা।’

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের প্রথম দিকের স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও শিশু দত্তক নেওয়ার ধারাটি আজও অনুস্বাক্ষর করেনি। প্রতি পাঁচ বছর পরপর সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনার সময় বাংলাদেশ কথা দেয় যে শিগগির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু পালক ছেলেমেয়েদের অধিকার নিয়ে ভাবার ফুরসত হয় না কারও। মানবাধিকার কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান নাসিমা বেগমকে ২০১৪ সালে বিবিসি এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল। তিনি তখন সব এতিম শিশুর দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব। সে সময় তিনি জানিয়েছিলেন, গত বছর (২০১৩) আইন কমিশন থেকে পৃথক একটি দত্তক আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এখন সরকারের দিক থেকে এ নিয়ে একটি বিধি প্রণয়নের কথাও ভাবা হচ্ছে। বর্তমান শিশু আইনের আওতায় বিকল্প যত্ন বা পরিচর্যার নীতির আলোকে তাঁরা এই বিধি করতে যাচ্ছেন। ‘আমরা মনে করি, শিশু নিবাসের চেয়ে একটি পরিবারে মা-বাবার আদরে একটি শিশু বড় হলে তা ভালো হবে। তাই আমরা বিষয়গুলো সহজ করার কথা ভাবছি।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বিধিটি তৈরি হওয়ার পর সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকা শিশুদের যেসব পরিবার গ্রহণ করবে, সেখানে তাদের ১৮ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত লালন-পালনের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবে সরকার। এরপর তারা আইনত নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব নিতে পারবে।’

বলা বাহুল্য, আইন বা বিধি কোনোটিই আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে পায়নি। আশা করি মানবাধিকার কমিশনের প্রথম নারী চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দত্তক আইনটি শিশু অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করবেন। পাশাপাশি মেয়েটি কোন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলেন, সেখানে পরিবার বা পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, সেটা নিয়েও সুষ্ঠু তদন্ত হোক।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক।
[email protected]